Originally posted in বণিকবার্তা on 26 March 2021
খাদ্যের রাজনীতি
১৯৭৩ সালে সিনাই যুদ্ধ ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী দেশগুলো তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা উল্টে দেয়ার জন্য ব্যাপক আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিশেষভাবে ১৯৭৪ সালে মার্কিন খাদ্য সাহায্যের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল গরিব স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে, যেমন বাংলাদেশকে, মার্কিন প্রশাসন তেলের দাম কমানোর ব্যাপারে ওপেকের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন নীতিপ্রণয়নকারীরা ও সাহায্য গ্রহণকারী স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পপ্রচারিত দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগের মধ্য দিয়ে এ নীতি বাস্তবায়নের প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে সিনেটর হুবার্ট হামফ্রের চিঠি থেকে এর প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে:
প্রশাসনের অভ্যন্তরে বারবার এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে তেলের দরবৃদ্ধির প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া ফলাও করে প্রকাশের মারফত এবং ওপেক দেশগুলোর ওপর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চাপ সৃষ্টিতে উৎসাহিত করে তেলের দাম কমিয়ে আনার জন্য সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করাই হলো এ কৌশলের লক্ষ্য। যদিও উন্নত দেশগুলোর এ ধরনের কার্যকলাপের ফলে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজটা খুব সহজ নয়।
সম্ভবত এ বিশৃঙ্খলার দ্বারা তেলের দরবৃদ্ধির ফলে খাদ্য সংগ্রহের এবং লেনদেনের সমস্যা উভয় ক্ষেত্রের বিশৃঙ্খলাকেই বোঝানো হয়েছে।
এখানে এ ক্ষমতার খেলার পেছনে যে অদৃশ্য রাজনীতি ছিল তার চেয়ে বরং বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট সংকটজনক পরিস্থিতির চিত্রটিই আমরা ভালো করে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
তেল রফতানিকারক দেশ নয়, যেমন বাংলাদেশ ও ওপেক সদস্যদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর প্রচেষ্টা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণকারীদের কাছে আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ব্যাংক তহবিল গ্রুপ কর্তৃক প্রস্তুত কাগজপত্রে এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশকে এ কথা উপলদ্ধি করানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে সে তেলের মূল্যবৃদ্ধি শিকার এবং মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা পাল্টে দেয়ার জন্য ওপেককে প্রভাবিত করার ব্যাপারে পশ্চিমি জগতের সাথে তার যোগ দেয়া উচিত। বাংলাদেশের ব্যয়বৃদ্ধির একটা অংশ বহন করার জন্য ওপেক সদস্যদের সম্মত করানোর ব্যাপারে তাদের কাছে বাংলাদেশ আবেদন জানাবে, এটা তারা আশা করেছিল।
এ ধরনের চাপ সৃষ্টিকে বাংলাদেশ সাধারণত একটা কথার কথা হিসেবে দেখেছে, যেহেতু কার্যত বাংলাদেশ অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ, এমনকি সৌদি আরবের সাথে যোগাযোগ করছিল সুবিধাজনক হারে তাদের ঋণদানের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য এবং এমনকি বিলম্বিত দায় পরিশোধের ভিত্তিতে যেন তেল বিক্রি করে, তার জন্যও বটে। অবশ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বাংলাদেশ নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিধানের সন্ধানে তৃতীয় বিশ্বের সাথে সায় দিয়ে চলছিল এবং চলতি বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে তেলের দাম বাড়াকে কোনোমতেই দায়ী করতে ইচ্ছুক ছিল না। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খাদ্যশস্যের দাম আগে থেকেই বাড়তে শুরু করে এবং এমনকি তেলের দর অপেক্ষাও দ্রুত বাড়তে থাকে। খাদ্যশস্য ও তেলের দরবৃদ্ধির পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশকে যে অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করতে হয়েছিল দরবৃদ্ধির পরবর্তী চার বছরে বাংলাদেশ খাদ্যঘাটতি পূরণের জন্য গড়ে অতিরিক্ত ২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। ওই তুলনায় তেল ও অপরিশোধিত তেলের খাতে ৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছিল।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেলের দাম অপেক্ষা খাদ্যশস্যের দাম ছিল অনেক বেশি সংকটজনক। অবশ্য প্রধান পার্থক্য এ অবস্থা থেকে উদ্ভূত যে বেশির ভাগ খাদ্য আমদানি সাহায্য খাতে এসেছে, আর তেল কিনতে হয়েছে নগদ দামে অথবা বড়জোর স্বল্পমেয়াদি ঋণের ভিত্তিতে। যা হোক শতকরা ৪৮ ভাগ খাদ্যশস্য সাহায্য খাতে আমদানি করা হলেও আলোচ্য চার বছরে খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য নগদ বৈদেশিক মুদ্রায় বাংলাদেশকে ৪৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার দিতে হয়েছে। সেখানে তেল ও পেট্রলজাত পণ্যের জন্য ৩৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হয়েছে, উদার সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও বিশ্বে খাদ্যশস্যের দরবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ বোঝা বাংলাদেশ অনুভব করেছে।
খাদ্য ছাড়াও বাংলাদেশকে অন্যান্য আমদানি পণ্যের দরবৃদ্ধিরও মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাই যদিও তেলের দাম এ সময় হু হু করে বেড়ে যায়, তবু সেটাই মোট আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সম্পূর্ণ বা একমাত্র প্রধান কারণ ছিল না।
যদি আমরা ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৪-৭৫ সালের মধ্যে তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে যে আমদানি খাতে তেলের মূল্যের জন্য মাত্র শতকরা ২০ ভাগ অতিরিক্ত দাম দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির সূচক ১৯৭২-৭৩ সালে ১০০ থেকে ১৯৭৪-৭৫ সালে বেড়ে ২১৫-এ দাঁড়িয়েছে। সুতরাং সার্বিক বিচারে বাংলাদেশ তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সে তুলনায় খাদ্য ও অন্যান্য আমদানি দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির দ্বারা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
তেলের মূল্যবৃদ্ধির শিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এবং ওপেকের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির পাশ্চাত্য কৌশলের সাথে বাংলাদেশ নিজেকে জড়িত করতে অনিচ্ছুক ধরে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন অস্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল। সেই অস্ত্র ছিল ভয়ংকর শক্তিশালী অস্ত্র—‘খাদ্যের রাজনীতি’। এর মাধ্যমে খাদ্যের জন্য পরনির্ভর বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে ওপেক নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতাই হচ্ছে তার বাঁচার একমাত্র পথ।
যেসব প্রাকৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও বাহ্যিক কারণের ফলে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয় তার পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন প্রশাসনের এ নীতি প্রয়োগের সুযোগ দেখা দেয়। ঘটনাবলি আর রাজনীতির যে ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয় তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার দিকগুলো উপলব্ধির জন্য আলোচনার দাবি রাখে।
