Published in আলোকিত বাংলাদেশ on Sunday, 10 May 2018
১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন আজ
মেয়াদ উত্তীর্ণ ২৬৩টি প্রকল্প এডিপির বোঝা
আবু সাইম
ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থা এখনও সেকেলে। কাগুজে সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে বিক্রয় বা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি হস্তান্তরে নথি খুঁজে বের করতেই সময় লাগে মাসের বেশি; পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জমি সংক্রান্ত সব তথ্য ডিজিটালি সংরক্ষণে নেওয়া হয় ৯২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার প্রকল্প। এতে দেশের ৫৫টি জেলার রেকর্ড রুমে রক্ষিত চার কোটি ৫৮ লাখ ৪৩ হাজার খতিয়ান (সিএস, এসএ এবং আরএস) তথ্য ভারে যোগ হওয়ার কথা। ২০১২ সালে নেওয়া ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড প্রণয়ন এবং সংরক্ষণ (প্রথম পর্যায় : বিদ্যমান মৌজা ম্যাপস অ্যান্ড খতিয়ানগুলোর কম্পিউটারাইজেশন)’ শীর্ষক এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে। তবে ধীর গতির কারণে সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এমনকি গত ডিসেম্বরে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় প্রকল্পটি দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ দিলেও বাড়তি মেয়াদে শেষ হচ্ছে না প্রকল্পটি। এ অবস্থায় তা আগামী অর্থবছরের এডিপিতে নামমাত্র বরাদ্দ নিয়ে সংযুক্ত করা হচ্ছে। শুধু এ প্রকল্পই নয় এমন ২৬৩টি প্রকল্প রয়েছে যা আগামী অর্থবছরের (২০১৮-১৯) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপিতে) যোগ হচ্ছে। নতুন ও পুরানো মিলিয়ে ১ হাজার ৪৫২টি অনুমোদিত প্রকল্প স্থান পাচ্ছে আগামী এডিপিতে। এসব প্রকল্পে বরাদ্দের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার এডিপি অনুমোদনের জন্য আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় তোলা হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আগামী জুনেই মেয়াদ শেষ হচ্ছে এমন প্রকল্প রয়েছে ২১০টি, আবার জুনের মধ্যে সমাপ্ত করার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হলেও শেষ হয়নি এমন প্রকল্প রয়েছে ৫২টি। দুই প্রকার মিলিয়ে এ ধরনের মোট ২৬৩টি মোয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্প যাচ্ছে আগামী এডিপিতি। অতিরিক্ত এ প্রকল্পকে এডিপির জন্য বোঝা হিসেবেই দেখছে পরিকল্পান কমিশন। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প শেষ না হওয়াকে বাজেট প্রক্রিয়া ও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বলে মনে করে তারা। তাই এগুলোতে তারকা চিহ্নিত (*) করে নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ অবস্থায় নতুন ও পুরানো মিলে মোট ১ হাজার ৪৫২টি অনুমোদিত প্রকল্প স্থান পাচ্ছে আগামী এডিপিতে। আর এসব প্রকল্পে বরাদ্দের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার এডিপি অনুমোদনের জন্য আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় তোলা হচ্ছে। এতে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা, বিদেশি উৎস থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে। এতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) প্রকল্প থাকবে ৭৮টি এবং বরাদ্দ ও অনুমোদন ছাড়াই জায়গা পাচ্ছে ১ হাজার ৩৩৮ প্রকল্প। আবার বিদেশি সহায়তা প্রাপ্তির সুবিধার্থে অনুমোদন ও বরাদ্দহীনভাবে ৩২৬টি প্রকল্প যুক্ত করা হচ্ছে। আগামীতে একনেকের অনুমোদন সাপেক্ষে এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। তাছাড়া সংশোধন না করে ঝুলে থাকা পুরাতন প্রকল্পের আওতায় কোনো অর্থ ব্যয় করা যাবে না। ফলে আগামীতে অর্থ বরাদ্দের পাশাপশি অনুমোদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পরিকল্পনা কমিশনে বাড়তি চাপ পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হলেই এ থেকে কাঙ্খিত উপকার বেশি পাওয়া সম্ভব। তাই এডিপিতে সব প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হয় তা যেন যথাসময়ে শেষ হয় তার বিষয়ে নজর রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয় না, এতে সেগুলো পরের এডিপিতে চলে যায়। এতে প্রকল্পের সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে যায়। এজন্য যেসব প্রকল্প শেষ হয়েও হয়নি এবং যেগুলো আগামী এডিপিতে শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে উভয় ধরনের প্রকল্পেই পর্যাপ্ত অর্থ সববরাহ দিয়ে সেগুলো শেষ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
এর আগে এডিপিতে প্রকল্প সংযোজনে নির্দেশিকা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। এতে বলা হয় যেসব প্রকল্প ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে মেয়াদ শেষ হচ্ছে সেগুলো মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া নতুন এডিপিতে যুক্ত করা যাবে না।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ৩ মে অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় আলোচনায় উঠে আসে মোয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্পের বিষয়টি। সভায় কার্যক্রম বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলতি বছরে মেয়াদ শেষ হচ্ছে এমন ২১০ প্রকল্পে ১৩ হাজার ৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, যা মোট এডিপির ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত বছরের শেষের দিকে এডিপি পর্যালোচনা সভায় মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, পুরাতন প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে অর্থ ব্যয় করা যায় না। আর মেয়াদ বাড়াতে সংশোধন প্রক্রিয়ায় সময় লাগে চার থেকে পাঁচ মাস। এর ফলে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেয়। প্রকল্প আবার পরের এডিপিতে যুক্ত করতে হয়। এটি সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সভায় চলতি অর্থবছরে সমাপনীর জন্য নির্ধারিত ৫২ প্রকল্প নতুন এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করায় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে ৩০০ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছিল। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে একাধিকবার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরও কাজ শেষ না হওয়া ৫২ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এনইসি সভায় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
এদিকে কমিশন মনে করে, প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলে বাজেট ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। ফলশ্রুতিতে সুফল পেতে বিলম্ব হয়। এর মধ্যে ৩৬ প্রকল্পের সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ১ লাখ টাকা প্রতীকী বরাদ্দ দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়া ১৬ প্রকল্পের সিদ্ধান্ত এনইসির ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বছরের পর বছর প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখা একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এটির পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায় অহেতুক অনেক প্রকল্পও এডিপিতে নেওয়া হয়, যেগুলোর তেমন একটা প্রয়োজন থাকে না। এডিপিতে বেশি প্রকল্প নেওয়ার কারণেও প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসে না। এক্ষেত্রে প্রজেক্টের সংখ্যা না বাড়িয়ে মানের দিকে নজর দিতে হবে। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প শেষ করতেও হবে। এতে সরকারের অর্থেরও সাশ্রয় হবে।