সঠিক খাতে ব্যয় নিশ্চিত করতে না পারলে ঋণের বোঝা কেবল বাড়বেই – ফাহমিদা খাতুন

বিদেশি ঋণ

Originally posted in প্রতিদিনের বাংলাদেশ on 26 September 2025

চাপ সামলাতে বাজেট সহায়তায় নজর

অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে বাজেট সহায়তার দিকে আরও বেশি ঝুঁকছে সরকার। রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংক খাতের দুরবস্থা এবং প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে আসার প্রেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরেই বাজেট ঘাটতি মেটানো ও সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বিদেশি ঋণনির্ভরতা বেড়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্র বলছে, ১৩ আগস্ট জলবায়ু নীতিনির্ভর বাজেট সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এ অনুরোধ পাঠানো হয়। বেইজিংভিত্তিক এই ঋণদাতা ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, শিগগিরই ইআরডি, অর্থ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেবে।

সরকার শুধু এআইআইবির দিকেই তাকিয়ে নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় ও ইআরডি কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকেও চলতি অর্থবছরে প্রায় ১.৮৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে বাজেট সহায়তা সংগ্রহের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।

রাজস্ব ঘাটতি ও বাজেট সহায়তার প্রয়োজনীয়তা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আদায় আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেড়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা, গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছিল, যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব সংগ্রহে। সীমিত রাজস্বের চাপ সামাল দিতে তাই সরকার বিকল্প হিসেবে বাজেট সহায়তার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘রাজস্ব সীমিত হলে বাজেট বাস্তবায়নে চাপ তৈরি হয়। তখন বাজেট সহায়তা সরকারকে বিকল্প উৎস দেয়।’

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এ ধরনের সহায়তা মূলত ঋণ, যা সরকারের দায় বাড়ায়। তাই সঠিক খাতে ব্যয় নিশ্চিত করতে না পারলে ঋণের বোঝা কেবল বাড়বেই।’

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাজেট সহায়তার একটি বড় লক্ষ্য ব্যাংক খাত সংস্কার। দেশে কয়েকটি দুর্বল ও সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক আছে, যেগুলো পুনর্গঠন ছাড়া টিকে থাকা কঠিন। কিছু প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করতে হবে, কিছু প্রতিষ্ঠানকে পুনঃমূলধন জোগাতে হবে। এ ধরনের সংস্কার বাস্তবায়নে বাজেট সহায়তা অপরিহার্য।’

ঋণের শর্ত ও সুদের বোঝা

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এআইআইবির সহায়তা আসবে বাজারভিত্তিক সুদহারে, যা ৬ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এটি হার্ড লোন হওয়ায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন সাপেক্ষ। ৩৫ বছরের মেয়াদি এ ঋণের মধ্যে পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকলেও সুদের চাপ অন্য আন্তর্জাতিক উৎসের তুলনায় বেশি। ফলে ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে শঙ্কা থাকছে।

বৈদেশিক মুদ্রা ও সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও এম মাসরুর রেয়াজ বলেন, ‘২০২২ সালের জুন-জুলাই থেকে শুরু হওয়া সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপে বাজেট সহায়তা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, টাকার প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বাজেট সহায়তার প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বজায় রাখা, রিজার্ভ পুনর্গঠন ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে এ সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ।’

তবে তিনি সতর্ক করেন, ‘অ-সুবিধাজনক বা কঠিন শর্তের ঋণ বেশি নিলে ঋণ ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে পড়বে। তাই বাজেট সহায়তা বা প্রকল্প ঋণকে উচ্চফলনশীল খাতে ব্যবহার করতে হবে।’

ঋণপ্রবাহের উল্লম্ফন

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বাজেট সহায়তা ঋণের প্রবাহ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহুগুণ বেড়েছে। ২০২০ অর্থবছরে সহায়তা ছিল ১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২.৫৯ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অন্তর্বর্তী সরকার রেকর্ড ৩.৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা নেয়। মূলত কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব সামলাতে এই সহায়তা ব্যবহৃত হয়েছে।

ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি

বর্তমানে এডিবির সঙ্গে তিনটি বাজেট সহায়তা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে, যেখান থেকে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার আসতে পারে ২০২৬ সালের মধ্যে। এ ছাড়া ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য ২০২৭ সালে আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকও আগামী দুই অর্থবছরে ২.৭৭ বিলিয়ন ডলারের একটি সহায়তা পরিকল্পনা দিয়েছে, যার মধ্যে চলতি বছরেই ৫০০ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সব মিলিয়ে বাজেট সহায়তা এখন সরকারের জন্য স্বল্পমেয়াদি সমাধান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এই সহায়তা কতটা সঠিক খাতে ব্যয় হচ্ছে, তা কি সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিচ্ছে, নাকি কেবল ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে। রাজস্ব ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক সহায়তা হয়তো তাৎক্ষণিক স্বস্তি দেবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর স্থায়িত্ব কতটা, তা নিয়েই এখন আলোচনার কেন্দ্রে।