দুই যুগের ওপর ধরেই খাদ্যঘাটতি এবং তার পরিণতিতে বাইরের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা বেড়ে চলেছে। ১৯৭০ থেকে (১৯৭১ সালের আমন ফসল থেকে ১৯৭৩ সালের আউশ ফসলের শোচনীয় উৎপাদন অবধি) ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিন বছর উপর্যুপরি শোচনীয় ফলনের জন্য অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন এবং মাথাপ্রতি ফসলের পরিমাণ খুব কমে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ফলে ১৯৭২ সালে বোরো ফসল উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর আমদানির ওপর নির্ভরশীলতার ব্যাপক বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অব্যবস্থা ও যুদ্ধের ফলে বিপুলসংখ্যক লোকের ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত হয়ে ভাসমান অবস্থায় দিনাতিপাত করতে বাধ্য হওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির পুনরায় তত্পরতা শুরু করার ক্ষেত্রে সমস্যাবলি প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
এটা স্পষ্ট যে আমদানিপ্রাপ্যতা বড় রকম কমে গেলে তা জনগণের সবচেয়ে অসহায় এবং ভাসমান অংশের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনে। তিন বছরের মধ্যে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ভালো আমন ফসলের প্রত্যাশা বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে এ রকম কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাস সৃষ্টি করেনি যে বাইরের ওপর নির্ভরশীলতার দিন শেষ হয়ে এল। কারণ স্বাভাবিকভাবেই এ কথা অনুমান করা হয়েছিল যে যেহেতু পরপর ছয়বার ফসল খারাপ হয়েছে এবং চাষীদের ঘরে মজুদ ফসল খুবই কমে গেছে। সেহেতু এ বছর ভালো ফসলের একটা বিরাট অংশ চাষীরা নিজেদের গোলাতেই জমা করে রাখবেন, বাজারে ছাড়বেন না। সুতরাং সরকারি খাদ্য বণ্টন অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এ বছরও সরকারকে কম হলেও কিছু না কিছু আমদানি করতেই হবে। অন্যদিকে চাষীরা তাদের মজুদ গড়ে তোলেন। তারা এটাকে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা মনে করেন। তিন বছরের ফসলহানিকে প্রাকৃতিক ব্যাপার বলেই তারা মনে করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে সরকার বাস্তবিকপক্ষে ২২ লাখ টন খাদ্য আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছিল। ফলে ১৯৭৩ সালের চেয়ে কিছুটা কম পরিমাণে হলেও রেশনে প্রদত্ত সব দ্রব্য বহাল রাখা যাবে এবং পাশাপাশি সরকার সম্ভাব্য মন্দার বছরের জন্য নিরাপদ মজুদ গড়ে তুলতে পারবে বলে অনুমান করা হয়েছিল।
বিশ্ব পণ্যবাজারে সংকটের মুখে স্বীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের ফলে সরকারের আমদানি কর্মসূচি কার্যকর করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং মার্কিন সরকার কর্তৃক খাদ্য রাজনীতি প্রয়োগের প্রভাবই ১৯৭৪ সালের সংকটের মূলে কাজ করেছে। এ লক্ষণ বোঝার জন্য সরকারি বণ্টন ব্যবস্থাসংক্রান্ত কার্যক্রম এবং খাদ্য আমদানির সমস্যার প্রতি নজর দেয়া দরকার।
বাংলাদেশে সরকারি বণ্টন ব্যবস্থা
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বণ্টন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সংক্ষেপে খাদ্যশস্য আমদানি ও অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ এবং সরকার নিয়োজিত ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে নির্ধারিত মূল্যে সংগৃহীত খাদ্যশস্য বিতরণের ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পর্যালোচনাধীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভোক্তাগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারি বিতরণ ব্যবস্থার কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। এ ব্যবস্থার মধ্যে অগ্রাধিকারভুক্ত গ্রুপ বিধিবদ্ধ রেশনিংয়ের (এসআর) অধীনে থাকে। এ অগ্রাধিকার গ্রুপে কতিপয় প্রধান শহরের সমগ্র অধিবাসীরা রয়েছে। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এ চারটি প্রধান শহর ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনা। ১৯৭৩ সালে রাজশাহীকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৭৬ সালে রাঙ্গামাটিকে এর আওতায় আনা হয়। এই ছয়টি কেন্দ্রে অধিবাসীর সংখ্যা ১৯৭৫-৭৬ সালে ৪৫ লাখে এসে পৌঁছে। অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশের ৬ শতাংশ লোক বিধিবদ্ধ রেশনিংয়ের আওতায় আসে। এসআর এলাকায় বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তি একটি রেশন কার্ড পাওয়ার অধিকারী। এর সাহায্যে সে সপ্তাহে নির্ধারিত মূল্যে নির্দিষ্ট রেশন দোকান থেকে খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেল কিনতে পারে।
এসআর এলাকায় রেশন কার্ডধারীদের প্রতি সরকারের বাধ্যবাধকতা ছাড়াও কতিপয় নির্ধারিত অগ্রাধিকার গ্রুপকে সরকারি বিতরণ ব্যবস্থার অধীনে রেশন সরবরাহ একান্তভাবেই বাধ্যতামূলক হয়। এদের মধ্যে আছে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, রাষ্ট্র পরিচালিত হাসপাতাল ও জেল এবং ছাত্রাবাসগুলো। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে পৃথক কার্ড দেয়া হয় না। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মাসিক বরাদ্দ পেশ করা হয়। বিধিবদ্ধ রেশন এলাকাবহির্ভূত এলাকায় সব পর্যায়ের সরকারি কর্মচারী, স্কুল শিক্ষক ও সরকারি খাতের শ্রমিকদের রেশনের পুরো কোটা সরবরাহ করা হয়। এ কর্মচারী-শ্রমিকদের প্রত্যেককে বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার তুলনায় অর্ধেক কোটা রেশন দেয়া হয়। সরকারি বণ্টন ব্যবস্থার মধ্যে এ অগ্রাধিকার গ্রুপের স্বার্থ মনে হয় সবচেয়ে অলঙ্ঘনীয়।
বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকা ও অগ্রাধিকার গ্রুপের রেশন কার্ড মালিকদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বাধ্যবাধকতার বাইরে সরকারি বিতরণ ব্যবস্থা আরো বেশি শিথিল। এ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সংশোধিত রেশনিং (এমআর)। এর মধ্যে পড়েছে বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার বাইরে শহরের কতিপয় শ্রেণীর অধিবাসী এবং গ্রামের অধিবাসী। প্রতিটি সংশোধিত রেশনিং এলাকায় নীতিগতভাবে এ ব্যবস্থায় অধিবাসীদের দরিদ্রতম অংশকে নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয়। প্রতি এলাকায় জনগণকে ক, খ, গ, ও ঘ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। স্থানীয় কর প্রদানের ভিত্তিতে এ শ্রেণীভাগ করা হয়। ক শ্রেণী হলো দরিদ্রতম গোষ্ঠী। এ গ্রুপের লোক এত গরিব যে তারা ট্যাক্স প্রদানে অসমর্থ। বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার মতোই সংশোধিত এলাকায় সমান বরাদ্দের রেশন সরবরাহ করা হয়। কিন্তু তা মাসে দুবার সরবরাহ করা হয়। ফলে তা বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার কোটার অর্ধেকে গিয়ে দাঁড়ায়। সরবরাহ আবার প্রাপ্যতার ভিত্তিতে করা হয়, অর্থাৎ বিধিবদ্ধ রেশন কার্ডের মালিক ও অগ্রাধিকার গ্রুপের দাবি মিটিয়ে খাদ্যশস্য থাকলে তবেই তা সরবরাহ করা হয়। যখন সরবরাহ কম থাকে তখন সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থার আওতায় দরিদ্রতম গ্রুপকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
