Originally posted in দেশ রুপান্তর on 30 May 2021
অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট, করোনাকালের অর্থনীতিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর: জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে আগামী ৩ জুন। বৈশি^ক এই করোনা মহামারীকালে বাজেট কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: করোনার সময়ে এটা দ্বিতীয় বাজেট। করোনার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলো আমাদের সামনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলে আসছে, সেসব বিষয় বাজেটে এবার প্রাধান্য পাবে। এক্ষেত্রে ২০২০-২১ এর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া আমাদের অর্থনীতির যে পুনরুজ্জীবন, সেটাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। এই তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েই এবারের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। এটা করতে গিয়ে বাজেটের যে পাঁচটি দিক রয়েছে সম্পদ আহরণ, সম্পদের বিতরণ, ঘাটতি অর্থায়ন, বাজেট বাস্তবায়ন ও সংস্কার এগুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। সম্পদ আহরণের দিকটি, আমি মনে করি, প্রত্যক্ষ কর আহরণের দিকে ক্রমান্বয়ে বেশি নজর দিতে হবে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, ডিজিটাল ইকোনমি, আমরা যেসব জায়গা থেকে কর আহরণ করি সে-সবের সমন্বয় করা, ব্যাংক, এনবিআর এবং আমদানি পর্যায়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। তাছাড়া টাকা পাচার রোধেও নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। এই কভিডের সময়ে আয়বৈষম্য, ভোগবৈষম্য, সম্পদবৈষম্য বেড়েছে। এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। আমরা দেখেছি ২০২০-২১-এ আমাদের প্রাক্কলনের চেয়ে রাজস্ব আয় কম হয়েছে। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিমত্তা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এনবিআরকে তাদের লোকবল ও ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে। যাতে প্রত্যক্ষ কর আরও বেশি আদায় করা যায়, সে চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া যে সব জায়গায় অপ্রদর্শিত আয় রয়েছে, সেসব কী উপায়ে বন্ধ করা যায় তার দিকে নজর দেওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর: ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সবচেয়ে বড় ঘাটতির বাজেট হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হবে এবার। এই বিপুল আয়তনের বাজেট ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে? এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
মোস্তাফিজুর রহমান: আমাদের দেশে যে বিপুল জনসংখ্যা, সেই হিসেবে যদি ধরি, তাহলে এটি বড় বাজেট নয়। মাথাপিছু হিসেব করলে বাজেট তখন আর বেশি মনে হবে না। এই ৬ লাখ কোটির বাজেটকে যদি মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির নিরিখে ধরি, তাহলেও দেখতে পাব, এটি খুব বড় বাজেট নয়। জিডিপির হিসেবে ধরলেও এই বাজেট হবে জিডিপির ১৮ শতাংশের মতো। আমাদের প্রতিবেশী অন্য দেশে এটি ২৪ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। তাই বাজেট বড়, এটা কোনো বিষয় নয়। আমাদের রাজস্ব ব্যয় রয়েছে, উন্নয়ন ব্যয় আছে সবমিলিয়ে আমার কাছে এটি বড় বাজেট মনে হয় না।
কথা হচ্ছে, আমরা যেহেতু কর আদায় কম করছি, তাই ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। তবে এবার কভিডের সময়ে সাধারণ সময়ের চেয়ে কর আদায় আরও কিছুটা শ্লথ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যেহেতু মন্দাভাব রয়েছে, তাই ঘাটতিটা হতে পারে। তবে ঘাটতি যদি সাড়ে ৬ শতাংশও হয়, তাহলেও আমি দুশ্চিন্তা দেখছি না। ঘাটতির অর্থায়নটা আমরা ৩টি সূত্র থেকে পূরণ করতে পারি। প্রথমটি হলো সরকার যে বিভিন্ন বন্ড বিক্রি করে তার মাধ্যমে, দ্বিতীয় ব্যাংক ঋণ থেকে এবং তৃতীয় হলো বৈদেশিক সাহায্য থেকে। ঘাটতি অর্থায়নের বিষয়টি বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর হলে অর্থনীতির জন্য ভালো। সমস্যা হলো আমাদের যেহেতু বাজেটে ঘাটতি থাকছে, তবে আবার ব্যয় ঠিকমতো করতে পারছি না। তাই ঘাটতি শেষ পর্যন্ত অতটা থাকছে না। তাই আমাদের ব্যয় করতে হবে সাশ্রয়ের সঙ্গে, সময় মতো এবং সুশাসনের সঙ্গে। আমাদের