আমাদের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যেতে হবে

Published in সমকাল on Thursday, 15 March 2018

মঙ্গলবার ডিবিসি টেলিভিশনের রাজকাহন অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের সামনে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনা করেন। এখানে ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আকারে তা প্রকাশ হলো। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন নবনীতা চৌধুরী


ডিবিসি: সব ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল হওয়ার পথে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী? বাংলাদেশেরই-বা সে প্রস্তুতি রয়েছে কি-না?

অধ্যাপক রেহমান সোবহান: প্রথমত, এটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। এখানে একসাইটেড হওয়ার খুব প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের একটা টার্গেট থাকতে হবে। এখানে কেবল আয়ের (মাথাপিছু) ব্যাপার থাকবে না। আমাদের ট্রান্সফরমেশন ইকোনমি নিয়ে আসতে হবে। দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হবে। দেশীয় বিনিয়োগ কিছু হচ্ছে; কিন্তু সেগুলো খুব নির্দিষ্ট (খাতে) হয়ে যাচ্ছে, যেমন গার্মেন্ট শিল্প। আমাদের যেহেতু উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যেতে হবে, সেহেতু বিনিয়োগের প্রসারণ দরকার। যেমন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন। এখন ভিয়েতনাম এ পথে যাচ্ছে। মূল বিষয়টি হলো অর্থনীতির বৈচিত্র্যকরণ। সে প্রক্রিয়া এখানে পুরোপুরি শুরু হয়নি। এ ক্ষেত্রে বিশ্নেষণের ব্যাপার যে, সীমিত বৈদেশিক বিনিয়োগ কেন আসছে। এখানে সুশাসনের কথা প্রথমেই আসবে। তারপর ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও যথাযথ প্রকল্প সম্পাদন ইত্যাদি।

ডিবিসি :সেগুলোর সঙ্গে তো বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। মানে প্রকল্পে দক্ষতা বাড়ানো…

রেহমান সোবহান : হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। এখন তো প্রকল্পে অত্যধিক খরচ করতে হয়। দেশে একটা রাস্তা তৈরি করতে খরচ বেশি হচ্ছে। আমরা যদি সর্বাধিক সুফল পেতে চাই, সেখানে দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা ইনভেস্টমেন্টের দিকে যাচ্ছি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে বটে; কিন্তু সেখানেও আমাদের রিসোর্সেস ও ইফিসিয়েন্সি বড় চ্যালেঞ্জ।

ডিবিসি: সিপিডি বলছে, সরকারকে নানা ধরনের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। আসলে সমন্বিত কৌশলটা কী? আমরা তো শুনি, কোন বছর কত বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, কত বিনিয়োগ আসবে- সে পরিসংখ্যান সরকার তো দিচ্ছে। এখানে নতুন কৌশলের প্রয়োজন কী?