খাদ্যশস্য বাজারজাতে সরকারি ব্যবস্থার অন্তর্গত সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা ছাড়াও ত্রাণ হিসেবে খাদ্যশস্য সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে পড়ে বন্যা, দুর্ভিক্ষ অথবা (যথা ১৯৭২ সালে) গৃহযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থায় দুস্থ লোকের মধ্যে (বিনামূল্যে) খাদ্য সরবরাহ। এক্ষেত্রে খাদ্যশস্য বিতরণের দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে ত্রাণ মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে। এ ব্যবস্থার আওতায় গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে অর্থ জোগানোর লক্ষ্যে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি পরিচালনার জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে খাদ্যশস্য দেয়া হয়।
১৯৭২-৭৩ সালে সংশোধিত রেশনিংয়ের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহের সাথে সম্পর্কিত। এ সময়ে ১৮ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য ত্রাণ হিসেবে বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার বাইরের অধিবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সরকারি বণ্টন ব্যবস্থায় সংশোধিত রেশনিংয়ের গুরুত্ব এভাবে বৃদ্ধির অর্থ হলো এই যে খাদ্যের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে জনসাধারণের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যদি ধরে নেয়া যায় যে দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের শতকরা ২৫ ভাগ বাজারজাত করা হয়, তাহলে ১৯৭২-৭৩ সালে বাজারজাত খাদ্যশস্য সরবরাহের শতকরা ৩৭ ভাগই এসেছে সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থার মারফত এবং বাজারের মোট সরবরাহের শতকরা ৫৪ ভাগ খাদ্যশস্য সরকারি সরবরাহ ব্যবস্থার আওতায় ছিল।
বণ্টনের রাজনৈতিক অর্থনীতি
সব পরিস্থিতিতেই জনগণের একটি নির্দিষ্ট অংশকে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা মোতাবেক খাদ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি সমতার বিবেচনা অপেক্ষা স্পষ্টতই রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের বিবেচনা দ্বারাই চালিত। জনগণের মধ্যে সরকারি কর্মচারীরা একটি সংবেদনশীল অংশ। বিশেষভাবে মূল্যবৃদ্ধির সময়ে স্থিতিশীল মূল্যে পণ্যসামগ্রী সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে এ শ্রেণীর নির্ধারিত আয়ের কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সরকার তীব্রভাবে সচেতন। তবে কার্যক্ষেত্রে রেশন সরবরাহ এ শ্রেণীর লোকদের প্রকৃত আয় হ্রাস পাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেনি। কারণ রেশনবহির্ভূত দ্রব্যাদির দাম ক্রমাগত বাড়ছে। অবশ্য যারা খোলাবাজার থেকে সব নিত্যব্যবহার্য পণ্য ক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল তাদের তুলনায় এ শ্রেণীর লোকজন কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে।
শেষোক্ত শ্রেণীর বহু লোক উৎপাদন এবং/অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে মূল্যবৃদ্ধির দ্বারা উপকৃত হতে পারে। এ বিবেচনা করলে এ ব্যবস্থার সমালোচকরা যেমন ধরে নিয়েছেন যে বিধিবদ্ধ রেশনগ্রহীতা সবা ই শহরের সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশ, অবস্থাটা ঠিক সে রকম নয়। শহরের অধিবাসীদের বিরাট অংশ গরিব এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা। এরা শহরের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হবে। এদের মধ্যে রয়েছে শহরের দরিদ্র শ্রমিক, নিম্নতম সরকারি কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনীর নিম্নতম কর্মচারী এবং এমনকি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা। একমাত্র শহরের অনাবাসিক লোকজন বাদে এসব শ্রেণীর বেশির ভাগ লোক গ্রামের গরিবদের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে। তাদের জীবনযাত্রার মান দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি। যদি প্রতিটি লোকের সর্বনিম্ন খাদ্য গ্রহণের মাসিক ব্যয় ৭১ টাকা করে ধরা যায় তবে শতকরা ৫৫ ভাগ শহরবাসী দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে এবং শতকরা ২২ ভাগ ঠিক দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে আছে অর্থাৎ শতকরা ৭৭ ভাগ লোক কোনোমতে প্রাণ ধারণ করে আছে অথবা দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে। শহরের রেশন ব্যবস্থার অধীনে ভর্তুকি দিয়ে যে খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে তা এ গরিবরা যেমন পাচ্ছে তেমনি একটি বিরাট অংশ শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীও ভোগ করে। সাম্যের মাপকাঠিতে একে অন্যায় বলেই প্রতীয়মান হতে পারে।
বাস্তবিকপক্ষে নয়া বেতন কমিশনের রোয়েদাদের প্রতি প্রতিক্রিয়া থেকে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সাম্প্রতিককালে প্রতিবাদী কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়েছে। রেশন ব্যবস্থায় খাদ্যশস্যের দাম দ্বিগুণ হওয়ার কারণে এ শ্রেণীর জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির জন্য তা ঘটছে বলে মনে হয়।
শহুরে অধিবাসী ও সরকারি কর্মচারীদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যাপারে বিধিবদ্ধ রেশনিং সবচেয়ে সুদক্ষ ও সমতাভিত্তিক পথ কিনা সে বিষয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছে না। তবে মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক যুক্তি ও কল্যাণমূলক বিচার-বিবেচনা এক্ষেত্রে যথেষ্ট স্পষ্ট বলা চলে। অবশ্য বিধিবদ্ধ রেশনের উচ্চতম মাত্রাটি স্থির রাখার অর্থই হচ্ছে সরকারের অন্যান্য খাদ্য বণ্টন খাতে খাদ্যের কোটা কমিয়ে দেয়া। বিশেষ করে এ চাপ শেষাবধি সংশোধিত রেশন বরাদ্দের ওপরই পড়ে।
বাংলাদেশের খাদ্যনীতির সমালোচকরা এ সত্য উল্লেখ করতে কুণ্ঠাবোধ করেন যে এমনকি স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮-৬৯ সালে সরকারিভাবে বিতরিত খাদ্যশস্যের অর্ধেক থেকে দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত সংশোধিত রেশনিং ও ত্রাণ খাতে ব্যয়িত হতো এবং তা সংশোধিত রেশনিং বিতরণের ৬০ শতাংশ ছিল। এখন সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা জনসাধারণের দরিদ্রতম অংশের কাছে খাদ্যশস্য পৌঁছানোর ভূমিকা যতটা সম্ভব পালন করছে। সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থায় মাসিক ২০০ টাকা আয় গ্রুপের পরিবারই উপকৃত হয়। এরা গ্রামীণ জনসংখ্যার শতকরা ১৬ ভাগ। কোনোমতে জীবনযাত্রা নির্বাহকারী চাষীদের তুলনায় গ্রামীণ অধিবাসীদের এ অংশ প্রধানত তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বাজারের ওপর নির্ভরশীল বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
অনুরূপভাবে ত্রাণ খাতে খাদ্য বণ্টনের লক্ষ্যও জনসাধারণের দরিদ্রতম অংশ। এর একটা অংশ কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু রাখতে ব্যয় হয়। এ কর্মসূচি ভূমিহীন ক্ষেতমজুরের জন্যই গ্রহণ করা হয়েছে এবং আরেকটা অংশ গ্রামের দুস্থ এতিম আর বিধবাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ১৯৭২ সালে প্রত্যাগত উদ্বাস্তু এবং ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের শিকার লোকজনকে খাওয়ানোর জন্য খয়রাতি ত্রাণ হিসেবে খাদ্য বণ্টন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল
সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে, এর প্রতি সচেতন অবহেলা। সবাইকে দিয়ে-থুয়ে যা খাদ্য বাকি থাকে তাই এর মাধ্যমে বিতরণের জন্য ব্যবহূত হয়। এ বিধিবদ্ধ ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক চাহিদা মেটানোর পর অবশিষ্ট যে খাদ্য থাকে তা সংশোধিত রেশনিংয়ের অধীনে বণ্টন করা হয়। তাই কী পরিমাণ খাদ্য পাওয়া যাবে তা আমদানির পরিমাণের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। সারণি-৪ থেকে আমরা দেখেছি যে ১৯৭৩-৭৪ সালে আমদানি কমলে সংশোধিত রেশনিংয়ের অধীনে বণ্টন এবং ত্রাণের জন্য খাদ্যশস্যের পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে কমে গেছে।
ওই ব্যবস্থার পরিণতি এই দাঁড়ায় যে আমদানি কমতির সময়ে সংশোধিত রেশনিং ও ত্রাণ দ্বারা উপকৃত জনসাধারণের দরিদ্রতম অংশ সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, স্থানীয় সরকারি কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতাদের নীতি ছিল সংশোধিত রেশনিংয়ের অধীনে যত বেশি সম্ভব জনসাধারণকে নিয়ে আসা, যাতে খাদ্যশস্যের অভাবের সময় রেশনের পরিমাণ এবং বিতরণের মাত্রা কমানো যায়।
সংশোধিত রেশনিংয়ের ক্ষেত্রে বাজারের প্রভাব
অবশ্য সংশোধিত রেশনিং খাদ্য গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে অধিকতর সুদূরপ্রসারী অর্থ বহন করে। আমদানির মারফত কতটা পাওয়া যাবে তার ওপর পরিমাণের নির্ভরশীলতা হেতু সংশোধিত রেশনিংয়ে খাদ্য বণ্টনের পরিমাণ বাজারের চাহিদা এবং চালের দামকে প্রভাবিত করে। সংশোধিত রেশনগ্রহীতা কী পরিমাণ রেশন পায় তার ওপর বাজার থেকে তাদের চাল কেনার পরিমাণ নির্ভর করে। সংশোধিত রেশনে সরবরাহ হ্রাসের অর্থ হলো অধিকতরসংখ্যক ক্রেতার খোলাবাজারে চাল কিনতে যাওয়া এবং সরবরাহের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে চালের দাম বেড়ে যাওয়া। বাজারে চাল সরবরাহ কী পরিমাণ বাড়বে সেই নিরিখে দামের ওপর কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সংশোধিত রেশনে চাল সরবরাহ অনুরূপ হারে কমানো যেতে পারে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৭৩-৭৪ সালে খাদ্যমূল্য প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকারণ হলো সংশোধিত রেশনিং এবং ত্রাণ খাতে খাদ্য বণ্টনের পরিমাণের একান্ত নিম্নমুখী গতি। ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকে এবং বিশেষভাবে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে সরকারি বিতরণ ব্যবস্থায় এমআর এবং ত্রাণ খাতে বণ্টন প্রধান ছিল। সারণি ৪-এ সংশোধিত রেশনিং ও ত্রাণ খাতে মাসিক ভিত্তিতে ১৯৭৩-৭৫ সালের সংকটজনক সময়ে খাদ্য বণ্টনের হিসাব আমরা দেখিয়েছি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৭২-৭৩ সালে এ দুই খাতে মাসিক গড়ে দেড় লাখ টন খাদ্য বণ্টন করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের সংকটজনক বছরে সংশোধিত রেশনিং ও ত্রাণ খাতে মাসিক খাদ্যশস্য বণ্টন ৫৯ হাজার টনে নেমে আসে। এর অর্থ ছিল যে খোলাবাজারকে ১৯৭৪ সালে প্রতি মাসে গড়ে অতিরিক্ত ৯০ হাজার টন চাহিদা মেটাতে হয়েছে।
সাধারণভাবে দেখলে এ কথাই প্রতিভাত হয় যে ১৯৭৩ সালে ভালো আমন ফসল দ্রব্যমূল্যের চাপ কমাতে পারত এবং বাস্তবিকপক্ষে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালের দাম পড়ে যায়।
কিন্তু যা-ই হোক, সংশোধিত রেশন বরাদ্দ যখন পাশাপাশি কমতে থাকে এবং চতুর চাল ব্যবসায়ীরা যখন অনুধাবন করে যে সরকারের স্টকে যথেষ্ট চাল মজুদ নেই তখন থেকেই খোলাবাজারে চাল সরবরাহে ভাটা দেখা দেয়। ফলে ১৯৭৪-এর মার্চে চালের দাম আবার দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে ফসল উৎপাদন হ্রাসের বছরগুলো এবং ব্যক্তিগত মজুদ শস্যের পরিমাণ হ্রাস সরকারি বিতরণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঘাটতির আশঙ্কা সম্পর্কে উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী উভয়কেই সজাগ করে তুলেছিল। এ রকম অবস্থা উদ্ভবের যেকোনো আলামত খাদ্যের অপ্রতুলতা সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এটা ঘরে ঘরে এবং ব্যবসায়ীদের গুদামে মজুদ করার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সারণি ৪-এ খাদ্য আমদানি, এমআর ও ত্রাণের মাধ্যমে সরকারি খাদ্য বিতরণ এবং সরকারি মজুদ খাদ্যের হিসাবও দেখানো হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে আমন ফসল তোলার পর সংশোধিত রেশনে খাদ্যের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় ১৯৭৪ সালের প্রথম ছয় মাসে বণ্টনকৃত খাদ্যশস্যের মাসিক গড় ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে হ্রাস পায়। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে যখন এটা প্রতীয়মান হলো যে খাদ্য আমদানির ক্ষমতা হ্রাস পাবে তখন সংশোধিত রেশনিংয়ে খাদ্য সরবরাহ হ্রাস কার্যকর করা হয়। এভাবে ১৯৭৪ সালে খাদ্য আমদানির পরিমাণ, সংশোধিত রেশনিংয়ে বণ্টন ও সরকারি মজুদ ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় গড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে আগাগোড়াই কম ছিল। সরকারি বণ্টনের ক্ষেত্রে হ্রাসের এ পরিমাণ গ্রামের অধিবাসীদের আশঙ্কাকেই জোরদার করে। সংশোধিত রেশনিংয়ে সরবরাহ কমানোর ফলে বাজারের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ পড়ে এবং আমদানির মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সংকটজনক অবস্থা সম্পর্কে আশঙ্কার কারণে কৃষকরা বাজারে চাল সরবরাহ কমিয়ে ফেলেন। ফলে মার্চ নাগাদ খাদ্যশস্য সরবরাহের কমতি খাদ্যশস্যের দামের ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। বাজারজাতযোগ্য সামান্য উদ্বৃত্তও খাদ্যমূল্যের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও জুনের মধ্যে খাদ্যশস্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়। ঊর্ধ্বমুখী মূল্য ও ঘাটতি আঁচ করে আতঙ্কগ্রস্ত উৎপাদনকারী ও মুনাফা শিকারি ব্যবসায়ী উভয়ই খাদ্যশস্য মজুদ করার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
খাদ্য ও দুর্ভিক্ষ
ক্রমবর্ধমান মজুদদারি, ফাটকাবাজি ও আমদানি ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা এবং ১৯৭৪ সালের জুন-আগস্টে অভূতপূর্ব বন্যা খাদ্য সংকট আরো ত্বরান্বিত করে। দুই যুগ ধরে বন্যার রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে বহু বছরের মধ্যে এ বন্যা ব্যাপকতা আর তীব্রতার দিক থেকে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। বন্যায় আউশ ফসলের ক্ষতি হয় খুবই বেশি। তাই দুই যুগের মধ্যে প্রতি একরে ফলন সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে পৌঁছে। এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি এজন্য দেখা গিয়েছিল যে অতিরিক্ত ১ লাখ ৭৬ হাজার একরে আউশ আবাদ হয়েছিল। পাটের জমি আউশ চাষে ব্যবহারের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। এতে অবশ্য পাটের ফলনের রেকর্ড পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় সর্বাপেক্ষা কম হয়। বন্যার ফলে আমন ধান রোপণ সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমন ধানের ফলন সাত লাখ টন কম হয়।
এটা সবিশেষ তাত্পর্যময় যে দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে উৎপাদন হ্রাস অপেক্ষা উৎপাদনকারী ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের ওপর বন্যার প্রভাব কাজ করেছে বেশি। তিন বছরের মধ্যে মাথাপিছু খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পায়; কিন্তু এ হ্রাস মূল্যের ব্যাপারে পরিসংখ্যানের সাথে কোনোরূপ সম্পর্কিত নয়। এটা ৪ নং সারণি এবং সুনিপুণভাবে পরিমাণগত বিশ্লেষণ উভয় দিক থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। বন্যা এ ভয় আরো দৃঢ়বদ্ধ করে যে ব্যাপক ঘাটতি আসন্ন। বাংলাদেশের সমগ্র গ্রামীণ বড় ও ছোট কৃষি উৎপাদনকারী উভয়ের মনের বদ্ধমূল এ আশঙ্কা সামান্য যে বোরো ও আউশ ফসল বাজারজাত করা যেত, তাও ধরে রাখতে প্ররোচিত করে।
খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ীরা আরো একটি তথ্য জানতেন, যা সাধারণ ভোক্তা ও উৎপাদনকারীরা জানতেন না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সূত্রে তারা জানতেন যে শরত্কালীন সংকটময় সময়ের জন্য সরকার পর্যাপ্ত আমদানির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সরকারি বণ্টন ব্যবস্থা জাহাজ থেকে সরাসরি মুখে খাদ্য জোগানোর পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে আমন ফসল ওঠার আগের মাসগুলোতে সরকারের মজুদ খাদ্য একেবারেই হ্রাস পায়। এ খবর জানতে পেরে তারা আরো বেশি খাদ্য মজুদ করতে প্ররোচিত হন। ফলে আগস্ট থেকে খোলাবাজারে ধান-চাল সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য আগস্ট থেকে ধান-চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে এবং অক্টোবরে চালের দাম সর্বোচ্চ মণপ্রতি ২৬৩ টাকায় দাঁড়ায়। এ দাম ওই বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় ৩ দশমিক ৩ গুণ বেশি ছিল।
খাদ্যশস্যের জন্য বাজারের ওপর নির্ভরশীল কৃষক শ্রেণীর পক্ষে এ মূল্যবৃদ্ধির ফল মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। এ শ্রেণীর কৃষকদের পাট উৎপাদন হ্রাস, আউশ ফসলের ক্ষতি ও আমনের চারা রোপণ হ্রাসের ফলে আয়ের পরিমাণও কমে যায়। ছোট কৃষকরা ফসলের ক্ষতির জন্য সংকটের মুখে পড়েন, ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের কাজের সুযোগ কমে যায় এবং মজুরি হ্রাস পায়। গরিবদের এ আয়ক্ষমতা হ্রাসের পাশাপাশি খোলাবাজারে চালের দামও আকাশচুম্বী হয়ে উঠতে থাকে এবং সংশোধিত রেশনের মাধ্যমে তাদের অতিরিক্ত ব্যয়ভার লাঘবের সুযোগও কমে যায়। বাস্তবিকপক্ষে সংকটপূর্ণ সময়ে সংশোধিত রেশন হ্রাসের পরিমাণ ১৯৭৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে ফসল কাটার মুহূর্তে প্রায় তলায় এসে ঠেকেছে। ফলে গ্রামের গরিব জনসাধারণের সমগ্র অংশ বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে এবং অনশনের সম্মুখীন হয়।
বন্যার ফলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো কোনো দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যু দেখা দেয়। রংপুর সবচেয়ে চরম দুর্গত এলাকায় পরিণত হয়। সেখানে আনুমানিক ২৫ হাজার লোক দুর্ভিক্ষে মারা যায়। সেখানকার দুর্ভিক্ষগ্রস্ত লোকজনের একটা অংশ জমিজমা ও হালের বলদ বিক্রি করে ঢাকার রাজপথে এসে অনাহারে মারা যায়। দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যার হিসাবে নানা তারতম্য দেখা যায়। সরকারি হিসেবে ২৭ হাজার এবং বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী এক লাখ লোক দুর্ভিক্ষে মারা গেছে বলে প্রকাশ। দুর্ভিক্ষগ্রস্ত এলাকায় ৫ হাজার ৮৬২টি লঙ্গরখানা খুলে বহু অনাহার-মৃত্যু ঠেকানো গিয়েছে।
অক্টোবর ও নভেম্বরের তীব্র দুর্ভিক্ষের সময়ে এসব লঙ্গরখানায় ৪৩ লাখ লোককে কোনোমতে প্রাণধারণের উপযোগী খাবার সরবরাহ করা হয়। এসব লঙ্গরখানার অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়, কিন্তু এ প্রচেষ্টার ফলে অসংখ্য লোকের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। এ দুই মাসের প্রতি মাসে ৩০ হাজার টনের মতো খাদ্য ত্রাণ খাতে দুস্থ শিবিরের লোকজনকে খাওয়ানোর জন্য দেয়া হয়েছিল। এ সরবরাহ অবশ্য সংশোধিত রেশনের সরবরাহ কর্মসূচি থেকে কেটে নেয়া হয়েছিল। ফলে সংশোধিত রেশনের আওতায় সরবরাহ ১৯৭৪ সালের শেষ তিন মাসে একেবারে তলায় এসে ঠেকে। এটা আবার চালের বাজারদরকে প্রভাবিত করে। ফলে চালের দাম এ সময় রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
এ থেকে দেখা যায় যে চরম খাদ্য ঘাটতি অপেক্ষা দুর্ভিক্ষ অনেকাংশে মানুষের তৈরি ছিল। এর আশু কারণ ছিল ফসল উৎপাদনকারী এবং খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের মজুদ ও ফাটকাবাজি। অবশ্য এর স্থানীয়ভাবে তীব্রতার মূলে ছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রক্ষণশীলতা। এ মন্ত্রণালয় বিধিবদ্ধ রেশনের পরিমাণ কমিয়ে রংপুরের মতো চরম খাদ্যাভাবগ্রস্ত এলাকার লোকদের খাওয়াতে পারত। যা হোক, এ সংকটের প্রাথমিক উৎস ছিল আমদানি কর্মসূচি ভেঙে পড়ার মধ্যে। তাই আমরা খাদ্যশস্য আমদানির ক্ষেত্রে সংকটের পরিস্থিতি কী তা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য আমদানি
১৯৭৩-৭৪ সালে খাদ্য বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ২২ লাখ টন ধরেছিল। ১৯৭৩ সালের ১ আগস্ট ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের সাথে আলোচনাকালে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ হিসাব পেশ করেছিলেন এবং ওই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরেস তিন লাখ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দের জন্য তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, এটা বুঝতে পেরে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করার জন্য চাপ দেন।
১৯৭৩ সালের ৩০ আগস্ট পরবর্তী বৈঠক বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম ও মার্কিন সাহায্য সংস্থার সহকারি প্রশাসক মরিস উইলিয়ামসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নূরুল ইসলাম জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সাহায্যের কথা তোলেন। তিনি বলেন যে বিশ্বে উচ্চ খাদ্যমূল্যের জন্য বাংলাদেশকে নগদ মূল্যে খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা অর্ধেক করতে হয়েছে। তাই তিনি মার্কিন পিএল-৪৮০-এর ১ নং কর্মসূচির অধীনে ২ লাখ ২০ হাজার টন গম ও ২০ হাজার টন ভোজ্যতেল বরাদ্দ এবং আশু পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানান।
আবার ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিবের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের ২২ লাখ টন খাদ্যশস্য, ১ লাখ ২৮ হাজার টন সয়াবিন তেলের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন যে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশকে ক্রমবর্ধমান চড়া বিশ্ববাজার থেকে নিজস্ব সম্পদ ব্যয় করে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত। তাই তিনি ১ নং কর্মসূচির (টাইটেল ১) অধীনে আরো গম বরাদ্দের এবং এরই মধ্যে প্রতিশ্রুত সাহায্য মোতাবেক গম ও সয়াবিন তেল ক্রয়ের জন্য আশু অনুমোদন দানের অনুরোধ জানান।
