Published in দেশ রুপান্তর on Sunday 9 August 2020
শিল্প-অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির গবেষণা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বিপর্যয়সহ চামড়া খাতের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : গত ঈদের সময় কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেক ব্যবসায়ী চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছিল কিংবা ফেলে দিয়েছিল। প্রতি বছর প্রায় এক কোটি কোরবানি হলেও এবার করোনা মহামারীর কারণে প্রায় ৩০ শতাংশ কম কোরবানি হয়েছে। অথচ কোরবানির পশুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে এবার ২০ থেকে ২৯ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে। ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়াশিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করার পরও অনেক কম দামে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। কেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : বাংলাদেশে চামড়ার বাজারটি এতদিন পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিল না। এখনো পর্যন্ত সেই অর্থে তা উন্মুক্ত নেই। দেশের ভেতরেই চামড়া সংগ্রহ এবং বিক্রয় নির্ধারিত ছিল। সেক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্যে এটি বিক্রির ব্যাপার নির্ধারিত ছিল। স্থানীয় বাজারভিত্তিক হওয়ায় এবং রপ্তানি উন্মুক্ত না হওয়ার কারণে ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং ট্যানারি পর্যায়ে এক ধরনের কার্টালাইজেশনের অভিযোগ রয়েছে। এরাই মূলত সংঘবদ্ধভাবে চামড়া সংগ্রহ ও দাম নির্ধারণ করে থাকে। ব্যাপারটিকে ঠিক করার জন্যই মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আসে। কিন্তু দেখা গেছে, চামড়ার নির্ধারিত মূল্যের মাধ্যমে কখনোই প্রকৃত অর্থনৈতিক মূল্য পাওয়া যায় না। এটাকে কাঁচামাল বিবেচনা না করে অনেকটা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দানকৃত বিষয় হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা প্রায়ই লক্ষ করা যায়। এটা যে শিল্পের একটা কাঁচামাল, এটাকে যে অর্থনৈতিকভাবে বিবেচনা করা দরকার এবং সেই হিসেবে বাজারে এটার লেনদেন করা প্রয়োজন, সেই ধরনের কাঠামো এখানে পুরোপুরি অনুপস্থিত। এর সুবিধাটি এখানকার ট্যানারি পর্যায়ে এবং কারখানা মালিক পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তারা সবসময়েই নিয়ে এসেছেন। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ট্যানারি বা ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রাখা হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণেই এটা নির্ধারিত হয়। তাই তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করা, লেনদেনের বিষয়টি বিবেচনায় আনা এবং অন্য পক্ষগুলো যেমন- মৌসুমি ব্যবসায়ী, স্থানীয় পর্যায়ের সংগ্রাহক এবং মসজিদ-মাদ্রাসার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিষয়গুলো এখানে উপেক্ষিত থাকে। সর্বোপরি, এটাকে কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনা করে মূল্য নির্ধারণ করার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি।
এজন্য প্রতি বছরই কোরবানির ঈদের সময় চামড়ার মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে অনিয়ম দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ অনিয়ম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর একটা বড় কারণ হলো বৈশ্বিক বাজারে আমাদের চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাপীও চামড়ার চাহিদা কম হওয়া। এখন বাজারে আর্টিফিসিয়াল লেদার এসেছে, সিনথেটিক লেদার এসেছে। এগুলোর সঙ্গে ন্যাচারাল লেদারকে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। সুতরাং ন্যাচারাল লেদারকে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর আমাদের চামড়ার একটি বড় বাজার চীন। দেশটি আমাদের প্রসেসড লেদার সংগ্রহ করে থাকে। সেখানেও চামড়ার চাহিদা কমে গিয়েছে। এর একটা অন্যতম কারণ হলো কভিড-১৯ এর আগে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়ায় চীনা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এর ফলে চীনের চামড়া জাতীয় পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার করোনার কারণে ধনী দেশগুলোর মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তারা এ জাতীয় পণ্যের পেছনে কম ব্যয় করছে। সেজন্য চামড়ার চাহিদা কমে গিয়েছে।
