Originally posted in আজকের পত্রিকা on 20 December 2021
স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৭১ সালে অক্সফোর্ডে। আবেদ ও তাঁর সঙ্গীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের জন্য লন্ডনে কী ধরনের কার্যক্রম করছেন, সেটি জানাতে উনি আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আরও কীভাবে তাঁদের কার্যক্রমের জোর বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছিলেন আমার কাছে।
স্বাধীনতা অর্জনের পরে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগণের উন্নয়নে কীভাবে কাজ করা যায়, সেটা নিয়েও আগাম চিন্তা ও আলাপ-আলোচনা করেছিলেন তিনি। তখনই তাঁর আত্মনিবেদন এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টির প্রসার দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। আবেদ তাঁদের মতো নন, যাঁরা মুখে বলেন জনগণের জন্য কাজ করবেন, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের এ-সংক্রান্ত তৎপরতা খুব একটা দেখা যায় না। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর গভীর অন্তর্দৃষ্টিময় ও আত্মনিবেদিত আবেদকে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষের সেবায় ভাস্বর হয়ে উঠতে দেখি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোয় যোগাযোগ থাকলেও খুব কমই ভাব বিনিময় হয়েছে আমাদের মধ্যে।
১৯৯৩ সালে যখন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিই, প্রথম যাঁদের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম, আবেদ ছিলেন তাঁদের একজন। তারপর থেকে সিপিডির একজন সক্রিয় বোর্ড সদস্য হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছিলেন তিনি। সিপিডির পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন যেমন, তেমনি অনেক কর্মসূচিতে সিপিডি ও ব্র্যাকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারত্ব গড়তেও উৎসাহ দিয়েছেন। বিদায়ের দিনগুলো ঘনিয়ে এলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সম্পৃক্ততা থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন আবেদ। একইভাবে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে সিপিডি থেকেও অবসর গ্রহণ করেন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদবিহীন এক বাংলাদেশকে কল্পনা করাও আমার জন্য একই রকম কঠিন। দেশের সর্বত্র তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আবেদ এক বৃহত্তর জীবনের পদচিহ্ন রেখে গেছেন। বঞ্চিত মানুষের জন্য বিশ্বে খুব কমসংখ্যক মানুষই আবেদের চেয়ে বেশি করতে পেরেছেন। বাংলাদেশজুড়ে তাঁর অবদান। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক এখন দেশের প্রায় এক কোটি সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের কাছে সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে থাকার জন্য আবেদের দায়বদ্ধতা ব্র্যাককে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের অপরাপর প্রান্তে। শ্রীলঙ্কায় সিডরে বিপর্যস্ত মানুষের পুনর্বাসন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় ব্র্যাক তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়েছে। আফগানিস্তানের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার সময় তাদের দুজন কর্মী তালেবানদের হাতে বন্দীও হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আফ্রিকার রুয়ান্ডা, তানজানিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনের বিস্তীর্ণ এলাকার সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্র্যাকের কার্যক্রম বিশেষ প্রসার লাভ করেছে। এমনকি পাকিস্তান ও আটলান্টিকের দ্বীপদেশ হাইতিতেও ব্র্যাকের কার্যক্রম পৌঁছে গেছে।
বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে আবেদের অসাধারণ কর্মকাণ্ডের সুবাদে ব্র্যাক বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বঞ্চনার শিকার মানুষের কল্যাণে আবেদের একার যে অবদান, তারই সামর্থ্যে বলীয়ান হয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানের আজকের এই সুবিশাল প্রসার ঘটেছে। ক্ষুদ্র পর্যায়ের কল্যাণধর্মী প্রকল্প হিসেবে শুরু হয়ে ব্র্যাক আজ হয়ে উঠেছে পুরো জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক রূপান্তরের রূপকার। এটি আজ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার চেয়েও বেশি কিছু। যে মাত্রায় বর্তমানে এর কার্যক্রমের প্রসার ঘটেছে তাতে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত জনগণের করপোরেট সংস্থায় পরিণত হয়েছে। আবেদের সাংগঠনিক সামর্থ্য ব্র্যাককে অক্সফামের মতো বিশ্বের শীর্ষ বেসরকারি সংস্থাগুলোর একটি হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। ব্যবস্থাপনায় তাঁর অতুলনীয় সক্ষমতার কারণে বিশ্বের ব্যবসায় প্রশাসনবিষয়ক পাঠের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্র্যাককে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আবেদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, বিদেশি অনুদানের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়ে