এ প্রচেষ্টা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার সক্রিয়ভাবে অন্যান্য সরকার ও সংস্থার কাছেও, যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও সাধারণ বাজারভুক্ত দেশগুলোর (ইইসি) কাছে খাদ্যশস্যের জন্য আবেদন জানা। সাথে সাথে নগদ দামে খাদ্য কেনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস পেতে থাকে। নয়া সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে অথবা সাহায্য সরবরাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যর্থতা ১৯৭৩ সালের শেষে এমন সংকট সৃষ্টি করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নগদ দামে কেনা খাদ্যের একাংশ দুই লাখ টন খাদ্যশস্য মাঝপথ থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য সোভিয়েত সরকারকে অনুরোধ জানাতে বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হয়। সরকারি বণ্টন ব্যবস্থার ভেঙে পড়া ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে তখন এ পন্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল। এ দুই লাখ টন খাদ্যশস্য বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের জুলাই-অক্টোবরে এসে পৌঁছে এবং সংকটপূর্ব সময়ের রেশন ব্যবস্থা চালু রাখতে সাহায্য করে। ১৯৭৩ সালের পরবর্তী সময়ে সরবরাহের প্রতিশ্রুতিমতো মার্কিন গম এসে পৌঁছলে তা মাঝপথে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠিয়ে দিয়ে ওই গম পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু মার্কিন সরকার এ ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করে, তাই বাংলাদেশ সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বিলম্বে পরিশোধের জন্য এক চুক্তি করতে বাধ্য হয়।
যা হোক, একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এ গম সরবরাহ এসে পৌঁছে গেলে এবং মার্কিন প্রতিশ্রুত খাদ্য সরবরাহ বিলম্বিত হলে খাদ্য আমদানি একেবারেই কমে যায়। ১৯৭৩ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের পুরো মার্চব্যাপী প্রতি মাসে গড়ে ৭৪ হাজার টন খাদ্য এসেছে। সে তুলনায় ১৯৭২-৭৩ সালে প্রতি মাসে গড়ে ২ লাখ ৩২ হাজার টন খাদ্য এসেছে। এরূপ ঘাটতির প্রভাবে, ৪ নং সারণি থেকে দেখা যাবে, ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে সরকারি খাদ্য মজুদ হ্রাস পায় এবং সংশোধিত রেশনে সরবরাহের সংকোচন ঘটে।
১৯৭৩-৭৪ সালের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি পালনে বিলম্বের সম্মুখীন হয়ে বাংলাদেশ সরকারকে খোলাবাজার থেকে গম সংগ্রহ করতে হচ্ছিল। এ সময়ে খাদ্যশস্যের দাম ১৯৭২-৭৩ সালে টনপ্রতি ১১৫ ডলার থেকে ১৯৭৩-৭৪ সালে টনপ্রতি ১৯৯ ডলারে পৌঁছে। এ খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য তাই সরকারের নগদ অর্থের তহবিল ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। সারণি-৫ থেকে দেখা যায় যে ১৯৭৪ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক কালে এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ কোটি ডলার। বাস্তবিকপক্ষে এ রিজার্ভ অর্থ এরই মধ্যে চুক্তিতে উপনীত আমদানির বিল মেটানোর জন্য যা প্রয়োজন তা থেকে কম, সুতরাং অর্থনৈতিক পরিভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। সারণি থেকে দেখা যায় যে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণকারক অর্থের জোগানও ছিল অপর্যাপ্ত।
তাদের সংস্থানকৃত অর্থের বিপরীতে আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭২-৭৫ সালে প্রতি বছর বাংলাদেশের খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য গড়ে ১৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হয়েছিল। পাশ্চাত্য দাতা এজেন্সিগুলো বাংলাদেশের সংকটজনক আর্থিক পরিস্থিতি বাণিজ্যিক ঋণদাতাদের কাছে প্রকাশ করে দেয়। ফলে ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মকালে স্বল্পমেয়াদি বিলম্বে পরিশোধ্য ঋণচুক্তির অধীনে মার্কিন খাদ্যশস্য রফতানিকারকদের সাথে বাংলাদেশ সরকারের দুটো খাদ্য সরবরাহসংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করে দেয়া হয়। কারণ বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণের যোগ্যতা সম্পর্কে তাদের মনে সন্দেহের ছায়াপাত ঘটে। এটা স্পষ্ট নয় যে বাংলাদেশকে নতজানু করানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিজস্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা প্রভাবিত হয়েছিল কিনা। কিন্তু এটা জানা আছে যে মার্কিন খাদ্যশস্য রফতানিকারকরা মার্কিন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
কিউবার সাথে বাণিজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য নিয়ে রাজনীতি
১৯৭৩-এর শেষ নাগাদ সময়টায় যখন বাংলাদেশের হাতে বাজার থেকে খাদ্য ক্রয় বা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় নগদ পয়সা ছিল না, ধার করার ক্ষমতাও ছিল না এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক প্রতিশ্রুত সাহায্যও যখন আসতে শুরু করেনি ঠিক তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার শেষ তুরুপের তাসটি ছেড়েছিল। মে ২৯, ১৯৭৪ সালে যখন সরকারের গুদামে খাদ্য মজুদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৬ হাজার টন এবং প্রবল মৌসুমি বারিপাত যখন আসন্ন বন্যার সংকেত জানাচ্ছে ঠিক সেই সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে নিজে যেচে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। সভায় ডেভিড বোস্টার সাহেব ঢাকার একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বিশেষ সংবাদের প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওই সংবাদ অনুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন কিউবার কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৪০ লাখ পাটের থলে বিক্রির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বোস্টার সাহেব পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের আইন অনুযায়ী যেসব দেশ কিউবা ও উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য করছে তাদের জন্য পিএল ৪৮০-এর চাল সাহায্য নিষিদ্ধ। অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে অর্থাৎ যুদ্ধে অব্যবহার্য কৃষিজ পণ্য বা কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু যুদ্ধে ব্যবহূত হয় না এমন যেকোনো পণ্য কিংবা মেডিকেল সাপ্লাইয়ের বাণিজ্য করলে সে দেশকে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছানুযায়ী বিশেষ সুযোগ দেয়া যেতে পারে এবং কংগ্রেসের আইন তার জন্য শিথিল হতে পারে। সহজ সাধারণ জ্ঞানই বলে দিতে পারে যে চটের থলের কোনো রণনীতিগত ব্যবহারিক মূল্য নেই, তবু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ নিয়মের বিশেষ কোনো শৈথিল্য করা হয়নি। ঘটনার জরুরি গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আমেরিকান রাষ্ট্রদূত দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ব্রুস ল্যানজেন, নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক পত্রও দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়েছিল:
‘টাইটেল নং ১ অনুযায়ী কোনো রকম বিক্রির আগে আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে এই মর্মে লিখিত অথবা তাতে অসুবিধা থাকলে মৌখিক প্রতিশ্রুতি চাই যে বাংলাদেশ সরকার আমাদের আইনগত অসুবিধার কথা অবগত আছে এবং সেজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কিউবায় কোনো পণ্য রফতানি অথবা কিউবার বন্দরে কোনো রাষ্ট্রীয় জাহাজ ভেড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করে না।’ যুক্তরাষ্ট্রের উপরিউক্ত চিঠির বক্তব্য বাংলাদেশের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো প্রতিভাত হয়। কারণ এর বহু আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ফিদেল কাস্ত্রোর মধ্যে ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ মহাসম্মেলনে বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রমে ক্রমে অগ্রগতি হচ্ছিল। আবার পাশাপাশি একই সময়ে আমেরিকার সঙ্গেও পিএল ৪৮০-এর অধীনে বাণিজ্যের চুক্তিগুলো ধীরে ধীরে সম্পাদিত হচ্ছিল। অথচ সেই সময় এ ধরনের কোনো শর্তের কথাই উল্লেখ করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশের প্রতিনিধি যেসব বক্তব্য উপস্থিত করেন তা হলো:
