কালো টাকা জমা রাখার জন্য গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার হচ্ছে

Originally posted in বণিকবার্তা on 25 June 2024

ঊর্ধ্বতন চাকরিজীবী ও গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাব ফুলেফেঁপে উঠছে

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের (ফ্রিজ) আদেশ দেন আদালত। যদিও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান বলছে, ফ্রিজ করার আগেই ৩৩টি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় শত কোটি টাকা নগদে উত্তোলন করে সপরিবার দেশ ছেড়েছেন বেনজীর। আর এসব অর্থ ব্যাংকে জমা হয়েছিল গত এক দশকে। তিনি এ সময় র‌্যাব মহাপরিচালক ও পুলিশ মহাপরিদর্শকের মতো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বেনজীরের মতোই তীব্র সমালোচনার মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান বিদেশে পালিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত সরকারি এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকা উপার্জনের অভিযোগ উঠছে। সেই অর্থে জমি, গাড়ি, বাড়ি কেনার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কোম্পানির মালিক হয়েছেন তিনি। দুদক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্র বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোয় মতিউর রহমান, তার দুই স্ত্রী ও সন্তানদের নামে শত কোটি টাকার বেশি জমা ছিল। গত কয়েকদিনে এসব অর্থের বড় অংশই তুলে নেয়া হয়েছে।

বেনজীর আহমেদ ও মতিউর রহমান—এ দুজনই ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। বহু বছর ধরে তারা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে আসছেন। ব্যাংক হিসাব খোলার সময় নিজেদের ‘সার্ভিসহোল্ডার’ বা চাকরিজীবী বলে পরিচয় দিয়েছেন। আর তাদের স্ত্রীদের পেশা দেখিয়েছেন ‘গৃহিণী’। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ তারা ব্যাংকে সঞ্চয়ী কিংবা মেয়াদি আমানত হিসাবে জমা রেখেছেন। এনবিআর সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আয়কর রিটার্নে নিজেদের আয়ের উৎস ও সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। ব্যাংক হিসাবে থাকা নগদ অর্থের পূর্ণাঙ্গ তথ্যও তারা দেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোয় এখন চাকরিজীবীদের ব্যাংক হিসাবে জমা আছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা, যা ব্যক্তি খাতের আমানতের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা আছে মেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) হিসাবে। ব্যাংকগুলোয় তৃতীয় সর্বোচ্চ আমানত আছে গৃহিণীদের। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৭ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ছিল মেয়াদি আমানত। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও কয়েক বছর ধরে চাকরিজীবী ও গৃহিণীদের আমানত ক্রমেই বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিদ্যমান বেতন কাঠামো অনুযায়ী সর্বোচ্চ ধাপের চাকরিজীবীরা যে বেতন ভাতা পান, সেটি দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করাই দুরূহ। মাস শেষে সাধারণ চাকরিজীবীদের হাতে উদ্বৃত্ত কোনো অর্থ থাকে না। বরং তাদের একটি বড় অংশ ক্রেডিট কার্ড বা বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ করে চলছেন। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোয় চাকরিজীবীদের যে আমানত জমা হচ্ছে, সেগুলো সরকারি-বেসরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘অবৈধভাবে’ উপার্জিত অর্থ। এ শ্রেণীর কর্মকর্তারা স্ত্রী, মা, বোনসহ নিকটাত্মীয়দের নামেও ব্যাংকে টাকা রাখছেন। এতে ঊর্ধ্বতন চাকরিজীবীদের পাশাপাশি ফুলেফেঁপে উঠছে গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবের আমানতও।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলছেন, দুর্নীতি এখন শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ ব্যাধি সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি এমন কোনো খাত অবশিষ্ট নেই, যেটি দুর্নীতিমুক্ত আছে। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা ফেরত দিচ্ছেন না, রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ বহু ধরনের অভিযোগ উঠছে। শিক্ষা ভবন কিংবা শিক্ষা বোর্ডগুলোয় শত শত কোটি টাকার ঘুস দুর্নীতি হচ্ছে। পিএইচডির নামে ভুয়া গবেষণা হচ্ছে। এগুলো সবই দুর্নীতির মধ্যে পড়ে। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ নানাভাবে ব্যয় হচ্ছে। কেউ বাড়ি-গাড়ি কিনে ভোগ-বিলাসে ব্যয় করছে। কিছু অর্থ ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা থাকবে সেটিও অস্বাভাবিক নয়।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে মোট সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৯ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলেন ১ লাখ ৭০ হাজার ১৮৯ জন। বাকিরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মূল বেতন (নবম গ্রেড) এখন ২২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫৩ হাজার ৬০ টাকা। আর গ্রেড-১ বা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ পুলিশের আইজিপি হিসেবে বেনজীর আহমেদ মূল বেতন পেতেন ৭৮ হাজার টাকার মতো। অন্যান্য ভাতাসহ সরকারের গ্রেড-১ ভুক্ত কর্মকর্তারা ১ লাখ টাকা বেতন পেয়ে থাকেন।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সচিব পদমর্যাদার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ গ্রেডে চাকরি করেও মাস শেষে যে বেতন-ভাতা পাই সেটি দিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা খুবই কঠিন। মাসের ২০ দিন যাওয়ার আগেই বেতনের টাকা শেষ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয় করার মতো উদ্বৃত্ত অর্থ থাকার প্রশ্নেই আসে না। নিচের সারির সরকারি কর্মচারীরা যে বেতন পান, সেটি দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর কথা নয়। অথচ আমরা দেখছি, গুলশান-বনানী কিংবা পূর্বাচলের প্লট, ফ্ল্যাটের প্রধান ক্রেতা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তার ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছার কারণেই সমাজে কালো টাকার দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের (লেবার ফোর্স সার্ভে) তথ্য অনুযায়ী, দেশে চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের গড় মাসিক বেতন মাত্র ১৩ হাজার ৬৬৯ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পদে (ম্যানেজার) নিয়োজিত চাকরিজীবীরা মাসে গড়ে ৩৬ হাজার ১৩৯ টাকা বেতন পান। পেশাজীবীদের মাসিক গড় মজুরি ২১ হাজার ১৮৭ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত নিম্ন মজুরিতে চাকরি করা একজন কর্মজীবীর পক্ষে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন। বিদ্যমান বাস্তবতায় সাধারণ চাকরিজীবীদের অনেকে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। চাকরিজীবীদের ব্যাংক হিসাবে যে আমানত স্থিতি দেখা যাচ্ছে, সেটি সাধারণ চাকরিজীবীদের নয়। সরকারি-বেসরকারি উচ্চ পর্যায়ে চাকরি করা ব্যক্তিদের অবৈধ অর্থই ব্যাংক হিসাবে আমানত হিসেবে সঞ্চিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অবৈধ আয়ও ব্যাংকে জমা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় মোট হিসাব সংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ২২৭। এসব হিসাবে ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল। এর মধ্যে সরকারি খাতের ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭০৮টি ব্যাংক হিসাবে আমানত ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার ৯০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব ছিল ১ কোটি ৫৮ লাখ ২৩ হাজার ৮৬টি। এসব হিসাবে জমাকৃত আমানতের স্থিতি ছিল ৫ লাখ ১৯ হাজার ৫২ কোটি টাকা। ব্যাংক হিসাবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪ কোটি ৬ লাখ ২১ হাজার ৪৩৩টি হলো ব্যক্তি খাত বা ব্যক্তিগত। এসব ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত আমানতের স্থিতি ছিল ৯ লাখ ৫১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যক্তি শ্রেণীর আমানতকারীদের মধ্যে ২৫ লাখ টাকার বেশি আমানত আছে এমন ব্যাংক হিসাব ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯টি। এসব হিসাবে জমা আছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৬২২ কোটি টাকার আমানত, যা ব্যক্তি শ্রেণীর মোট আমানতের ৩৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। একজন সাধারণ চাকরিজীবীর পক্ষে ব্যাংক হিসাবে ২৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয় করা খুবই কঠিন বলে মনে করা হয়।

