একজন যোগ্য প্রশাসক, মেধাবী নীতিপ্রণেতা ও নীতি বিশ্লেষক – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in বণিকবার্তা on 23 December 2025

ছবিঃ বণিক বার্তা
অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের অর্থনীতিবিদ। তিনি সমাজের একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তাকে অনেকে শিক্ষক হিসেবে চেনেন। অনেকে গবেষক হিসেবে জানেন। অনেকেই পেশাজীবীদের নেতা হিসেবেও জানেন।

অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের অর্থনীতিবিদ। তিনি সমাজের একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তাকে অনেকে শিক্ষক হিসেবে চেনেন। অনেকে গবেষক হিসেবে জানেন। অনেকেই পেশাজীবীদের নেতা হিসেবেও জানেন। তাকে যদি গবেষক হিসেবে স্মরণ করতে চাই তাহলে অবশ্যই তার বিভিন্ন গবেষণা, বিশেষ করে নগর পরিকল্পনা, নগরনীতি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার কাজগুলোকে স্মরণ করতে হবে। একই সঙ্গে মনে করতে হবে স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত কাজ। স্থানীয় সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দিক, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর অনেক ভালো কাজ আছে।

তিনি একজন ভালো প্রশাসক ও ভালো প্রাতিষ্ঠানিক নেতা। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। তিনি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিকাশ ঘটেছে তাও স্মরণ করতে হবে। তিনি একজন নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন। তাকে আমরা অনেক চেষ্টা করেও অর্থনীতি সমিতির সভাপতি বানাতে পারিনি। আমিরুল ইসলাম চৌধুরী নিঃসন্দেহে একজন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক। খুবই যোগ্য প্রশাসক, মেধাবী নীতি প্রণেতা ও নীতি বিশ্লেষক হিসেবেই তাকে স্মরণ করতে হবে।

আরো দুটি বিষয় স্মরণ করার আছে। প্রথমত, তিনি ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি চেয়ারম্যানের পদটি ছেড়ে দেন। এটা লক্ষণীয় বিষয়, স্বাধীন পেশাজীবী মনোভাবের লোকেরা সৎভাবে দায়িত্ব পালন করতে চাইলেও রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে অনেক সময় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, সেটি তার সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদে থাকা বা ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে তার নাম স্মরণ থাকবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাজারে বিরাট উত্থান ঘটে। বিভিন্ন ধরনের নিম্নমানের প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে নিবন্ধন পায়। দাম নিয়ে কারসাজি হয়, ফটকাবাজি হয়। এমনকি পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনার ভেতরে বাইরে বড় ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজি হয়। এ কারসাজিকে উদ্ঘাটন করার জন্য সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে দেয়া হয় অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম চৌধুরীকে।

তিনি ও তার সহযোগীরা তিন-চার মাস প্রচুর পরিশ্রম করে নিষ্ঠার সঙ্গে ১৯৯৭ সালের মার্চে বিভিন্ন বিষয়কে তদন্ত করে গ্রন্থবদ্ধ করে একটি রিপোর্ট জমা দেন। যে রিপোর্টটি দিলেন সেটি নিঃসন্দেহে একটি সৎ প্রচেষ্টার অংশ ছিল। সাহসী রিপোর্ট ছিল। আগামী দিনে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতির লক্ষ্যে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা ছিল। সেহেতু পেশাজীবী হিসেবে তার সবচেয়ে সর্বোচ্চ অবদানের কথা আমি স্মরণ করি, তাহলে অবশ্যই এ তদন্ত রিপোর্টের কথা মনে করতেই হবে। কিন্তু সে সময় সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি প্রতিবেদনটি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি। আরো বেশি আশ্চর্যের বিষয়, পরবর্তী সময়ে যখন সরকার বদল হয়েছে, সে সরকারও এ তদন্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যদিও তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর বেশকিছু গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সাল নাগাদ তারা সবাই আবার ছাড়া পেয়ে গেল। ১৯৯৭ সালের পুঁজিবাজারের তদন্ত রিপোর্টটি তখন যদি ঠিকমতো কার্যকরী করা যেত, তাহলে পুঁজিবাজারে বর্তমানে যে পরিস্থিতি সেটি ভিন্নও হতে পারত।

কিন্তু তাতে আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর কাজের গুরুত্ব কমে না। সে কারণেই শিক্ষক, গবেষক, প্রাতিষ্ঠানিক নেতা ও একজন সৎ নীতি বিশ্লেষক হিসেবে তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)