Originally posted in প্রথম আলো on 13 September 2025
সরকারি প্রতিষ্ঠানের দশা, পাঁচ টাকা খরচে আয় এক টাকা
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত দেশের একমাত্র সরকারি কাচ কারখানা উসমানিয়া গ্লাস শিট দুই বছর ধরে বন্ধ। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত কারখানাটি বন্ধ হওয়ার সময়; অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক টাকার পণ্য উৎপাদনে খরচ হয়েছে পাঁচ টাকা। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খরচ আরও বেড়েছে।
কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ—এই ৯ মাসে কোম্পানিটির পণ্য বিক্রি করে আয় করেছে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। তার বিপরীতে খরচ হয়েছে ৪৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি ১ টাকা আয় করতে কোম্পানির খরচ হয়েছে প্রায় ২০ টাকা। শুধু গত দুই অর্থবছর নয়, গত এক যুগে সরকারি এই কোম্পানি লাভের মুখ দেখেনি। কোম্পানিটি সর্বশেষ মুনাফা করেছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। ওই বছর প্রায় ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা মুনাফা করেছিল কোম্পানিটি। এর পর থেকে লোকসান গুনছে উসমানিয়া গ্লাস শিট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি টাকা।
কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ লাখ ৮১ হাজার বর্গফুট কাচ উৎপাদিত হয়। ওই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি মোট ২ কোটি ২০ লাখ টাকার কাচ বিক্রি করেছে। অথচ এই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির খরচ ছিল ১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সেই হিসাবে আয়ের চেয়ে কোম্পানিটির খরচ পাঁচ গুণ বেশি; অর্থাৎ এক টাকা আয় করতে কোম্পানিটির খরচ পড়ছে পাঁচ টাকা।
করোনা মহামারির সময় ২০২০-২১ অর্থবছরে কারখানাটির উৎপাদন ছিল শূন্য। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসান গুনতে হয়েছে ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর ১০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর গড়ে ৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে।
গত পাঁচ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, উসমানিয়া গ্লাস শিট প্রতিবছর কাচ উৎপাদনে যে অর্থ ব্যয় করেছে, কাচ বিক্রি করে তার কেবল ৬৬ শতাংশ আয় করতে পেরেছে; অর্থাৎ কাচ বিক্রি করে তারা উৎপাদন খরচই তুলতে পারেনি। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ অর্থবছরে কাচ উৎপাদনে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ১০৪ কোটি টাকা। আর কাচ বিক্রি হয়েছে ৬৯ কোটি টাকার। তার মানে, এক টাকা আয় করতে কোম্পানির খরচ দেড় টাকা।
কেন খরচ বেশি
কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড (ইউজিএসএফএল) কারখানায় সাদা রঙের গ্লাস শিট উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। বেসরকারি মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এটি দেশে একমাত্র গ্লাস শিট উৎপাদন কারখানা ছিল। বেসরকারি খাতে ১৯৯৭ সালে এমইবি গ্রুপ এবং ২০০৫ সালে পিএইচপি ও নাসির গ্রুপ উৎপাদনে এলে ধস নামে উসমানিয়ার বাজারে।
কোম্পানির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিএইচপি ও নাসির গ্লাস ছাড়াও আকিজ গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ এবং এবি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত মানের কাচ উৎপাদন করছে। আবার স্থানীয় বাজারে বৈদেশিক পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে কোম্পানির মুনাফা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে নকশার কাচ তৈরি করি, তার এখন আর চল নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও আমরা যে দামে কাচ বিক্রি করি (১৫ টাকা ফুট) সেই একই দামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নত কাচ বাজারে দিচ্ছে। ফলে বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা নেই। বাজার ধরতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কাচ উৎপাদন করতে হবে।’
কোম্পানি–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানার মূল সমস্যা পুরোনো যন্ত্রপাতি ও অনুন্নত প্রযুক্তি। জরাজীর্ণ হওয়ায় ২০১৯ সালে কারখানার একটি ফার্নেস বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের জুনে কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তাতে দ্বিতীয় ফার্নেসটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আবারও উৎপাদন শুরু হয়। এরপর ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট দ্বিতীয় ফার্নেসের আয়ুষ্কাল শেষ হলে আবারও বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি।
কর্মকর্তারা আরও জানান, টানা ১০-১১ বছর ধরে লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ। ধারদেনা করে বেতন-ভাতা চলছে। এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই আবার অবসরে চলে গেছেন। আবার কাউকে বিসিআইসি অন্য অফিসে সংযুক্ত করেছে। এ অবস্থায় কারখানা চালু করেও লাভ হবে না। পুরোনো সব প্রযুক্তি বদলে নতুন ফার্নেস আনতে হবে। অন্যথায় বেসরকারি খাতে এটিকে ছেড়ে দেওয়া লাভজনক।
ঋণের টাকায় বেতন-ভাতা
দুই বছর ধরে কারখানা বন্ধ। ফলে পণ্য বিক্রি করে আয়ের সুযোগ নেই। এখন কোম্পানিটি উৎপাদনের জন্য আনা কাঁচামাল ও পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করছে। বন্ধ কারখানায় যে সামান্য আয় হয়, তা আসছে এসব পণ্য বিক্রি করেই।
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের ব্যয়ের ৪৫ শতাংশ খরচ হয় বেতন-ভাতায়। প্রতিবছর বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিষ্ঠানটির গড় ব্যয় প্রায় এক কোটি টাকা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১০৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তাঁদের সবার বেতন চলছে বিসিআইসির টাকায়। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বিসিআইসি থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৩৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বেশি। সব মিলিয়ে উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড প্রায় ৬১ কোটি টাকার দায়, তথা ঋণে জর্জরিত।
লোকসানে থাকা এই প্রতিষ্ঠান প্রতিবছরই বেতনের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের সভায় অংশগ্রহণের জন্য সম্মানী দিয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৭টি বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতিটির জন্য প্রত্যেক পরিচালক নিয়েছেন ছয় হাজার টাকা করে। এ বাবদ প্রতিষ্ঠানের ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ অর্থবছরে মোট ৩৭টি বোর্ড সভায় শুধু সম্মানী বাবদ ব্যয় হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। প্রতি সভায় ৪০ হাজার টাকার বেশি।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের হিসাব ও অর্থ বিভাগের প্রধান আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত বিসিআইসি থেকে টাকা নিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে বিসিআইসি থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৩ কোটি টাকা। আরও কিছু যোগ হয়েছে এ বছর।
করণীয় কী
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম আনিসুজ্জামান বলেন, ‘কারখানার চালুর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমাদের পক্ষ থেকে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, বর্তমান বাজারে বিদ্যমান প্রযুক্তি দিয়ে কারখানাটি চালু করা হলে লাভ হবে কি না, তা অনিশ্চিত। বর্তমানে ঋণ নিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে, এতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না।’
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির বেতন-ভাতার জন্য ঋণ দেওয়া সরকারি সংস্থা বিসিআইসি নিজেই ২৮ বছরের মধ্যে ২৪ বছর লোকসান দিয়েছে। এই সময়ে লোকসানের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বিসিআইসি রেকর্ড ৯১৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
দায়দেনা মিটিয়ে উসমানিয়া গ্লাস শিটকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো প্রযুক্তি দিয়ে আবার উৎপাদনে এলেও তারা (উসমানিয়া) বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। দায়দেনা মিটিয়ে জায়গাটিতে বেসরকারি সহযোগিতায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা অন্য কোনো শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে।