Published in আমাদের সময় on Friday, 24 February 2017
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত
সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে
জ্বালানি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এর ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশের উন্নীত হওয়ার পথে এ সিদ্ধান্ত অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়ও ভোগান্তি আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন কম। এর সঙ্গে তুলনামূলক সমন্বয় করে দেশেও তেলের মূল্য কমানো হলে মূল্যস্ফীতির মন্দ প্রভাব থেকে রক্ষা পওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
নতুন দাম বৃদ্ধি অনুযায়ী, শিল্প খাতে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার ৬ দশমিক ৭৪ টাকা; মার্চে এটি দাঁড়াবে ৭ দশমিক ২৪ টাকায় এবং জুনে হবে ৭ দশমিক ৭৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে বাড়ছে এক টাকারও বেশি। বাণিজ্যিক খাতে প্রতি ঘনমিটার বর্তমানে ১২ দশমিক ৬৩ টাকা। মার্চে এটি হবে ১৪ দশমিক ২০ টাকা, জুনে ১৭ দশমিক শূন্য ৪ টাকা। সিএনজিতে বর্তমানে ৩৫ টাকা ঘনমিটার। মার্চে হবে ৩৮ টাকা, জুনে ৪০ টাকা।
শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে পোশাকশিল্প থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তারা বলছেন, এখনই অধিকাংশ কারখানা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছে না, গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপও অনেক সময় থাকে না। অথচ প্রতিমাসে গ্যাসবিল ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ায় উৎপাদনখরচ বেড়ে যাবে। আর উৎপাদনখরচ বেড়ে গেলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের বাজারেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ায় পরিবহন ভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে। এতে অর্থনীতির পাশাপাশি জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কথা অনেক দিন ধরেই আলোচনায় ছিল, যার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো। দুই দফায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব দেশের সব সেক্টরের ওপরই পড়বে। ফলে মূল্যস্ফিতি বেড়ে যাবে। তাই এর সমন্বয় করতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম কমাতে হবে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, প্রতিবছরই জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। তাই বছরে দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ কোন যুক্তিতে নেওয়া হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, কী যুক্তিতে মূল্যবৃদ্ধি করা হলো, তা জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। কারণ এই মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদনসহ জনজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর মাশুল দিতে হবে সাধারণ মানুষের।
এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, দীর্ঘ চার বছর পর যখন বেসরকারি খাত চাঙ্গা হতে শুরু করে, ঠিক সে সময় দেশে জঙ্গিদের উৎপাত বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে জোর ধাক্কা লাগে। এর পরও ব্যবসায়ীরা সব সমস্যা ধৈর্য্যরে সঙ্গে মোকাবিলা করে কাজ করছেন। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী। বর্তমানে বিনিয়োগে বড় বাধা গ্যাস ও বিদুৎসংকট। এমন অবস্থায় নতুন করে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাত চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। এতে করে দেশের পুরো অর্থনীতিতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, দেশে প্রয়োজনীয় জ্বালানির ৭৪ শতাংশ পূরণ হয় প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এভাবে গ্যাসের দাম বাড়ালে শিল্প খাত বিপর্যস্ত হবে। এর ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে যাবে। বিশেষ করে পরিবহন খরচ, বাণিজ্যিক উৎপাদন ও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। তাই শুধু দাম বাড়িয়ে গ্যাস সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিল্প খাতে ব্যবহৃত ১৭ শতাংশ গ্যাসের বড় অংশই টেক্সটাইল মিল ও তৈরি পোশাকশিল্পে ব্যয় হয়। বিশেষ করে টেক্সটাইল মিলগুলো মূলত স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং ও ফিনিশিং ইউনিট পরিচালনা করে। গ্যাসের দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায় করা সম্ভব হবে না। ফলে সামগ্রিকভাবে এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নেমে বর্তমানে পোশাকের ন্যায্যমূল্য পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তদুপরি আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি রপ্তানি খাতকে বেকায়দায় ফেলবে। বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হবে এ খাত।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, বাণিজ্যিকসহ সব ধরনের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার ফলে দেশের বাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে একদিকে যেমন উৎপাদনব্যয় বৃদ্ধি পাবে, তেমনই উৎপাদন সক্ষমতাও হ্রাস পাবে। এতে করে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানিযোগ্য খাতগুলোর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।