এ বছরের জুন মাসের তথ্য অনুযায়ী, চামড়া জাতীয় পণ্যের রপ্তানিতে ২৬ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং জুলাই মাসেও ১৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছরের চামড়ার একটি বড় উদ্বৃত্ত এখনো রয়ে গেছে। তাই অনুমান করা গিয়েছিল, এ বছর চামড়ার চাহিদার একটি বড় ঘাটতি হবে। এজন্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি থেকে আমরা সরকারকে এ বিষয়ে নজর দিতে বলেছিলাম। সরকার অবশ্য আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য মূল্য কম নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আগ্রহ তেমন একটা দেখা যায়নি। তারপরেও বলা যেতে পারে চামড়ার চাহিদার ঘাটতি যতটুকু হয়েছিল, তার থেকে চামড়ার সংগ্রহ বেশি হয়েছে। এখন এক্ষেত্রে সরকারের কাঁচা চামড়া এবং ওয়েস্ট ব্লু রপ্তানির সিদ্ধান্ত কাজে আসতে পারে। কিন্তু চামড়ার মূল্য এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দুঃখজনক বলে আমরা মনে করি, সেটা হলো আন্তর্জাতিক মানের পণ্যের সাপ্লাই চেইনের বাজারে লেনদেন এরকম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরকম সাপ্লাই চেইনের লেনদেনের বাজারে কোনো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বায়াররা কাজ করতে চাইবে না। এটা এরকম একটা বাজার যেখানে বাকি রাখা হয়, আগের বছরের টাকা পরিশোধ করা হয় না, নির্ধারিত মূল্য থেকে অনেক কম দামে বিক্রি করা হয়, লেনদেনের কোনো ডকুমেন্টস রাখা হয় না, সেটার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আমরা যদি চামড়া খাতকে আন্তর্জাতিক মানের করতে চাই, তাহলে এর সমস্ত কাঠামোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। শিল্প কাঁচামাল হিসেবে চামড়ার সংগ্রহ ও লেনদেন, ব্যবস্থাপনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ- সবই একটি কাঠামোর মধ্যে আনা দরকার। আমরা সেই কাঠামো তৈরি না করে উল্টো পথেই হাঁটছি বলেই চামড়াকে কেন্দ্র করে ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
দেশ রূপান্তর : করোনা-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক চামড়াবাজার নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। সুযোগের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশও। চীনের বাজার এই খারাপ সময়েও চালু ছিল। দুনিয়ার ট্যানারি শিল্প যখন উৎপাদন প্রায় বন্ধ রেখেছে, তখন ইউরোপের কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে চীন। ইতালি-ভারত ইত্যাদি দেশের চামড়াশিল্প সংকটে। তখন বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়া পণ্যের বিরাট সুযোগ উপস্থিত হয়েছে করোনা এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু কারণে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : চামড়া খাতকে সম্ভাবনাময় বলার প্রবণতা সেই আশির দশক থেকেই শুরু হয়েছে। তখন তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি চামড়াকেও সম্ভাবনাময় হিসেবে প্রতিপন্ন করা হতো। কিন্তু এ খাতটি সম্ভাবনাময়ের কাতার থেকে বাস্তবে এক বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত হতে পারেনি। অথচ ব্যবসায়ীরা দুই বছর আগে ঘোষণা করেছিল যে, তারা ২০২১ সালের মধ্যে একে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত করবে। কিন্তু সেই লক্ষ্য তিমিরেই রয়ে গেছে। তাই আমি এ খাতকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেখার চাইতে এটাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাঠামো হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে চাই। কাঁচা চামড়ার সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, ট্যানারি