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: নতুন পরিস্থিতিতে নতুন কৌশলের প্রয়োজন পড়ে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য। আমরা যদি স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে বের হই, নতুন পরিস্থিতির বিষয়ে বিবেচনা থেকেই নতুন কৌশলের কথা এসেছে। তার সঙ্গে বিদ্যমান কৌশল সামঞ্জস্য কি-না সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। আপনি উপস্থাপনায় মধ্যম আয়ের দেশের কথা বলেছেন, সে বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। আসলে আমাদের দেশ ২০১৫ সালেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের অনেক মন্ত্রী-এমপি বলেন, ২০২১ সালে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো- এটা ভ্রান্ত কথা। আসলে ২০২১ আমাদের মনের ভেতরে সুদৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে। তার আগেও যে আমরা করে ফেলতে পারি, এটা বোধ হয় তাদের বিবেচনায় নেই। আবার অনেকে বলেন, স্বল্পোন্নত থেকে আমরা ২০২১ সালে বেরোব- এটাও ঠিক নয়। স্বল্পোন্নত থেকে আমরা ২০২৪ সালে বেরোব। যা হোক, নতুন পরিস্থিতিটা কী। প্রথম কথা হলো, এটা থেকে বেরোলে আমাদের লাভটা কী হবে? লাভ হবে, বাংলাদেশ যে একটা বিকাশমান অর্থনীতি এবং সেটা যে তুলনীয় দেশের তুলনায় দ্রুততর হচ্ছে, সেখানে একটা আস্থার জায়গা সৃষ্টি হবে। ফলে বিদেশি যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়, তাদের জন্য এটা ইতিবাচক সার্টিফিকেট বা আস্থার জায়গা সৃষ্টি হলো। এখন কথা হলো, এটাকে কীভাবে ব্যবহার করে আমরা বাস্তবে সুফল নিয়ে আসব। একটা দিক যে, হয়তো এটার ফলে আমরা শুল্ক্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারাব। যদি তা হারাই, সে ক্ষেত্রে রেহমান সোবহান যেটা বলেছেন, একটিমাত্র পণ্যের ওপর যে আমরা নির্ভরশীল- তাহলে পণ্যের বহুবিধকরণ লাগবে। বাজারের এক্সপানশন লাগবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার বা অন্য কোনো নতুন বাজারে প্রবেশের বিষয় আসবে। চীনের বাজারে বড়ভাবে যাওয়া, ভারতের বাজারে বড়ভাবে যাওয়ার বিষয় আসবে। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসটি প্লাস। আমাদের প্লাসের ভেতরে ঢুকতে হলে আরও কিছু কাজ করতে হবে। আমাদের শ্রমিকের অধিকার দিতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের আগের চেয়েও অনেক বেশি সচেতন ও সৎ হতে হবে।

ডিবিসি: বাজার সুবিধা তো আমরা ২০২৪ পর্যন্ত পাব…।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ২০২৪ নয়, ২০২৭ সাল পর্যন্ত। সে পর্যন্ত আমাদের বড় ধরনের ধাক্কা না-ও হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, এখন আমরা যেভাবে অনুদান পাই, যেটা ফেরত দিতে হয় না। আমরা কীভাবে ঋণ পাই, সেটা দেখতে হবে। তখন আমাদের বিকল্প খুঁজতে হবে। চীন যেমন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বাইরে অবকাঠামোগত ব্যাংক তৈরি করেছে, সেখান থেকে কীভাবে ঋণ আনা যায়।

ডিবিসি: আমি রেহমান সোবহানের কাছে যাই। আপনাদের আলোচনাতে বারবার এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে, অনেকেই এ সার্টিফিকেট পেয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে। তারপর আর এগোতে পারেনি। সে বিপদটা কোন কোন দেশে হয়েছে এবং আটকে যাওয়ার বিপদগুলো কী?

রেহমান সোবহান: আটকে যাওয়ার অনেক বিষয় আছে। যারা এ অবস্থা পার হয়ে গেছে, তাদের দেখা দরকার। যেমন ভিয়েতনাম। তারা ডাইভারসিফাইড হয়েছে। এখন বাংলাদেশ তো ভাবছে, আমাদের ব্যাপক পরিচিতি আছে। রফতানি হচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু ভিয়েতনাম জনসংখ্যায় ছোট, জিডিপিতে ছোট। তাদের এক্সপোর্ট এখন দুইশ’ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা কেন হয়েছে? কারণ তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে। এমনকি তাদেরও পোশাক শিল্প রয়েছে। তারা দশ জায়গায় কম্পিট করছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করছে। ট্রাম্পের নীতি তাদের কোনো বাধা হয় কি-না সেটা দেখতে হবে। মূল বিষয় হলো, তারা ম্যানেজ করেছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ এখানেই চলে আসে। এখন তো আমাদের হাতে প্রায় দশ বছর আছে। এই সময়ের মধ্যে কেমন করে একটা পলিসি নিতে হবে, কেমন করে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে- তা নিয়ে ভাবতে হবে।

