Originally posted in দৈনিক ইত্তেফাক on 23 May 2021
করোনার প্রভাব মোকাবিলায় আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধারে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন, বাজেট কাঠামোকে এই মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে সাজানো প্রয়োজন। এজন্য নীতি নির্ধারকদের মনভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
আসছে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ইত্তেফাককে বলেন, গতবছর বাজেটের আগে আমরা বলেছিলাম কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতি কাটাতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এজন্য কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অথচ সে সময় নীতিনির্ধারকরা এটি আমলে নেননি। তাদের অনুমান ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে। এখন নীতিনির্ধারকরাই করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। অথচ এখনো সমন্বিত পুনরুদ্ধার কর্ম পরিকল্পনা দেখছি না। বাজেটেও তা থাকবে কি না বলা যাচ্ছে না।
মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনায় সাম্প্রতিক কালের অভিজ্ঞতাকে সংযুক্ত করতে হবে। যেমন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলো সঠিক হলেও এগুলো পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কেনো সেটা সম্ভব হলো না সেটা বিশ্লেষণ করে এর সমাধানকে পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে প্রণোদনার বেশির ভাগ ছিল ঋণ নির্ভর, সাধারণ জনগণকে প্রদত্ত প্রত্যক্ষ সহায়তা কম ছিল। আগামী বাজেটে অসুবিধাগ্রস্ত পরিবারদের জন্য আরো বেশি প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তাছাড়া করোনা মোকাবিলার জন্য সঠিক নীতির ক্ষেত্রে জবাবহিদিতা থাকতে হবে। যেমন দেশে ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি থেকে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। জিডিপির অংশ হিসেবে তুলনীয় দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায় হচ্ছে বাংলাদেশে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে এই অর্থ যাচ্ছে কোথায়? তার অনেকটাই কি বিদেশে চলে যাচ্ছে? আগের বাজেটগুলোতে দেখা যেত অর্থায়ন করাটাই বড় সমস্যা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে টাকা আছে কিন্তু ব্যয় করা যাচ্ছে না। অর্থাত্ বাস্তবায়নই বড় সমস্যা। আর যেটুকু ব্যয় হচ্ছে সেটাও সঠিকভাবে হচ্ছে না। ১০ টাকার জিনিস ১০ হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে, এমনটিও দেখা যাচ্ছে। অর্থাত্ বাজেট বাস্তবায়ন সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ের গুণমান নিশ্চয়তাতে জবাবদীহিতার অভাব প্রকাশ পেয়েছে। এজন্য বাজেটের আকার ও প্রবৃদ্ধির হিসাবের চেয়ে সম্পূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে বাজেট বাস্তবায়নে নতুন কি পদক্ষেপ নেওয়া হয় সেটি দেখার বিষয়।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সামাজিক পুনরুজ্জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, করোনার এই সময়ে শিক্ষা খাতের সঙ্কট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। স্কুলগুলো থেকে ছাত্রছাত্রী ঝড়ে পড়ছে, বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশু শ্রম বেড়েছে। একে মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সামাজিক উদ্যোগে বাজেটীয় সমর্থন লাগবে। করোনার এই সময়ে শিশু পুষ্টি, নবজাতকের টিকা প্রদান, মাতৃস্বাস্থ্য এ ধরনের বিষয়গুলো যাতে অবহেলিত না হয় সে দিকে বাজেটে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
অতিমারির এই সময়ে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণের দায় বেড়ে যাচ্ছে, অনেকে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। নতুন ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি এদের ঋণ মওকুফের সম্ভাবনাকে বিবেচনা করতে হবে। নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। আয়হীনতার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে তারা অসহায় হয়ে পড়ছে। এজন্য দেশে একটি সার্বজনীন মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার তথা সামাজিক সুরক্ষার সূচনা করতে হবে। এজন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে।
বিশ্বের অর্থনীতিও অতিমারির এই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য দেশীয় শিল্প বিকাশে বাজেটে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন নতুন শিল্প তৈরির জন্য কর, শুল্ক ও ভর্তুকি সুবিধা দিতে হবে। শ্রমের দক্ষতা বাড়ানো, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও উচ্চমূল্যের সেবা খাত বিকাশে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাই পুনরুদ্ধার কর্মসূচিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী চাহিদা ও বিকাশমান মধ্যবিত্তের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। একই সঙ্গে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য কমানোর জন্য সরকারি সমর্থনে ভোগ ব্যয় কতটা বাড়ানো যায় সেদিকে পদক্ষেপ নিতে হবে।