ব্যয়ের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। এবারও কভিডের সময়ে আমরা প্রথম নয় মাসে দেখলাম মাত্র ৪০ শতাংশ খরচ হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে আমরা ব্যয় করতে পারছি না, তাই ঘাটতি বাজেট নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এখন যেটি করতে হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন কর্মসূচি ব্যাপক আকারে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি মেগা প্রকল্প যেগুলো রয়েছে, সেগুলো শেষ করতে হবে। তবে নতুন করে প্রকল্প হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানী হতে হবে। যে সব প্রকল্প ব্যক্তি খাতকে উৎসাহী করবে, যেগুলো শ্রমঘন, অবকাঠামো উন্নয়নে কাজে লাগবে, গ্রামীণ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে সেসব প্রকল্পে মনোযোগ দিতে হবে। করোনা মহামারীতে অনেক লোক কাজ হারিয়েছে। তাই কর্মসংস্থানের পুনরুজ্জীবনে গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য সরকারি বিনিয়োগ করতে হবে। আবার ব্যক্তি খাতকে যাতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করে সেদিকে নজর দিতে হবে।
দেশ রূপান্তর: বাংলাদেশ তো বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভালো করছে। এই ফলাফল যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে সেজন্য টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। আগামী বাজেটে এই সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা কীভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে?
মোস্তাফিজুর রহমান: বাংলাদেশে এসডিজির সপ্তম বছর যাচ্ছে। আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন আর্থসামাজিক সূচক যেমন খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জন, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুহার কমিয়ে আনা, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধিতে আমরা ইতিবাচক অবস্থানে ছিলাম। এই চলমান করোনা মহামারীর প্রভাবে এসব অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে আমাদের যে অর্জন হয়েছিল, সেসব যে বাধাগ্রস্ত হলো এখন সেসব কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে তা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ প্রান্তিক মানুষ যাতে সুফল পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের যে ধারাবাহিক অগ্রগতি ছিল, যেটি কভিডের কারণে পিছিয়ে গেছে তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়ে এসডিজিতে আমাদের সূচক ছিল ১০। মহামারীতে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে নানা বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
দেশ রূপান্তর: বৈষম্য কমিয়ে আনার সূত্র ধরেই বলছি, গত কয়েক বছর দেশে অর্থপাচার বেশ আলোচিত হচ্ছে। অর্থপাচারের সঙ্গে বৈষম্য বাড়ার যোগসূত্র আসলে কতটুকু?
মোস্তাফিজুর রহমান: অর্থপাচারে বৈষম্য অবশ্যই বাড়ে। কয়েকটি পর্যায়ে বৈষম্য হয়। যে পরিমাণ অর্থ একজন পাচার করছে, সেটির ক্ষেত্রে পাচারকারী হয়তো ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে অথবা কোনো দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতি করলে তিনি হয়তো সাধারণ মানুষকে ঠকিয়েছেন বা ঘুষ নিয়েছেন। যেমন বিদ্যুতের লাইন পেতে একজন যদি একশো টাকাও ঘুষ দেয়, সেটি তার আয় থেকে কমল। আর যিনি ঘুষ নিলেন তার আয় বাড়ল। এভাবেই বৈষম্যটা হয়। দুর্নীতি হচ্ছে বৈষম্যের একটি বড় উপায়। কারণ, দুর্নীতি যে করছে সে সাধারণ লোকের পকেট কাটছে। ২০১০ এবং ২০১৬-তে আমাদের বিবিএস যে খানা জরিপ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে আয়ের বিবেচনায় দেশের সর্বোচ্চ ৫ ভাগে এবং সর্বনিম্ন ৫ ভাগে অবস্থানকারীদের মধ্যে যে বৈষম্য সেটি ২৩ গুণের জায়গায় ১২১ গুণ হয়ে গেছে। দুর্নীতিটা যখন হয় তখন এক ধরনের বৈষম্য হয় ধনী-গরিবের মধ্যে। আবার যখন সে টাকাটা দেশের বাইরে চলে যায় তখন আবার আরেকটা বৈষম্য হয়। যদি টাকাটা দেশে থাকত, এখানেই বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগটাও থাকছে না। অর্থপাচারের অভিঘাত সমাজের ওপরে বিভিন্নভাবে পড়ছে।
দেশ রূপান্তর: আগামী বাজেটে কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ করারোপের দাবি উঠেছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন? এর প্রভাব কেমন হবে?