চাকরিজীবীদের পাশাপাশি অস্বাভাবিক হারে আমানত জমা হচ্ছে গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবে। চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোয় গৃহিণীদের নামে জমা ছিল ২ লাখ ১ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার আমানত। পরিমাণের দিক থেকে তা দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের আমানতের কাছাকাছি। মার্চ পর্যন্ত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ব্যাংক হিসাবে মোট আমানত ছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। তবে আমানতের প্রবৃদ্ধির দিক থেকেও দেশের ব্যবসায়ী, প্রবাসী, শিল্পপতি, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীদের চেয়ে গৃহিণীরা এগিয়ে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের মার্চে গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত তাদের আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৮৬ শতাংশ।

যদিও বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা ও জরিপ বলছে, দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ নারীর কাছে এখনো ব্যাংক সেবা পৌঁছেনি। শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের বিচারেও দেশের নারীরা এখনো বেশ পিছিয়ে। আবার যৌক্তিক মজুরির ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে অধিকার নিয়েও শোনা যায় নারীর বঞ্চনার অনেক অভিযোগ। উদ্যোক্তা হিসেবে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা ব্যাংকগুলোর বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ রয়েছে। এত অপ্রাপ্তি, বৈষম্য, বঞ্চনা ও উপেক্ষার গল্পের বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ব্যাংকে গৃহিণীদের গচ্ছিত আমানতে।

গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবে থাকা আমানতের পরিমাণ অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গৃহিণীদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বেশ ভালো। সংসারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে তারা দক্ষতার পরিচয় দেন। প্রতি মাসের সঞ্চয় থেকে তারা ব্যাংকে কিছু অর্থ জমা রাখতে পারেন। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থ গৃহিণীদের নামে ব্যাংকে জমা আছে, সেটি একেবারেই অস্বাভাবিক। কোনোভাবেই গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবে লাখ লাখ কোটি টাকা জমা থাকা সম্ভব নয়। তার মানে কর ফাঁকি দেয়া কিংবা কালো টাকা জমা রাখার জন্য গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার হচ্ছে। এটি একেবারেই পরিষ্কার। এজন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই।’