১. বাংলাদেশের সঙ্গে কিউবার বর্তমান বাণিজ্য একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র। এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য চুক্তির অংশ নয়। মাত্র ৪০ লাখ চটের থলে মাত্র ৫০ লাখ ডলারের বিনিময়ে রফতানি করা হবে।
২. জুট মিল করপোরেশন যখন কিউবার সঙ্গে উপরিউক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পদন করে তখন জানা ছিল না যে তা আমেরিকান পিএল ৪৮০ চুক্তির শর্তবিরোধী। তদুপরি চুক্তি সম্পাদনের সময়েও সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে কোনো দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি।
৩. বাংলাদেশ কাঁচা পাট রফতানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বর্তমানে বাংলাদেশের পাটের বিশ্ববাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এমন অবস্থায় পৃথিবীর সম্ভাব্য সব দেশে পাট রফতানির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব নয়।
৪. সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে খোদ কিউবায় গাড়ি রফতানির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার গাড়ি রফতানির তুলনায় বাংলাদেশের পাট রফতানির গুরুত্ব অনেক বেশি।
সুতরাং যদি একান্তই প্রয়োজন হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশেষ অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী পাট রফতানিকে প্রতিবন্ধকতামুক্ত করতে পারেন। বাংলাদেশ সরকার যখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সহানুভূতির জন্য এ ধরনের সরল অনুরোধ-উপরোধে ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই সময় প্রায় একই ধরনের ব্যাপারে মিসরকে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ কনসেশন দিয়েছিল। তবে তখন বাংলাদেশের তা জানা না থাকায় তাদের বক্তব্যে এ জলজ্যান্ত ব্যাপারটি ঠাঁই পায়নি। আজ অবশ্য আমরা সবাই জানি যে সেই বিশেষ কনসেশন নিয়ে ওই সময়ে মিসর কিউবায় তুলা রফতানি করেছিল। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন পিএল ৪৮০-এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্র মিসরকে ১ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এ ঋণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে তামাক কেনার জন্য। আগস্ট ১৪ জেরাল্ড ফোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম যে কাজগুলো করেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে মিসরের জন্য পিএল ৪৮০-এর চুক্তিকে শিথিল করে ১৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এক লাখ টন গম বিক্রির ব্যবস্থা করা। কায়রোতে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এ এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অথচ ঠিক এই সময় বাংলাদেশের পথে পথে দুর্ভিক্ষের শিকার প্রথম লাশগুলো দেখা দিতে শুরু করেছিল।
যখন বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষ ও বন্যার কবলে হাবুডুবু খাচ্ছে তখনো উপরিউক্ত ঘটনাটির কোনো সুষ্ঠু ব্যাখ্যা আমেরিকার পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। কেন যে পাটের থলে কাঁচা তুলার চেয়ে অধিকতর বিপজ্জনক অস্ত্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল অথবা কেন মিসরের ক্ষেত্রে যে বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা হয়েছিল তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও হলো না এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। প্রকৃত ব্যাখ্যা সম্ভবত এটাই যে মিসরের আনোয়ার সাদাত সে সময় কিসিঞ্জারের কূটনীতিকে পশ্চিম এশিয়ায় প্রয়োগ করছিলেন বা প্রয়োগে সহায়তা করছিলেন। সুতরাং তখন মিসরের জন্য আমেরিকা তার সব দরোজা খুলে দিতে কার্পণ্য করেনি। অবশ্য যুদ্ধাস্ত্র দেয়ার মতো বিশ্বাস তখনো মিসর অর্জন করেনি বলে যুদ্ধাস্ত্র দেয়া হয়নি।
অন্য যেকোনো সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমেরিকার এ ধরনের আচরণের মোকাবেলা করার দিকেই ঝুঁকতেন এবং বাংলা-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতেন। এমনটি তার জন্য নতুনও নয়। ১৯৭৩ সালের মার্চে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের উত্তরাধিকার অস্বীকার করার মাধ্যমে তিনি এ ধরনের একটি অবস্থা নিকট অতীতেই সৃষ্টি করেছিলেন। তবে ওই মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনে রাজনৈতিক বীরত্ব প্রদর্শনের কোনো অভিলাষ ছিল না। চালের দাম মণপ্রতি ১৪০ টাকা রেখে দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে শক্তি সংগ্রহের সম্ভাবনা তদানীন্তন অর্থনৈতিক কাঠমোয় খুবই সীমিত ছিল। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রী একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সরকারকে তাদের আকাঙ্ক্ষিত প্রতিশ্রুতি প্রত্যর্পণ করবে। ১৯৭৪ সালের ১০ জুলাই এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর মাত্র অল্প কয়েক দিন পরই বহিঃশক্তির দীর্ঘদিনের চাপ এবং দাবির কাছে নতি স্বীকার করে সরকার তার বিনিয়োগ নীতিকে ব্যক্তিগত খাত ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে পরিবর্তিত করে। বন্যার পানির ক্রমোচ্চতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার নিম্নতা এ দুটিই ছিল বিদেশী সাহায্যকারীদের চাপ প্রয়োগের প্রধান হাতিয়ার।
তবে বাংলাদেশের ললাটে আরো প্রচুর দুঃখ লেখা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সব প্রতিশ্রুতি ও কনসেশন দিতে রাজি হওয়ার পরও চাল পাঠাতে অহেতুক বিলম্ব করল। অজুহাত হিসেবে খাড়া করা হলো উদ্ভট এ যুক্তি যে কিউবায় চলতি মৌসুমে যে ৪০ লাখ চটের থলে পাঠানো শুরু হয়েছিল সেটার সরবরাহ পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাল পাঠানো হবে না। সুতরাং ১৯৭৪-এর অক্টোবর পর্যন্ত চাল পাঠানো স্থগিত থাকল। অবশেষে চুক্তি করার প্রায় এক বছর পর ৪ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে পিএল ৪৮০-এর অধীনে চাল পাঠানোর জন্য আমেরিকা সবুজ সংকেত দিল।
এর ওপর আবার ২০ হাজার টন ভোজ্যতেল সরবরাহ বন্ধ রাখা হলো। এ ভোজ্যতেল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। কিন্তু প্রথমে কিউবার সাথে ব্যবসার অজুহাতে এর সরবরাহ বন্ধ করা হয়। পরে সয়াবিন রফতানির ওপর মার্কিন সরকার কর্তৃক সাধারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে এর সরবরাহ আবারো স্থগিত রাখা হয়। সাধারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে এ ভোজ্যতেল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তাই এখন ওই তেলের চালান ছাড়া যেতে পারে এ রকম কোনো অনুরোধ-উপরোধই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনকে বিশেষ অধিকার প্রয়োগে রাজি করাতে পারেনি। ফলে জানুয়ারি ১৯৭৪-৭৫ সালের মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম মণপ্রতি ২৭১ থেকে ৫১৮ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। একই সময়ে পাশাপাশি সরিষার তেলের দামও মণপ্রতি ৫৪৪ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪৪১ টাকা হয়।
