Originally posted in বণিকবার্তা on 3 March 2025
উচ্চ সুদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার
দেশী ঋণের পেছনেই যাচ্ছে সুদ ব্যয়ের ৮৯ শতাংশ
পরিচালন ও উন্নয়ন খাত মিলিয়ে প্রতি বছরই বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে। যদিও ব্যয়ের তুলনায় রাজস্ব আয় অপর্যাপ্ত। এ অবস্থায় ঘাটতি মেটাতে বরাবরই দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে।
পরিচালন ও উন্নয়ন খাত মিলিয়ে প্রতি বছরই বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে। যদিও ব্যয়ের তুলনায় রাজস্ব আয় অপর্যাপ্ত। এ অবস্থায় ঘাটতি মেটাতে বরাবরই দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে। আর উচ্চ সুদহারের কারণে দেশী ঋণের সুদ পরিশোধে সরকারকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সুদ পরিশোধে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তার ৮৯ শতাংশই গেছে দেশী ঋণের পেছনে। অন্যদিকে উচ্চ সুদের কারণে বেসরকারি খাতও ঋণ নিয়ে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকার নিম্ন রাজস্ব আয় ও উচ্চ ব্যয়ের একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ফিসক্যাল প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সুদ পরিশোধ বাবদ ৭১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে দেশী ঋণের বিপরীতে ৬৩ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা ও বিদেশী ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার সুদ। এমনকি সরকারের পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৪২ শতাংশই এ সময়ে গেছে সুদ পরিশোধে।
সরকারের ঋণের পরিমাণ গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ২০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১২০ টাকা (ওই সময়ের বিনিময় মূল্য) হিসাবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকায়। ওই সময়ে দেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৪ হাজার ২৪৩ কোটি টাকার সুদ। অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতেও যদি তা অব্যাহত থাকে, অর্থবছর শেষে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এর আগে কখনই এ খাতে এত বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। গত কয়েক অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ও সুদ ব্যয়ের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ২৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ব্যয় হয়েছিল ৩ লাখ ৬১ হাজার ২১ কোটি টাকা এবং সুদ বাবদ ৮৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা, যা মোট পরিচালন ব্যয়ের ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে সরকার ৭০ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা বা ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ অর্থ সুদ পরিশোধে ব্যয় করে। কভিডের সময় ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ৭০ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ অর্থ সুদ বাবদ ব্যয় হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সবসময়ই বিদেশী ঋণের তুলনায় দেশী ঋণের সুদের হার বেশি থাকে। ফলে সরকার যত বেশি দেশী ঋণ নেবে এর পেছনে সুদ ব্যয়ও বেশি হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে তা বেড়ে গেছে। রাজস্ব আহরণ কম হওয়ার কারণে সেটি সরকারের ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। পাশাপাশি বর্তমানে বিদেশী ঋণের প্রবাহও কমে গেছে। ফলে সরকারকে বাধ্য হয়ে স্থানীয় উৎস থেকে বাড়তি সুদের ঋণ নিতে হয়েছে। এ অবস্থায় উচ্চ সুদের কারণে একদিকে সরকারের ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতও ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগের জন্য উচ্চ সুদ একটি প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও ঋণের সুদহার বাড়ার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে আমরা একটি উচ্চ সুদ ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশই দেশী ও বিদেশী ঋণ পরিশোধে ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে সরকারকে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য আবার ঋণ নিতে হচ্ছে। রাজস্ব আয় ও সরকারের ব্যয়ের যে পরিস্থিতি তাতে আমরা একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। এর থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।’
এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে বের হতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে জানান মুস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, ‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও খেলাপি ঋণ আদায়ের মতো বিষয়গুলোয় যে ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল যেকোনো কারণেই হোক সরকার তা গ্রহণে আগ্রহী নয় কিংবা নিতে পারছে না। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে বর্তমানে আমরা যে দুষ্টচক্রের মধ্যে আছি সেটি বিদ্যমান থাকবে এবং বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বের হওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ দেশে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদের হার বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের প্রভাবে তিন বছর ধরেই ঋণের সুদহারের পাশাপাশি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। এতে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার ১২ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার গিয়ে ১৫-১৬ শতাংশে ঠেকেছে। এত উচ্চ সুদ দিয়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে নতুন বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছেন না। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে গেছে ৮ শতাংশের নিচে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুসারে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারকে স্থানীয় ও বিদেশী মিলিয়ে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর সঙ্গে ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। যদিও অর্থবছর শেষে সুদ ব্যয়ের পরিমাণ আরো বেশি হবে। সেজন্য এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এতে চলতি অর্থবছর শেষে আসল ও সুদ মিলিয়ে সরকারের ঋণ পরিশোধ ৪ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে। চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণ পরিশোধ সর্বোচ্চ হলেও ২০২৮-২৯ অর্থবছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের চাপ তুলনামূলক বেশি থাকবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বেশ কম। ফলে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি, সামাজিক ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের জন্য অর্থের টান পড়ে। ঋণের সুদ পরিশোধ তো আর আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্য পড়ে না। ফলে এ খাতে সরকারের ব্যয় বেড়ে গেলে অন্যান্য খাতের ওপর চাপ পড়বে এবং ভৌত অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে সরকারের ব্য়য়ের সুযোগ কমে যাবে। এটি একটি চিন্তার বিষয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ অনেক বেড়েছে এবং এ কারণে সুদের বোঝাও বাড়ছে। ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে সেটি কোনো উৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে না। ফলে এর বিপরীতে কোনো রিটার্ন নেই। এতে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। বরাদ্দের চেয়ে যদি সুদ পরিশোধে বেশি অর্থ ব্যয় হয়ে যায় তাহলে সেটি সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে। এটি উদ্বেগের বিষয়।’
অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়ানোর মাধ্যমে সরকার এ চাপ সামাল দিতে পারে বলে উল্লেখ করেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি যদিও বলেন, ‘প্রতি বছরই লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব হয় না, ঘাটতি থাকে। চলতি অর্থবছরে সেটি আরো চ্যালেঞ্জিং হবে। বিভিন্ন কারণে অর্থবছরের শুরুর দুই মাস ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার পরের মাসগুলোয়ও মন্থর গতি দেখা যাচ্ছে। ব্যবসা যদি লাভজনক না হয় তাহলে তো আর কর আদায় করা সম্ভব না। সব মিলিয়ে সীমিত সম্পদের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্থবছরটি পার করতে হচ্ছে।’