ডিবিসি: আপনারা বলছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা ইউনিক। এখানে ছোট দেশে অনেক জনসংখ্যা, আমাদের চ্যালেঞ্জও অন্যরকম…।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: হ্যাঁ, আমাদের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন, এর প্রকাশ ও মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। কেন এ প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে বারবার যে, আমরা স্বল্পোন্নত থেকে বেরোচ্ছি; কিন্তু উল্লাস না করে সতর্কতা কেন। যদিও আমরা একটা সার্টিফিকেট পাচ্ছি; কিন্তু অর্থনীতির বিচারে সেটা যে খুব শক্তিশালী সূচক, তা নয়। যেটা রেহমান সোবহানও বলেছেন। শক্তিশালী সূচক হলো, যদি অর্থনীতির ভেতরে উৎপাদনশীল খাতের প্রভাবটা বাড়ে। আপনার প্রক্রিয়াকরণ খাত ছোট, অবকাঠামোর সমস্যা রয়েছে, কৃষি শিল্পায়িত হয়নি। কম বিনিয়োগে অধিক উৎপাদনশীলতার বিষয়টিতে তেমন মনোযোগ নেই। যাতে তারা কম শ্রমে বেশি মজুরি পায়। আমরা বলি, স্বল্পোন্নত থেকে বের হওয়াটাই ফিনিশিং লাইন নয় বরং এটি একটি মাইলফলক। ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাতে হলে আপনার অর্থনীতির রূপান্তর ঘটাতে হবে। সেই রূপান্তর ঘটানো ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা- এগুলো একসঙ্গে করার জন্য কৌশল প্রয়োজন। বাংলাদেশে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এ পরিকল্পনা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার টার্গেট নিয়ে করা হয়নি। এর মধ্যে আসছে এসডিজি। এগুলো কোনটা বৈশ্বিক পরিকল্পনার সঙ্গে যায়, কোনটাকে অগ্রাধিকার দেব- সে নীতিমালা নেই। আমরা সে গতিশীলতা তৈরি করতে পারব কি-না সে কথাই বলা হচ্ছে। আমরা উল্লাস করছি ঠিক, উল্লাসের সঙ্গে আমাদের যে দায়িত্ব এসে পড়েছে, সে ব্যাপারে সচেতনতা নেই।

ডিবিসি: এই যে মধ্যম আয়, নিম্নমধ্যম আয়, উন্নত, উন্নয়নশীল ও নানা সূচক ইত্যাদি পরিভাষায় বাস্তব উন্নয়নের চিত্র উঠে আসে কি-না?

রেহমান সোবহান: দেখা গেল কোনো দেশ শুধু পর্যটনের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে গেল। কিংবা একটি দেশে ডায়মন্ড থেকেই ৫০ শতাংশ জিডিপি আসছে। ভুটান ইলেকট্রিক দ্রব্য দিয়ে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ যেখানে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের ছোট্ট টি-শার্ট ও তার ডাইভারসিটি যেখানে বিশ্বকে মাত করছে, সেখানে দেশটির নিশ্চয়ই আরও সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের গ্রামের নারী শহরে এসে ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে, সেখানেও তো শ্রমের একটা রূপান্তর হচ্ছে। তার শ্রম দিয়েই যে আমরা বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছি, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। উদ্যোক্তারা আছে। আবার কেবল বড় ফ্যাক্টরিই নয়, ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, শহরে-গ্রামে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঙালিরা কাজ করছে, যেটা অনেক দেশের নেই। আমাদের এত মেধা আছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যার কথা আসছে। আসলে জনসংখ্যা আমাদের শক্তি। যে দেশে ১৬ কোটি মানুষ আছে, সেটা তো একটা বাজার। এই বাজার এক্সপানশনের বিষয় আছে। যদি আমি বুঝতে পারি, এই প্রোডাক্টের প্রয়োজন আছে, সে প্রোডাক্ট উৎপাদনের বিষয় আছে। বাজার বাড়বে, আয় বাড়বে। আমার মনে আছে, প্রায় ২০ বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়া ছিলাম। ওই সময় একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ভবিষ্যতে শক্তিশালী দেশ হবে চীন। কারণ তার বড় বাজার আছে। আমার জনসংখ্যা বেশি, সে জন্য জনসংখ্যা রফতানির বিষয় আছে। যখন বিশ্বে সমস্যা দেখা দেয়, তখন আমরাও সমস্যাগ্রস্ত হই। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার আছে, ভোক্তা আছে, তার তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু এমনিতেই জনসংখ্যা সম্পদ হবে না।

ডিবিসি: তাহলে বছরের পর বছর ধরে যা নিয়ে কথা হচ্ছে, ব্যাপারটা কি এ রকম যে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে, গ্যাস দেব, বিদ্যুৎ দেব, বিনিয়োগ হবে, তারপর উন্নয়ন হবে- ব্যাপারটা কি সে রকম?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য :আসলে কোনো সূচকই কিন্তু বাস্তবতাকে ধরতে পারে না, ধারণ করে না। একেকটা সূচকের একেক ধরনের গুণাবলি রয়েছে। যেমন ধরুন- আমরা বলছি, আমাদের উত্তরণ হবে; কিন্তু এখানে তো বৈষম্যের হিসাব নেই। দেশে যে আয়বৈষম্য বাড়ছে, সেটার হিসাব এর ভেতর নেই। যিনি বৈষম্যের শিকার তিনি হয়তো বলবেন, কই- আমি তো কিছু পেলাম না। আবার এর মধ্যে জিনিসপত্রের দামের হিসাব নেই। আমরা যে উত্তরণের কথা বলছি, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ বলবে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, কিসের উত্তরণ হচ্ছে? এ জন্য অর্থনীতিবিদরা এক হাতে কথা বলেন না। দুই হাতে কথা বলেন।

ডিবিসি: একজন দর্শক বলছেন, রফতানির কথা বেশি না ভেবে যদি আমরা আমদানি পণ্য দেশে উৎপাদন করি?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: খুবই সুন্দর কথা, এটা নিঃসন্দেহে ভালো। আরেকটা কথা, অবকাঠামো খাতে বিদেশি বিনিয়োগ থাকলেও বড় কলকারখানায় উৎপাদনশীল খাতে তা কম। যেসব দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়েছে, তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কারও নীতিকথায় আসে না। তারা দেশের স্থিতিশীলতা দেখে, একটা দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ দেখতে চায়, সুশাসন দেখতে চায়, মানবাধিকার দেখতে চায়, গণতান্ত্রিক স্থায়িত্ব দেখতে চায়।

ডিবিসি: ড. রেহমান সোবহান, আপনাদের সিপিডির আলোচনায় বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুশাসন- এই বিষয়গুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে দর্শকদের সম্পূরক প্রশ্ন, দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিয়ম ইত্যাদির মধ্যেও দেশ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে?

রেহমান সোবহান: আসলে আমাদের দেশে প্রত্যেকটি ব্যক্তি কাজ করে, এ জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। এটা আমার শক্তিশালী বাংলাদেশের একটি সুবিধা। আমাদের উদ্যোক্তা, শ্রমিক, নারী, ক্ষুদ্রঋণ, তারপর প্রবাসী সবাই তো কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের আশপাশে যা হচ্ছে, মানে অনিয়ম ইত্যাদি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

ডিবিসি: আপনি বলেছেন- কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান প্রভৃতি দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তারা যে খুব গণতান্ত্রিক তা তো নয়। তাহলে এখানে গণতন্ত্র এত প্রয়োজন কেন?

