Originally posted in কালের কন্ঠ on 2 July 2023
দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিশ্ববাজারে বিপুল চাহিদা থাকার পরও অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য দাম পাচ্ছে না ভোক্তা ও দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। দেশের কোথাও এবার সরকারের বেঁধে দেওয়া দর পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তবে গত কয়েক বছরের মতো এবার চামড়া নষ্ট হওয়া বা মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা খুব একটা চোখে পড়েনি। এ বছর গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা, ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে ৩০ টাকায়ও বিক্রি হয়নি।
চামড়ার দাম কমার কারণ হিসেবে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের দাবি, সাভারের চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স (অবশ্য পালনীয় শর্ত) অনুসরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। কেমিক্যাল, লবণ ও শ্রমিক মজুরিকেও দায়ী করছেন তাঁরা।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির অভিযোগ
সরকারের নির্ধারিত দর পায়নি উল্লেখ করে ঢাকা জেলা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পোস্তার আড়তদাররা ও চামড়াশিল্পের মালিকরা দেশের জাতীয় সম্পদ কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণের নামে প্রতারণা করেছেন। যাঁরা মাঠ পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহ করেন তাঁদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সভায় ডাকা হয়নি।
এ ছাড়া সরকার নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয় বাস্তবায়নের কোনো আইনগত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় এই সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকেন। কিন্তু কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণের পর এমন উদ্যোগ ছিল না। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং কোরবানিদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ছাগলের মোট চামড়ার ২৫ শতাংশ এবং গরুর মোট চামড়ার ১০ শতাংশ নষ্ট হয়েছে। ছাগলের চামড়া কেউ নেননি। এবার গরুর চামড়ার দর বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ হলেও ৩০ টাকায়ও বিক্রি হয়নি। চামড়ার নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়নের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় লবণযুক্ত চামড়ার নামে এক ধরনের প্রতারণা হয়েছে।
আড়তদারদের সংগঠন ও ট্যানার অ্যাসোসিয়েশন যা বলছে
কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের কাঁচা চামড়ার বড় বাজার পোস্তার আড়তদাররা গত তিন দিনে ৭০ হাজার পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন|
এ ছাড়া রাজধানী ও আশপাশের অন্য বাজারগুলো থেকে আরো ৭০ হাজার পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে।
এটি গত বছর ছিল প্রায় এক লাখ পিস। এ ছাড়া ট্যানারিগুলো সরাসরি আরো প্রায় পাঁচ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছে। ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার ৩০০ টাকায় কেনা হয়েছে এসব চামড়া।
এবার মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা ঘটেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে এবার এক কোটি ৪২ হাজার চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এবার কাঁচা চামড়া তেমন নষ্ট হয়নি। ঢাকায় ছয় লাখ পিস, বাকি চামড়া সারা দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে এসব চামড়া ঢাকায় আসবে ।
এ বছর সারা দেশে পশু কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর ৬ শতাংশ হারে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজার বাড়ে। সেই হিসাবে এবার কাঁচা চামড়ার বাজার প্রায় ৫০ কোটি টাকা বেড়ে ৮৭০ কোটি টাকা হবে। গত বছর কোরবানির বাজার ছিল ৮২০ কোটি টাকা।
বিটিএর তথ্য মতে, গত বছর (২০২২ সালে) আনুমানিক ৮২০ কোটি টাকার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৬০ লাখ গরুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এসব চামড়ার প্রতি পিসের গড় মূল্য এক হাজার টাকা। খাসি-বকরি ২০ লাখ পিস সংগ্রহ করা হয়, যার প্রতি পিসের গড় মূল্য ছিল ১০০ টাকা। মহিষের কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয় পাঁচ লাখ পিস, গড় মূল্য ছিল আড়াই হাজার টাকা। ভেড়ার চামড়া সংগ্রহ করা হয় পাঁচ লাখ পিস, গড় মূল্য ছিল ১৫০ টাকা। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে করোনাকালে কম চামড়া সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘গতকাল পর্যন্ত ট্যানারিগুলো চার লাখ পিস গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছে। এ বছর ৯০-৯৫ লাখ গরুর চামড়া সংগ্রহ করা হবে। লবণ ছাড়া ন্যূনতম দাম হবে ৮৫০ টাকা এবং লবণসহ প্রতি পিস এক হাজর ১৫০ টাকায় কেনা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, লবণ ও লবণযুক্ত চামড়া নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই। সরকারের নির্ধারিত দরেই চামড়া বেচাকেনা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কয়েক বছর ধরে চামড়ার একটি ভিত্তিমূলক মূল্য ধরে রেখেছে। সেটির ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয় প্রতিবছর চামড়ার একটি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এই মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়ার ভেতরে চামড়ার যে বাণিজ্যিক মূল্যের বিষয়টি রয়েছে, সেটি তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ফলে বাজারের ভিত্তিতে দরদাম করা এবং কাঁচামাল হিসেবে এর যে মূল্য থাকা উচিত, সে বিষয়গুলো এখানে উপেক্ষিত থেকে যায়। ফলে সব সময় এটির নিম্নমূল্য নির্ধারিত হয় এবং প্রকৃত বাজারমূল্য অনুসারে চামড়ার মূল্যায়ন হয় না।
এ বছর নির্ধারিত দরও যৌক্তিক হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে তা ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার সামান্য বাড়িয়ে বলা হয়েছে, ৬ শতাংশের মতো মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। অথচ এখন মূল্যস্ফীতি ৯.৯ শতাংশের মতো। সে বিবেচনা করলেও চামড়ার মূল্য হওয়ার কথা ছিল প্রতি বর্গফুট ৫২-৫৭ টাকা।
আগের চার বছরে চামড়ার দর নির্ধারণ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়, ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা, আর ঢাকার বাইরের ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। ২০২১ সালে নির্ধারণ করা হয় ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকা; ২০২০ এই দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। ২০১৯ সালে গরুর কাঁচা চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এবার বিক্রি হয়নি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫২১টি পশু
গত শুক্রবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট এক কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি পশু কোরবানি করা হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে এবার সারা দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। অর্থাৎ এ বছর ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫২১টি পশু অবিক্রীত রয়ে গেছে।