মোস্তাফিজুর রহমান: যেখানে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয়ের সুযোগ রয়েছে সে জায়গায় সরকারের নজর দেওয়া উচিত। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইন করতে হবে, যাতে এসব না ঘটে। এ বছর সরকার কত টাকা পেয়েছে কালোটাকা সাদা করে? সবমিলিয়ে হয়তো ১৪০০ কোটি টাকার মতো হবে। এতে করে যারা সৎভাবে সরকারকে টাকা দিচ্ছে, তাদের কাছে একটা বার্তা যাচ্ছে। যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলে আমি মনে করি। এখন শেয়ার বাজারে এ সুযোগ কেন দেওয়া হবে? তাহলে গরিব মানুষের ট্যাক্স আরও কমিয়ে দেওয়া হোক।
দেশ রূপান্তর: করোনার সময়ে এই বাজেটে অগ্রাধিকার খাত কোনগুলো হওয়া উচিত?
মোস্তাফিজুর রহমান: আমাদের এবারের বাজেটে অগ্রাধিকার দিতে হবে সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান। এসব ক্ষেত্রে যেসব প্রণোদনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। আর যেটি করতে হবে সংস্কারের কাজ করতে হবে। অনেকদিন ধরেই আমাদের রাজস্ব সংস্কার করা হয় না। প্রত্যক্ষ কর আইন, শুল্ক আইন এসব বিষয়ের আইনগুলো সংস্কার করতে হবে। অনেকদিন ধরেই আমরা এসব অর্ধেক করে রেখেছি, এসব দ্রুত সংস্কার করার বিষয়ে তাগিদ দিতে হবে। ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুন বাজেটে এসব বিষয়কে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বাস্তবায়নের একটি সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।
দেশ রূপান্তর: বাজেট নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
মোস্তাফিজুর রহমান: সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, এখন অপ্রত্যক্ষ করের পরিমাণ যদি কিছুটা কমিয়ে আনা যায়, তবে সাধারণ লোকজন তার সুবিধা পাবে। কর আদায়ের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত করতে হবে। তবে তা করতে গিয়ে যেন সাধারণের ভোগান্তি বৃদ্ধি না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কারগুলো করতে হবে। কম আয়ের মানুষদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য গত বাজেটে যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, এটি এবারও অব্যাহত রাখতে হবে। কিছু কিছু ভোগ্যপণ্য রয়েছে, সে সবের ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনতে হবে। তাতে করে কিছুটা সাশ্রয় হবে সাধারণ লোকজনের। আর সর্বোচ্চ করের হার যেটি শুরুতে ৩০ শতাংশ ছিল, পরে সেটি কমিয়ে ২৫ করা হয়েছিল, আমার মনে হয় এটি আবার ৩০ শতাংশ করা উচিত। কারণ, এটি ছিল অধিক আয় যারা করেন তাদের জন্য। এছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু বৃদ্ধি করাই নয়, এর ব্যবস্থাপনায়ও গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া ডিজিটাল ডিভাইসসহ, ইন্টারনেট খাতের ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে আনতে হবে।