রেহমান সোবহান: না, এখানে দুই ক্যাটাগরির দেশ। চীন ও ভিয়েতনামের অন্য ইতিহাস। তাদের ওয়ান পার্টি স্টেট। কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সমস্যা আছে, তারপরও একটা বিষয় রয়েছে, তারা সবকিছু একটা ডিসিপ্লিনে রাখতে পারছে। কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এখন গণতন্ত্র শক্তিশালী। তার চেয়ে বড় কথা, এসব দেশে আইনের শাসন। তাদের ইতিহাস একরকম। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস তো অন্য। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তো গণতন্ত্রের জন্যই লাইম-লাইটে ছিলেন। আমাদের ডিএনএর মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র। এই ডিএনএর মধ্যে অন্য দেশের একটা প্রক্রিয়া এখানে চলবে না। তাতে আরও নানা রকম সংকট দেখা দেবে।

ডিবিসি: ড. দেবপ্রিয়, আপনি অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের সুশাসন. রাজনীতি ইত্যাদিও ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন কি-না?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি একটু আগের প্রশ্নে আসি। এত দুর্নীতি, এত স্বজনপ্রীতি, মেধার প্রতি বৈষম্য. লুটপাট ইত্যাদি যদি না থাকত, তাহলে চিন্তা করেন আমরা কোথায় চলে যেতাম? তাহলে আমরা ৫-৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করছি, আরও হয়তো ২ শতাংশ অর্জন সম্ভব ছিল কিংবা আজ যেটা করছি, সেটা ১০ বছরের আগেই করতে পারতাম। আরেকটা বিষয় হলো- এগুলো যেসব দেশে ঘটে, সেখানে যেভাবে উদ্যোক্তা শ্রেণিরা এগোয় বা সাধারণ মানুষ এগোয়, সেটা তারা এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা করে এগোয়। একে ইংরেজিতে বলে পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট। এর মাধ্যমে সে একটা জিনিস অর্জন করে, দুইটা ছেড়ে দেয়। কোন জিনিসটা ছেড়ে দেব, তা সে নির্দিষ্ট করে। হয়তো সে বাকস্বাধীনতা ছেড়ে দিচ্ছে, ছেলেমেয়ের শিক্ষা নিচ্ছে। কিন্তু একটা সময় আসতে পারে, যখন সে দেখবে, সে যে গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা চাচ্ছে; তার বাকস্বাধীনতা নেই বলে সে মান পাচ্ছে না। তখন কিন্তু সামাজিক সমঝোতা না হয়ে গণবিস্ম্ফোরণ হয়। এটাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস। বাংলাদেশে আপনি পেছনে ফিরে দেখেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস তো এটাই, একাত্তর কিংবা ঊনসত্তরের ইতিহাসও এটি।

ডিবিসি: আপনারা কেবল ব্যক্তি উদ্যোগের কথা বললেন। রাজনৈতিক উদ্যোগও তো আছে। যেমন এ সরকারের ভিশন ২০২১। তারা এর মধ্যে অনেক কিছু অর্জন করতে চায়। এ রকম রাজনৈতিক উদ্যোগ ব্যক্তি উদ্যোগের প্রেরণা কি-না?

রেহমান সোবহান: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভিশনারি, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সে ভিশন পূর্ণ করতে সব জায়গায়ই সায় লাগে। ভিশনই যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে দল, প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থা সবকিছুতেই সে ভিশনের বাস্তবায়নের বিষয় থাকতে হবে। আমাদের অভাব এখানেই।

ডিবিসি: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সরকারের ধারাবাহিকতা কি-না? বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে তো অনেক কিছুই বদলে যায়?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মানেই একই সরকার নয়। একই সরকার নির্বাচিত হয়ে এলেও সে নতুন সরকার তৈরি করে। স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন- এগুলো এখন একসূত্রে গ্রথিত। যদি এগুলো না থাকে, তাহলে আরও বেশি অসুবিধা হচ্ছে। বিশ্ব এখন অনেক বেশি বৈরী হয়ে যাচ্ছে। ওই বৈরিতা আটকাতে হলে দেশের ভেতর স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক সমঝোতা যাতে না ভেঙে পড়ে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।