এ অহেতুক বিলম্ব ছিল বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ সমস্যার ব্যাপার। বস্তুত এ সময়ই বন্যার পানি সারা দেশে দ্রুত বেড়ে চলেছিল। ঢাকায় চালের দাম অক্টোবরে সর্বোচ্চ মণপ্রতি ২৬৩ টাকায় বেড়ে গিয়েছিল। জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে ঢাকার রাস্তায় মোট ৪৬৮টি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া গিয়েছিল এবং স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা তাদের দাফনের ব্যবস্থা করেছিল। ক্রমবর্ধমান এ দুর্ভিক্ষের প্রদর্শনী ঢাকায় অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসের নাকের ডগাতেই সংঘটিত হচ্ছিল। অথচ তারা তাদের গড়িমসি অব্যাহত রেখেছিল।
৪ নং সারণি থেকে বোঝা যায় যে বৈদেশিক সাহায্য এবং নগদ মূল্যে ক্রীত খাদ্যশস্যের প্রবাহ প্রধানত মে থেকে আগস্ট ১৯৭৪-এর মধ্যে ঠিকই ছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে চাল এসেছিল মাত্র ২৯ হাজার টন। আর অক্টোবরে মাত্র ৭৬ হাজার টনের আরেক চালান এসে পৌঁছে। ফলে সরকারি ভাণ্ডারে চালের সঞ্চয় খুবই কমে যায়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অফিসাররা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ এক পর্যায়ে এমনকি শুধু বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার জন্য প্রয়োজনীয় চালের কোটাতেও বিপজ্জনক স্বল্পতা দেখা দিয়েছিল। সন্দেহ উপস্থিত হয়েছিল যে রেশন হয়তো আর দুই মাসও চলবে না। ফলে তারা সামান্য যা চাল স্টকে ছিল সেটা দিয়ে আমন ফসল না ওঠা পর্যন্ত, অর্থাৎ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো তিন মাস কীভাবে চালাবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এ ভীতির কারণেই রংপুরের চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা মোকাবেলা করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে তারা সাহস পাননি।
১৯৭৪-এর নভেম্বরে অবশেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং আমেরিকা গেলেন। সেখানে বহু কষ্টের পর সামান্য কিছু সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তাকে শীতল অভ্যর্থনার মাধ্যমে আমেরিকা থেকে বিদায় দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীকে এভাবেই বুঝিয়ে দেয়া হয় আমেরিকার ক্ষমতা কতখানি! বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জোট নিরপেক্ষতার ঠুনকো ওজন যে আমেরিকার সদয় ভাবের ওপরই নির্ভরশীল সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
কিন্তু সমসাময়িক নেতাদের মতো না করে শেখ মুজিব একটু ভিন্ন পথে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি এ চ্যালেঞ্জের জবাব হিসেবে তিনি এক আমূল প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের কর্মসূচি হাজির করলেন। তার বাধ্যতামূলক সমবায় ও প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের কর্মসূচিই ছিল এ চ্যালেঞ্জের জবাব। কিন্তু এর পর পরই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে তাকে হত্যা করা হলো। এরপর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তার সাথিদের মধ্যে যারা অধিক পশ্চিম ঘেঁষা তারা। খন্দকার মুশতাক আহমেদ হলেন প্রেসিডেন্ট।
দুর্ভিক্ষের রাজনৈতিক অর্থনীতি
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা শুধু যে পরনির্ভরতার বিপদকেই প্রকাশ করেছে তা নয়, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাগুলোও চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের নিকটতম কারণটি হয়তো পিএল৪৮০-এর অধীনে খাদ্য আমদানি স্থগিত থাকা। কিন্তু এ কারণটি সক্রিয়ভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে। আর এ বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন বড় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। এছাড়া সরকারকেও বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থকে হিসাবের মধ্যে রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ব্যক্তিগত খাদ্য মজুদ ও আমদানীকৃত খাদ্যের মোট যোগফল অনুৎপাদক জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। যদি এ উদ্বৃত্ত খাদ্য সামাজিকভাবে অধিগ্রহণ করা হতো তাহলে সবার জন্যই ন্যূনতম জীবন নির্বাহোপযোগী খাদ্যের ব্যবস্থা করা সম্ভব হতো। তবে প্রয়োজন হতো সবার সঙ্গে সবার কষ্ট ভাগাভাগি করে নেয়া, তাহলেই দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুকে এড়ানো যেত।
এমনকি সমস্ত খাদ্যশস্য রাষ্ট্রায়ত্ত না করেও সামান্য কিছু নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে খাদ্যশস্য যদি পুনর্বণ্টন করা হতো তাহলেও দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যু এড়ানো সম্ভব ছিল। সারণি-৪ থেকে এটা বোঝা যায় যে এমনকি ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরেও বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার অধীনে বিশেষ বিশেষ ভোক্তাগোষ্ঠীর খাদ্যভোগের পরিমাণ গড়ে একই সমান রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। ফলে খাদ্য ঘাটতির পুরো চাপটা বহন করেছে সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা। কিন্তু এ সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থাই ছিল গ্রামের গরিবদের জন্য যা একটা কিছু সামান্য ব্যবস্থা। জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালে যদি শহরে বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার রেশন মাত্র ২০ শতাংশ হ্রাস করা যেত তাহলেও মোট ১ লাখ ২ হাজার টন চাল বাড়তি পাওয়া যেত, যা সে সময়ে রিলিফ কাজের জন্য বরাদ্দকৃত চালের পরিমাণকে দ্বিগুণে উন্নীত করতে পারত। তাছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয় যদি ত্বরিত ব্যবস্থা নিত, দুর্ভিক্ষের চিহ্ন পাওয়ামাত্র রিলিফের ব্যবস্থা করত এবং বিশেষত সবচেয়ে পীড়িত এলাকাগুলোতে যেমন রংপুরের কুড়িগ্রামের ওপর বিশেষভাবে নজর দিত তাহলেও দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা সহজতর হতো। কুড়িগ্রামে যে সর্বাধিক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে সেটাও হয়তো রোধ করা সম্ভব ছিল।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আমাদের সরকারি খাদ্যনীতির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। খাদ্যশস্যের বিতরণ ব্যবস্থা এবং সেক্ষেত্রে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও বড় কৃষকের হাতে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিপদ সম্পর্কেও আমরা সচেতন হতে সক্ষম হয়েছি। বিশ্বব্যাংকের নীতি হচ্ছে খাদ্য ঘাটতির এ মোক্ষম হাতিয়ারকে ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা ও তাদের গড়ে তোলার জন্য সরকারকে চাপ দেয়া এবং অবশেষে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের পুরো ব্যবসাটাই এসব ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেয়া। তবে আরেকটি বিকল্প নীতি হচ্ছে ধীরে ধীরে খাদ্যশস্যের সমগ্র উদ্বৃত্তকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা। গ্রামের ক্ষমতা কাঠামো এবং ভূমির মালিকানা ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত না করেই কাজটা কতটুকু করা যাবে তা আরো বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ রাখে। এ সঠিক পরিপ্রেক্ষিতটি সামনে রেখে আমরা যদি চিন্তা করি তাহলে আমরা শুধু যে বিশ্বব্যাংকের খাদ্যনীতি-বিষয়ক পরামর্শবলির তাত্পর্য বুঝতে পারব তা নয়, আমরা দরিদ্র দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষের মৌল সামাজিক কারণগুলোকেও অনুধাবন করতে সক্ষম হব।