Published in আমাদের সময় on Tuesday 9 June 2020
ব্যাংকে ব্যাংকে তালাশ শীর্ষ ঋণখেলাপির
সরকার ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন ছাড় দিলেও শীর্ষ খেলাপিরা সে সুবিধা নিতে এগিয়ে আসেননি। ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে তারা লাপাত্তা। ব্যাংকগুলোর যে খেলাপি ঋণ রয়েছে তার বড় অংশই শীর্ষ খেলাপিদের পকেটে। ঋণের টাকা ফেরত না পেয়ে ব্যাংকগুলো তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। কিন্তু নানা কারণে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। যেসব খেলাপি সরকারের দেওয়া সুযোগ নেননি আবার ব্যাংকের টাকা পরিশোধও করছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছে সরকার। এ জন্য ফের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এবার প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ৫ খেলাপি এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এর আগে কয়েক দফায় ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ১০০ ও শীর্ষ ৩০০ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কোন ব্যাংক থেকে শীর্ষ খেলাপিরা কী পরিমাণ ঋণ আত্মসাৎ করেছেন সে তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। এ ছাড়া অনেক ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি নাম প্রকাশিত তালিকায় স্থান পায়নি। এ জন্য প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির তালিকা প্রথকভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে শীর্ষ ৫ খেলাপির কাছে পাওনার তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় ২৭ মে এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত রবিবার ওই চিঠি পাঠানো হয়। এতে আগামীকাল বুধবারের মধ্যে এসব তথ্য জানাতে বলা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, শীর্ষ ৫ খেলাপির নাম, তাদের কাছে পাওনা, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের মামলা নম্বর, আদালতের নাম ও মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানাতে হবে। দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, আমরা চিঠি পেয়েছি। সময়মতো জবাব দেওয়া হবে। আমরা চাই বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি সমাধান করা হোক। খেলাপিদের সব আইনগত ও সামাজিকভাবে বিচারের একটা ব্যবস্থা করা জরুরি। তা হলে এ দুঃসময়ে ব্যাংকগুলোর সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দাবি করে আসছে, আদালতে মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিপুল পরিমাণ ঋণ আটকে আছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বলে আসছে ব্যাংকগুলো। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এ তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে ব্যাংক খাতের ঘাড়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রণোদনার ৮২ শতাংশই দেবে তারা। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভঙ্গুর। ঋণ নিয়ে অনেকে খেলাপি হয়ে গেছে। শীর্ষ খেলাপিদের বড় অংশ প্রভাবশালী এবং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে টাকা আদায় করতে হবে। খেলাপিদের কাছে আটকে যাওয়া টাকা আদায় করতে পারলে ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। গত বছরজুড়ে খেলাপিদের ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঋণের সুদহার কমিয়ে করা হয় ৯ শতাংশ। এ ছাড়া সুদ মওকুফ এবং বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিলের সুযোগও অবারিত করা হয়। ওই বছরে সব মিলিয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। এর পরও আগের বছরের তুলনায় খেলাপি ঋণ ৪২০ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার সুযোগ দিলেও দুয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ শীর্ষ ঋণখেলাপি সুযোগ নিতে চাননি। টাকা ফেরত দেওয়ার নামে তারা নতুন করে ঋণ নেওয়ার পাঁয়তারা চালান। এর আগেও শীর্ষ খেলাপিদের ছাড় দেওয়া হয়। সেই ছাড় গ্রহণ করেও অধিকাংশ শীর্ষ খেলাপিরা আবার খেলাপির তালিকায় নাম লেখান।
শীর্ষ খেলাপিদের নাম সংগ্রহ ও তালিকা প্রকাশ নতুন নয়। এর আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও দুবার তালিকা সংসদে প্রকাশ করেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রীও গত বছরের ২২ জুন শীর্ষ ৩০০ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করেন। তাদের কাছে পাওনা ছিল ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। গত ২০ জানুয়ারি ৮ হাজার ২৩৮ কোম্পানির খেলাপি ঋণ ও তাদের পরিশোধিত ঋণের তথ্য প্রকাশ করা হয়। নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে তাদের কাছ পাওনা দেখানো হয় ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা।
ঋণখেলাপি গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিপুল অঙ্কের ঋণগ্রহণ ও খেলাপি হওয়া ঝুঁকি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো একই গ্রাহকের কাছে বিপুল পরিমাণ ঋণ তুলে দিয়েছে। এমনকি একটিমাত্র গ্রাহককে ৩০ থেকে ৩৫টি পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। শীর্ষ ৩ ঋণগ্রহীতা কোনো কারণে খেলাপি হয়ে গেলে ২১টি ব্যাংক দুর্বল হয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ৫৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের ৪৭ শতাংশ।