ব্র্যাককে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে তিনি বেশ কিছু কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা করেন, যা থেকে উদ্বৃত্ত আয়ের ব্যবস্থা হবে এবং সেই আয় থেকে ব্র্যাকের অন্যান্য কর্মসূচির অর্থায়ন করা হবে। উপার্জনে সহায়ক এসব প্রকল্পের মধ্যে মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিটি প্রধান। উদ্বৃত্ত অর্থ পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে এর ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ নারী ঋণগ্রহীতা নিয়ে ব্র্যাকের এই কার্যক্রম বিশ্বের বৃহত্তম মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিগুলোর একটি। ব্র্যাক ব্র্যান্ডটির সুনাম এবং বাজার সদ্ব্যবহার করে আবেদ আরও কয়েকটি সামাজিক ব্যবসামুখী আয়বর্ধক কার্যক্রমে বিনিয়োগ করেন। এর মধ্যে রয়েছে বিকাশ এবং ব্র্যাক ব্যাংক, যা ইতিমধ্যে দেশের সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত ও লাভজনক ব্যাংকের মর্যাদা লাভ করেছে। এসব বিনিয়োগ থেকে আরও আয় যোগ হয়েছে, যা ব্র্যাকের অভ্যন্তরীণ উপার্জনের সামর্থ্য বৃদ্ধি করেছে। এরই চক্রবৃদ্ধির প্রভাবে আরও বেশিসংখ্যক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে নিজেদের কর্মসূচিগুলোকে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে ব্র্যাক।
বঞ্চনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আবেদের মধ্যে এক রেনেসাঁ দৃষ্টির উন্মেষ দেখি আমরা, যার বলে তিনি বাংলাদেশে বঞ্চনার সামগ্রিক রূপটি ধরতে সক্ষম হয়েছেন। পরিবর্তন ঘটাতে বহুমুখী সমাধানসংবলিত কৌশলকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন—যার মধ্যে ঋণ, নারীর ক্ষমতায়ন, আইন-সাক্ষরতা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়নের কার্যক্রমকে গেঁথে নেওয়া হয়েছে; যা প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটিয়ে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। বঞ্চনার শিকার জনগোষ্ঠী থেকে নিজভাগ্য নির্মাণের কারিগর হয়ে ওঠার কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন আবেদ। সেটি করতে গিয়ে তিনি এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়লেন, যা নিজেও আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রম গড়ে তুলল এবং সেগুলো বাজার প্রতিযোগিতায় যোগ্যতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে প্রতিষ্ঠানকে দাতাগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিল। ব্র্যাককে আজ আর দাতার উদারতার ওপর নির্ভর করতে হয় না। এর মোট বাজেটের ৮০ শতাংশই আসে নিজস্ব আয় থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রবৃদ্ধি ও রূপান্তরের দরুন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে ব্র্যাক। অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আবেদ তাঁর অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক নেতা, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও করপোরেট বিশ্বের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেছে তাঁর।
স্বদেশে ও বিদেশের বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে জীবনের ৪৭টি বছর ব্যয় করেছেন আবেদ। তাঁর বিনয় ও বিস্ময়কর সব অর্জনের প্রায় নিরুচ্চার উপস্থাপনের মধ্যে এক দৃঢ় মনোভাবের প্রকাশ দেখি আমরা—তিনি চেয়েছেন সহস্র শব্দরাজি নয়, কর্মই তাঁর সাফল্যের কথা বলবে। খ্যাতির লোভ ছিল না তাঁর। কিন্তু বঞ্চিত মানুষের অগ্রপথিক হিসেবে সেই কাজের এতটাই সাফল্য যে আবেদ এবং তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের কাছেই শুধু নয়, বিশ্বনেতা এবং বাণিজ্য নেতাদের কাছেও বিপুলভাবে স্বীকৃত হয়েছেন।
নিজ কর্মের মাধ্যমে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন ঘটিয়ে যে পৃথিবীতে তাঁর জন্ম হয়েছিল, তাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ বিদায় নিলেন আবেদ। খুব কম মানুষের পক্ষেই এতটা তৃপ্তির সঙ্গে জীবন থেকে বিদায় নেওয়া সম্ভব হয়। জানতেন কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যেতে হচ্ছে তাঁকে, কিন্তু নিশ্চিত ছিলেন যে পথ তিনি নির্মাণ করে গেছেন, সে পথ ধরে হেঁটেই উত্তরসূরিরা সেই কাজ শেষ করবেন।
উত্তরপ্রজন্মের জন্য তাঁর শেষ অবদান দেখি তাঁর সুচারু মহাপ্রস্থান পরিকল্পনায়। তাঁর বিদায়ের পরও ব্র্যাক অর্ধশত বছর আগে সিলেটের শাল্লায় সমাজ রূপান্তরের লক্ষ্যে শুরু হওয়া যাত্রা অব্যাহত রাখবে, সে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল আবেদের। বঞ্চনার শিকার মানুষের ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যের অবসান ছিল তাঁর লক্ষ্য। যেদিন অন্তত বাংলাদেশে সেই দিনটির উদয় হবে এবং সেই প্রক্রিয়ায় ব্র্যাক অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করবে, কেবল সেদিনই আবেদের আত্মা শান্তি পাবে।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত। স্যার ফজলে হাসান আবেদ স্মরণে ইংরেজিতে লেখা মূল নিবন্ধটি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।)