Originally posted in jagonews24 on 22 April 2021
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অর্থনীতিবিদ ও গণনীতি বিশ্লেষক। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইস ফেলো ও প্রথম নির্বাহী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এবং জাতিসংঘেও।
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) দ্বিতীয় ঢেউ, ফের লকডাউন, জনজীবন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। মহামারি মোকাবিলার যে ব্যবস্থাপনা, তাতে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মত দেন এই বিশ্লেষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
করোনাকালে দেশে নতুন করে দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন এবং এ হার হু হু করে বাড়ছে বলে সিপিডির জরিপে উঠে এসেছে। কর্মহীন হয়ে পড়ছে অসংখ্য মানুষ। কী ঘটতে যাচ্ছে মানুষের ভাগ্যে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ধাক্কায় মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। প্রথম ধাক্কা থেকে সামলে অনেকেই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসছিলেন। বিশেষ করে নিম্ন এবং ছোট ছোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন, তাদের জীবন এক প্রকার অনিশ্চয়তায় পড়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে যারা আয় করে বেঁচে থাকতেন, তাদের পুঁজি কম, দায়-দেনা বেশি। শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়। এখন সব বন্ধ হয়ে গেল। তাদের উপায় কী এখন? সামনে ঈদ।
উপায় নিয়ে কী বলা যেতে পারে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এটি খু্ব পরিষ্কার যে, সরকারের পক্ষ থেকে যদি আর্থিক সহায়তা না আসে, তাহলে এই শ্রেণীর মানুষদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। আর তারা দরিদ্র মানুষে পরিণত হয়ে যাবে।
সরকার কিন্তু আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করছে…
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আর্থিক সহায়তার ব্যাপারে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার, তা সঠিক হলেও যথেষ্ট নয়। মূলত এই মানুষগুলোর প্রতি সরকারের নজর সেই অর্থে নেই।
নতুন করে যারা দরিদ্র হচ্ছেন অর্থাৎ নিম্ন আয়ের মানুষ, নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের জন্য আর্থিক সহযোগিতার বিষয় আমরা সেই অর্থে লক্ষ্য করিনি। যে ঋণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তা এদের কোনো কাজে আসছে না। ঋণ নিয়েও নানা অসঙ্গতি, পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছি।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এই মানুষদের ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো তথ্যভাণ্ডার নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া আর কোনো তথ্য নেই, যার মাধ্যমে এসব মানুষকে চিহ্নিত করে সহযোগিতা করা যায়।
কীভাবে তথ্য সংগ্রহ বা সহায়তা মিলতে পারে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: জাতীয় পরিচয়পত্র তো আছেই। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থা তৃণমূলের মানুষদের নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন এনজিও’র কাছে তথ্য আছে। চাইলেই সমন্বয় করে ঈদের আগে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা করা সম্ভব।
করোনা মহামারির শুরু থেকেই এমনটি বলে আসছেন আপনারা। অথচ এক বছর কেটে গেল। সরকার সমন্বয় করতে পারল না, তথ্য সংগ্রহ করতে পারল না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতীয় উদ্যোগে সরকারের এক প্রকার অনীহা আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। গত বাজেটের আগে আমরা মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার কথা বলছিলাম। অথচ বাজেট আলোচনা এবং পরিকল্পনা কমিশনের কথায় মনে হচ্ছিল, দুই-তিন মাসের মধ্যে সংকট কেটে যাবে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই আমাদের ফের লকডাউনের কবলে পড়তে হলো।
সরকারে রাজনৈতিক অস্বীকারের মনোভাব আছে। এটি আমাদের সংকট মোকাবিলায় আরও জটিল পরিস্থিতিতে ফেলছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেও রাজনৈতিক অস্বীকৃতি, এটি জাতির জন্য এক প্রকার ব্যর্থতা কি-না?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: জাতীয় সংকট মোকাবিলা করতে হয় জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়েই। আমার মনে হয় সরকার এখানে এক ধরনের বাধার মধ্যে আটকে আছে। সরকার নিতান্তই প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে চলছে। এর সুবিধা-অসু্বিধা দুটোই আছে। সরকার তার নিজস্ব দলকেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবহার করতে পারেনি। এটি সংকট মোকাবিলায় শুভ লক্ষণ নয়।
বেসরকারি অনেক উন্নয়ন সংগঠন মাঠ পর্যায়ে ছিল, আছে। অথচ সরকার তাদেরও কাজে লাগায়নি বা তাদের কাছ থেকেও তথ্য নেয়নি। এই মনোভাব জাতীয় জীবনে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখি।
লকডাউন বাড়ছে। করোনার প্রভাব যদি আরও বাড়ে এবং সরকারের এই সমন্বয়হীনতা যদি থেকেই যায় তাহলে কি সংকট আরও…
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি মনে করি না এটি সমন্বয়হীনতার সমস্যা। এটি এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভঙ্গির সমস্যা বলে মনে করি। এই সমস্যা রাজনৈতিক চিন্তা থেকে প্রণোদিত। এটি বাস্তবের আলোকে নয়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো দরকার। এতে সরকার কোনোভাবেই ছোট হবে না। বরং সরকার আরও লাভবান হবে। সরকার আরও কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নিতে পারবে।
করোনার ধাক্কায় চার লাখ প্রবাসী শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন বলে সিপিডির জরিপে প্রকাশ পেয়েছে
এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে বার্তা আসতে হবে, যেন প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল মিলে দেশের সমস্ত শক্তিগুলোকে একত্রিত করে কাজ করাতে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো প্রকার সাংগঠনিক কাঠামো নেই। প্রশাসনিক কাঠামো নেই। সম্পদ সংগহ করার জন্য কোনো নীতিমালা নেই। সামগ্রিক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা সময়ের দাবি ছিল।
ক্রমান্বয়ে সরকারের বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। আবার করোনার কারণে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে তো সরকারকে বিকল্প উপায়ে সম্পদ বাড়াতে হবে। আমরা বারবার বলছি, ‘জাতীয় সংহতি তহবিল’ তৈরি করা উচিত। যেন বেসরকারি খাত, ব্যক্তি খাত থেকে মানুষ সেখানে সহযোগিতা করতে পারে। সরকার এখানে মধ্যস্থতা করবে। চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। এটি মনোভঙ্গির ব্যাপার।
চার লাখ প্রবাসী শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন বলে সিপিডির জরিপে প্রকাশ পেয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কী বলবেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমাদের জরিপে দুই ধরনের পিছিয়ে পড়া মানুষের বিষয় উঠে এসেছে। একটি হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা শ্রেণী, আরেকটি হচ্ছে ফিরে আসা অনাবাসী শ্রমিকরা। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে নতুন ঘটনা বলে মনে করি। ব্যয়ের ক্ষেত্রে, খাদ্যের ক্ষেত্রে সংকোচন আসছে বিভিন্নভাবে। তারা ঘরের সম্পদ বিক্রি করে পরিস্থিতি সামলে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন অনেকটাই অনির্দিষ্ট হয়ে গেছে। তারা বিদেশে যাবেন, নাকি দেশের ভেতরে নতুনভাবে শুরু করবেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে সরকার যে ধরনের সহায়তা করছে, তা ফলপ্রসূ কোনো কাজ বলে মনে হয়নি।