পরিচালন ও পণ্য উৎপাদনের পরিবেশগত মানদণ্ড নিশ্চিত করা এবং রিটেইলারদের আমন্ত্রণ জানানোর মতো সক্ষমতা যদি তৈরি করা না যায়, তাহলে এ খাত সম্ভাবনার বৃত্তেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। আর এগুলো না করতে পারলে আমাদের কাঁচা চামড়া বিদেশে চলে যাবে বা তারা প্রক্রিয়াজাতকরণ করার পর সেটা সেখানে নিয়ে উচ্চ মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি লাভ করবে। তাই আমাদের এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত চামড়ার হিস্যাকে এর আন্তর্জাতিক বাজার অংশীদারিত্বের ১ শতাংশে উত্তরণ। বর্তমানে বৈশ্বিক বাজার প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলারের। এর ১ শতাংশে যদি আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারি, তাহলে আমরা প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি করতে পারব। বর্তমানে অবশ্য এটা ০.৩ শতাংশে রয়েছে।
দেশ রূপান্তর : অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়নি বলে বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়াজাত পণ্যের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমরা বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের মানসনদ অর্জন করতে পারিনি। কোনো দেশের এই সনদ না থাকলে চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সেই দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে উৎসাহ দেখায় না। আমাদের চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ সেটাই।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : আমাদের চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা একই সঙ্গে রপ্তানিও করতে চান আবার দেশীয় বাজারও ধরে রাখতে চান। কিন্তু এ রপ্তানির জন্য আন্তর্জাতিক যে পরিবেশগত মানদণ্ড রয়েছে, সেটা দেশীয় বাজারে করার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ কম। এ কারণে এখানকার অধিকাংশ উদ্যোক্তা এবং ট্যানারির মালিক যারা রয়েছেন, তারা দেশীয় বাজারকে প্রাধান্য দিতে চান এবং পরিবেশগত মানদণ্ড উন্নত করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে চান না। কেননা, এটা অনেক ব্যয়বহুল এবং এটা করলে তাদের মুনাফা কমে আসবে। এজন্য তারা কমপ্লায়েন্স বা পরিবেশবান্ধব শিল্প হিসেবে এটাকে গড়ে তোলা বা সাভার শিল্পনগরীর উত্তরণ ঘটানোর ব্যাপারে তৎপরতা দেখাতে চান না। তাই তারা দেশীয় বাজারমুখী রয়েছেন, কেননা সেখানে সরকার পরিবেশগত মানদণ্ড তৈরি করার জন্য চাপ দিচ্ছে না। আমরা মনে করি, দেশীয় বা আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য সরকারকে পরিবেশগত মানদণ্ড মেনে চলার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করা উচিত।
মনে রাখা দরকার, চামড়া খাতের লেবার স্ট্যান্ডার্ডের জন্য যে আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানদণ্ড রয়েছে, সেটি নিশ্চিত না করলে কোনো ব্র্যান্ড বায়ার চামড়াজাত পণ্যের জন্য বাংলাদেশে আসবে না। সেজন্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বায়াররা যে কমপ্লায়েন্স স্ট্যান্ডার্ড ডিমান্ড করে, যেটা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ মেনে চলে এবং অন্যান্য দেশ কমপ্লাই করে, সেটা অর্জনের জন্য সাভার শিল্পনগরীকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই ব্যবসায়ীরা খরচের ভয়ে বা বেশি মুনাফার জন্য এড়িয়ে যায়। এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এখানে ব্র্যান্ড বায়াররা পণ্য উৎপাদন করে, তবে তারা শর্ত দেয় যে সেটা আমদানি করা চামড়া হতে হবে। এ কারণে আমাদের প্রচুর দেশীয় চামড়া উদ্বৃত্ত থাকলেও বিপুল পরিমাণ চামড়া আমদানি করতে হয়। তাই ব্র্যান্ড বায়াররা যে ধরনের কমপ্লায়েন্স স্ট্যান্ডার্ড চায়, লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ যেটা মেইনটেইন করে, সেটা অর্জন না করতে পারলে ব্র্যান্ড বায়াররা এখানে আসতে চাইবে না। আর তারা যদি না আসে, তাহলে আমরা চামড়াশিল্পকে কখনোই কাঙ্ক্ষিত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত করতে পারব না।