ব্যাংকে হিসাব খোলার জন্য গ্রাহকদের কেওয়াইসি (নো ইয়োর কাস্টমার) ফরম পূরণ করতে হয়। এতে নির্ধারিত কলামে গ্রাহকের পেশা উল্লেখ থাকে। বিবাহিত যেসব নারী শুধু ঘরদোর সামলান তারা কেওয়াইসিতে নিজেদের পেশার স্থলে হাউজওয়াইফ বা গৃহিণী উল্লেখ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, যেসব নারী চাকরি করেন তাদের আমানতের হিসাব চাকরিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। আবার নারী শিক্ষার্থীদের আমানত জমা হয় স্টুডেন্ট হিসেবে। নারী উদ্যোক্তাদের আমানতও দেখানো হয় ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে। গৃহিণী হিসেবে কেবল তাদেরই দেখানো হয়, যারা আয়বিহীন এবং অর্থের জন্য স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত আমানতের সামান্য অংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত গৃহিণীদের। এ শ্রেণীর গৃহিণীদের আমানতের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। বাকি দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি আমানত দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বেগমদের। পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, উচ্চ পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও বিভিন্ন উপায়ে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থবিত্তের মালিকদের বেগমরাই ব্যাংকে এ পরিমাণ অর্থ জমা করেছেন।

ব্যাংকে মেয়াদি আমানত জমা রাখার ক্ষেত্রেও গৃহিণীরা এগিয়ে রয়েছেন। গত মার্চ শেষে গৃহিণীদের মেয়াদি আমানতের পরিমাণ ছিল ৯৭ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর বড় অংশের মেয়াদ তিন থেকে ছয় মাস। মেয়াদ ছয় মাসের কম এমন আমানতের পরিমাণ ৫১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদি আমানত আছে ৯ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এছাড়া গৃহিণীদের এক-দুই বছর মেয়াদি ১৭ হাজার ৩৩ কোটি, দুই-তিন বছর মেয়াদি ২ হাজার ২৪৪ কোটি ও তিন বছরের বেশি মেয়াদি ১৭ হাজার ৩১৯ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত গৃহিণীদের সঞ্চয়ী হিসাবেও ৭১ হাজার ৬০ কোটি টাকার আমানত জমা ছিল।

একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও শাখা ব্যবস্থাপক জানান, আয়কর রিটার্ন জমা দেন এমন শ্রেণীর সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের অনেকে সম্পদ গোপন রাখার জন্য নিজেদের স্ত্রী, মা ও সন্তানদের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা রাখেন। আবার অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুস লেনদেনের ক্ষেত্রেও অনেকে পরিবারের নারী সদস্যদের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেন। মূলত এ কারণেই গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবে এত পরিমাণ অর্থ জমা পড়তে দেখা যাচ্ছে। তবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের একটি অংশও আমানত হিসেবে গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন।

দেশের অর্থনীতির আকার ৪৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেলেও রাজস্ব আয় বাড়ছে না। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রায় ৪০ লাখ আয়কর রিটার্ন জমা হয়েছে। ব্যক্তি শ্রেণীর আয়কর রিটার্নের মধ্যে খুবই নগণ্যসংখ্যক গৃহিণী রিটার্ন দাখিল করেন বলে এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, চাকরিজীবী নারীদের বড় একটি অংশ আয়কর রিটার্ন দাখিল করলেও গৃহিণীদের রিটার্ন দাখিলের ঘটনা বিরল। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়নি।

দেশের শ্রমশক্তির বড় একটি অংশ বিদেশমুখী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী কর্মরত। প্রবাসী এ বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি অংশের দেশে ব্যাংক হিসাব নেই। তারা স্ত্রীসহ স্বজনদের ব্যাংক হিসাবে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠান। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, রেমিট্যান্সের অর্থের সিংহভাগই ভোগে ব্যয় হয়। তবে কিছু অর্থ আমানত হিসেবে ব্যাংকে জমা থাকে। অনেক প্রবাসী নিজের ব্যাংক হিসাবের বাইরে স্ত্রী ও স্বজনদের ব্যাংক হিসাবেও আমানত হিসেবে অর্থ জমা রাখেন।

অনেকে কালো টাকা পার্কিং করার জন্য মা, স্ত্রী, কন্যার ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেন বলে জানান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান। তিনি বলেন, ‘কালো টাকা বা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার ক্ষেত্রে নারীদের ব্যাংক হিসাব ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান ও তদন্তে এ-সংক্রান্ত অনেক প্রমাণ উঠে আসতেও আমরা দেখেছি। তবে গৃহিণীদের ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত সব আমানতই কালো টাকা, এটি বলার সুযোগ নেই। কারণ গৃহিণীদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা বেশ ভালো। স্বামী বা স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ তারা সঞ্চয় করেন। অনেকে সংসার খরচের টাকা থেকেও সঞ্চয় করেন। উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করা অর্থও গৃহিণীরা ব্যাংকে রাখেন। ব্যাংকে গৃহিণীদের বড় অংকের আমানত জমা হওয়ার পেছনে এসব প্রেক্ষাপটের ভূমিকাও রয়েছে।’