২০১২ সালের প্রথম দিকে যে বিষয়গুলো অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক বা বিশ্লেষকদের ব্যস্ত রেখেছিল, এর অন্যতম ছিল ব্যাংক থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ার ফলে ব্যক্তি খাতে ঋণের লভ্যতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা; উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা বছরজুড়েই দুই অঙ্কের ঘরে ছিল; বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং বিশেষ করে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প কম হারে রূপায়িত হওয়া। এ ছাড়া ছিল টাকার বিনিময় হারের ওপর কিছুটা চাপ ও সুদের উচ্চ হার এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের দুর্বলতর অবস্থা। বছর শেষে এসে আমরা দেখছি, এসব আশঙ্কার অনেকগুলোই আগের মতো ভীতিকর অবস্থায় নেই। যেমন সরকার এখন আগের মতো ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছে না। মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমে এসেছে। রপ্তানি হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও আমদানি কম হওয়ায় এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতি কিছুটা জোরদার হয়েছে। টাকার বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল আছে এবং সামান্য হলেও এডিপি ও বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের হার বেড়েছে।
তবে অর্থনীতির এই আপাত স্থিতিশীলতার পেছনেও দুশ্চিন্তার যে বিষয়টি থেকে গেছে, তা হলো বিনিয়োগ চাহিদা এবং বিনিয়োগ-প্রবাহে নিস্তেজ ভাব। যদিও বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ এখনো মন্দ নয় কিন্তু আমরা দেখেছি যে পুঁজিপণ্যের আমদানিতে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নতুন ঋণপত্র খোলার সাম্প্রতিক প্রবণতা থেকেও ধারণা করা যায় যে আগামী কয়েক মাসে এ ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি করার তেমন সুযোগ নেই। সুদের উচ্চ হার, যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপ্রাপ্যতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ ক্ষেত্রের স্থবিরতাকে আরও চেপে ধরেছে। আমদানি কমে যাওয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্লথতা রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আশা ছিল, এ অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। এর ফলে বৈদেশিক সাহায্য যেমন আসবে, বিনিয়োগও বৃদ্ধি পাবে, যা অর্থনীতিতে নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষাটি বাস্তবায়নে এখনো কোনো সুরাহা বা ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে অর্থপ্রবাহ বাড়লেও তা যে সঠিকভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত হচ্ছে না, বা সঠিক ঋণগ্রহীতাদের কাছে যাচ্ছে নাূ হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে তা প্রমাণিত হয়। এর ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রাদুর্ভাব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব অর্থ আদৌ ব্যাংকে কোনো দিন ফিরবে কি না। একই ভাবে প্রশ্ন উঠেছে, আরও কত হলমার্কের মতো ঘটনা অপ্রকাশিত রয়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে এবং কিছুটা হলেও এতে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। একই ভাবে ডেসটিনির মতো এমএলএম সম্পর্কিত ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে, সরকার সময়মতো জনস্বার্থে আইনি উদ্যোগ নিতে তৎপর ছিল না। এর ফলে অতি মুনাফার লোভে ধাবিত আমানত গচ্ছিতকারীরা কীভাবে শেষ পর্যন্ত সুরক্ষা পাবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে এ বছর বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হলেও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ এবং বাজারের স্বাচ্ছন্দ্য ভাব ফিরে আসেনি।
এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, বর্তমান সরকারের বিগত চার বছরে মূল সাফল্যের জায়গাটা হলো কৃষি উপকরণ বিতরণব্যবস্থা সমস্যামুক্ত রেখে উৎপাদন অব্যাহত রাখা; খাদ্য-ব্যবস্থাপনা সংহত করা; এবং গ্রামীণ দরিদ্র ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা-বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি করা। আশা করব ২০১৩ সালে তা অক্ষুণ্ন থাকবে।
কৃষি খাতে এ সাফল্যের বিপরীতে বিগত চার বছর সবচেয়ে দুশ্চিন্তার জায়গায় রয়ে গেছে জ্বালানি খাত। বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও উৎপাদন-ক্ষমতার একটি বড় অংশ এই সময়ে বন্ধ থেকেছে। এর ফলে উৎপাদন চাহিদা ও জোগানের ইতিবাচক ভারসাম্যে দৃশ্যমান কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি এই উল্লেখযোগ্য বর্ধিত বিদ্যুৎ। উপরন্তু প্রস্তাবিত বড় মাপের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো স্থাপনে কোনো কার্যকর অগ্রগতি না হওয়ায় ব্যয়বহুল ভাড়াটে কেন্দ্রগুলো জনগণ ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছে। সরকার সঠিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি বহুধাকরণ নীতি ঘোষণা করলেও দেশজ কয়লা ব্যবহারের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি সাধন করতে পারেনি। উপরন্তু উচ্চমূল্যে আমদানিকৃত জ্বালানির ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এসব বিষয় বিনিয়োগ তথা সরকারের সার্বিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই সামগ্রিক বিচারে ২০১২-১৩ অর্থবছরে মূল চ্যালেঞ্জটাই হবে বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে নির্জীব ভাব এবং যেসব আস্থাহীনতার লক্ষণ রয়েছে সেগুলো কাটিয়ে তুলে উৎপাদন-ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর জন্য একই সঙ্গে সরকারের নিজস্ব বিনিয়োগ, স্থানীয় বেসরকারি খাত ও বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ_ তিন জায়গাতেই আরও মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে অর্থনীতি যে আপাত স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে, তা বজায় থাকা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যাবে। এর ফলে দুর্বল হয়ে পড়বে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় অর্জন।
মনে রাখতে হবে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৬.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটলেও ২০১০-১১-তে কিছুটা হলেও কমে যায়। এ অর্থবছরে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এটি ছয় শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। অর্থাৎ পর পর দুই বছর প্রবৃদ্ধির হারে সামান্য হলেও পতন ঘটবে। প্রবৃদ্ধির ধারাকে যদি সাত বা আট শতাংশে ধাবিত না করা যায়, তাহলে আপাত অর্জিত প্রবৃদ্ধি নাজুক হয়ে পড়বে এবং পুরনো সমস্যাগুলো আবার ফিরে আসতে পারে। ২০১৩ সালে উৎকণ্ঠার বিষয়টি হচ্ছে, ঘনীয়মান রাজনৈতিক বৈরী পরিস্থিতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আদৌ কল্যাণকর নয়। তাই জাতীয় উন্নতির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা নির্বাচন তথা রাজনীতির ক্ষেত্রে যদি কোনো সহমত খুঁজে না-ও পাই, তাহলেও আমি মনে করি, অর্থনীতিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি ঐকমত্যের জায়গা খুঁজে বের করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ২০১৩-তে যেন আমরা দ্রুতই সেই জায়গাটিতে পৌঁছাতে পারি, এটিই আমার সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা।