Originally posted in প্রথম আলো on 5 November 2023
মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পদে অপ্রতুল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে। কিন্তু নিন্দুকদের আশঙ্কা অসত্য প্রমাণ করে একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচিত হয়েছিল কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা, অভিনব ভাবনা, ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগে। আমরা ফিরে দেখছি বাংলাদেশের উজ্জ্বল সেসব মুহূর্ত।
গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার সময় দেশটিকে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অংশ ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ এবং শিল্প ও পরিষেবা খাতের অংশ ছিল খুব ছোট। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির অংশ এখন ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে শিল্প ও সেবা খাতের অংশ যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং ৫৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের সাফল্যের কথা বলতে গেলে রপ্তানিমুখী, তৈরি পোশাকশিল্পের কথাই সবার আগে চলে আসে। রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বৈশ্বিক এবং দেশীয় নীতিমালা এ ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। শূন্য দশকের গোড়ার দিকে সরকার কয়েকটি শিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ খাত (থ্রাস্ট সেক্টর) হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এর মধ্যে আছে সফটওয়্যার এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা এবং জাহাজনির্মাণ। রপ্তানিমুখী শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তা করেছে তৈরি পোশাকশিল্প খাত। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২১-২৫) রপ্তানিমুখী শিল্প উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
যেসব ক্ষেত্রে সরকারি খাতের করপোরেশনগুলোর বিনিয়োগ বেশি ছিল, এমন ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতকে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পনীতির উদ্দেশ্য কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে শিল্পায়নপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে খুবই দুর্বল জায়গা থেকে। ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশ একটি আমদানি-প্রতিস্থাপন শিল্পায়ন কৌশল অনুসরণ করে। ১৯৭১-৭৫ সালে সরকারি খাতের ওপর প্রাধান্য দিয়ে শিল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এবং বিদেশি শিল্পকে সরকারি খাতের বাইরে রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের সংশোধিত শিল্পনীতিতে বিদেশি এবং স্থানীয় উভয় ক্ষেত্রেই বেসরকারি বিনিয়োগকারীকে সরকারি খাতের করপোরেশনগুলোর সঙ্গে সহযোগিতায় শিল্প স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যেখানে সরকারি এন্টারপ্রাইজগুলো প্রধান অবদান রাখতে পারত।
১৯৭৫ সালের পর শিল্পনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বেসরকারি খাতের নেতৃত্বে উন্নয়ন ঘটানো। তাই উদার ঋণনীতির মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের শিল্পনীতি সরকারি খাতকে সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। যেসব ক্ষেত্রে সরকারি খাতের করপোরেশনগুলোর বিনিয়োগ বেশি ছিল, এমন ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতকে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
কাঠামোগত সমন্বয় নীতির অধীনে পরবর্তী দশকগুলোতে এসব শিল্পের বেসরকারীকরণ আরও গতি লাভ করে। ১৯৮২ সালের নতুন শিল্পনীতি এবং ১৯৮৬ সালের সংশোধিত শিল্পনীতি ও ১৯৯১ সাল থেকে বাণিজ্য উদারীকরণের পর্যায়ে শিল্পনীতিগুলো একটি বাজারভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দর্শনের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল, যা রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। সরকারি খাতের ভূমিকা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল।
১৯৯৯, ২০০৫ ও ২০১০-এর শিল্পনীতিগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততাকে বাড়ানোর জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছিল। এই নীতির একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বেসরকারীকরণ। এ ছাড়া শিল্প খাতের রপ্তানিমুখীকরণ, শিল্পের প্রতিযোগিতার উন্নতি এবং শিল্প উন্নয়নের জন্য সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল, যাতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপিতে) এই খাতের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যায়। শিল্পায়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকা, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার সংস্কার, বাণিজ্য উদারীকরণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উন্নয়ন, শিল্পায়নের সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, উৎপাদনশীলতা এবং পণ্যের মান বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদির ওপর জোর দিয়ে শিল্পনীতি ২০১৬ প্রণয়ন করা হয়েছিল।
একটি কার্যকর বাণিজ্যনীতি ছাড়া একটি সফল শিল্পায়ন সম্ভব নয়। তাই আমরা দেখতে পাই, শিল্পনীতিগুলো ক্রমে বাণিজ্যনীতির সঙ্গে পরিপূরক হয়েছে।
একটি কার্যকর বাণিজ্যনীতি ছাড়া একটি সফল শিল্পায়ন সম্ভব নয়। তাই আমরা দেখতে পাই, শিল্পনীতিগুলো ক্রমে বাণিজ্যনীতির সঙ্গে পরিপূরক হয়েছে।
১৯৯০-এর দশকের পরের শিল্পনীতিগুলো শিল্প খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বেশ কিছু কর্মসূচি চালু করেছিল। নীতি পদক্ষেপ এবং বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নীত করা হবে, এমন গুরুত্বপূর্ণ খাতের (থ্রাস্ট সেক্টরের) তালিকা প্রসারিত করা হয়েছে। এসব খাতকে বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা হয়েছে। কৃষিভিত্তিক এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটিরশিল্প মনোযোগ পেয়েছে। পূর্ববর্তী নীতির ধারাবাহিকতা হিসেবে, শিল্পনীতি ২০১৬-এর লক্ষ্য ছিল স্থানীয় চাহিদা মেটাতে এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রচারের জন্য আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প স্থাপন করা।
একটি কার্যকর বাণিজ্যনীতি ছাড়া একটি সফল শিল্পায়ন সম্ভব নয়। তাই আমরা দেখতে পাই, শিল্পনীতিগুলো ক্রমে বাণিজ্যনীতির সঙ্গে পরিপূরক হয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি বেশ পরিবর্তিত হয়েছে। বেশ কিছু বাণিজ্যনীতি সংস্কারের পর বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মধ্যে বাণিজ্য, বিনিময় হার, মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত আছে। রপ্তানি উন্নয়নের জন্য রপ্তানি বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার পরিকল্পনা করা, রপ্তানির গুণমান উন্নত করা, উচ্চ মূল্য সংযোজন রপ্তানিকে উদ্দীপিত করা, সংযোগ শিল্পের বিকাশ ঘটানো ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ধরনের সংস্কারগুলো তৈরি পোশাকশিল্প খাতসহ বেশ কটি খাতের জন্য উপকারী ছিল। এসব সংস্কারের মধ্যে ছিল রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্কমুক্ত উপকরণ আমদানি, ঋণ এবং অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনা, যেমন আয়করের ওপর ছাড় এবং আমদানিকৃত মূলধনি যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক রেয়াত প্রদান। ১৯৮০-এর দশক থেকে বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক হার হ্রাস করা হয়। অশুল্ক বাধাগুলোও অনেকাংশে অপসারণ করা হয়েছিল, যেমন আমদানির ওপর পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি আমদানি করা যাবে না, এ রকম সীমারেখা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশে শিল্পায়নের অগ্রগতির প্রভাব অনেকভাবেই পড়েছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি আয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এর অবদান উল্লেখযোগ্য। তবে এই খাতকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে, যাতে অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজন বাড়ে। এই রূপান্তর ঘটাতে হলে নীতিনির্ধারকদের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, নীতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে, দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পনীতির প্রয়োজন আছে, যা একবিংশ শতাব্দীর উদীয়মান বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে। তাই শিল্পনীতিকে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নীতি, যেমন অর্থ, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ নীতির সঙ্গে সমন্বয় করা উচিত। যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে, তাই এসব নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং আরও কৌশলগত এবং বৈশ্বিক নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, বিশেষ করে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।
দ্বিতীয়ত, পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলাদেশকে তার উৎপাদন পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এর জন্য আধুনিক খাতে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, বিনিয়োগবান্ধব নীতি থাকা সত্ত্বেও দেশি ও বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ খুব একটা বাড়ছে না। এটি আবারও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য শুধু নীতিই যথেষ্ট নয়। বিনিয়োগের সার্বিক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো উন্নত ও পর্যাপ্ত অবকাঠামোসহ অন্য সীমাবদ্ধতাগুলো অপসারণ করা এবং লালফিতার দৌরাত্ম্য ও দুর্নীতি দূর করা। এসব ব্যবসার খরচ বাড়ায় এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমায়। অবকাঠামোগত ঘাটতি কমানোর প্রয়াসে সরকার বেশ কিছু বড় প্রকল্প সম্পন্ন করেছে, কিছু চলমান। পদ্মা বহুমুখী সেতু এসব উদ্যোগের মধ্যে একটি, যা বিভিন্ন উপায়ে অর্থনীতির দক্ষতা বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক শটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য এসবের দ্রুত সমাপ্তি প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, দক্ষ ও চৌকস মানবসম্পদ সরবরাহ জরুরিভাবে প্রয়োজন। আধুনিক শিল্পায়ন নির্ভর করে মানবসম্পদের মানের ওপর। সেখানেই বিনিয়োগ আসে, যেখানে দক্ষ লোক থাকে। বিপুল তরুণ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে শিল্পের জন্য যোগ্য লোকের অভাব আছে। ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোর মানবসম্পদের ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভর করছে। অথচ দেশে বিপুলসংখ্যক বেকার যুবক আছে। শিক্ষা ও সক্ষমতা উন্নয়নে উচ্চতর সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন।
সবশেষে বলা যায়, ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে উত্পাদন এবং বিপণন একটি গতিশীল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসব শ্রমবাজারকে ব্যাহত করবে। বিভিন্ন কাজে মানুষের শ্রমের প্রয়োজন সংকুচিত হচ্ছে। তাই মানবসম্পদকে পুনর্দক্ষ ও উন্নত করতে হবে, যাতে তারা বড় আকারের শিল্পায়ন থেকে উপকৃত হতে পারে। একই সময়ে ক্ষুদ্র শিল্পায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং অন্যান্য সহায়তা দেওয়া উচিত। এটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং দারিদ্র্য দূর করতে সহায়তা করবে।
ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)