Published in সময়ের আলো on Sunday 18 August 2019
কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবার মহাসংকট দেখা দিয়েছে। ভালো দাম না পাওয়ায় অনেকেই চামড়া নদীতে ফেলে দিয়েছেন এবং মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের মূল্যবান চামড়া শিল্প। বিষয়টি নিয়ে সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আরও আগে থেকে চামড়া রফতানির ঘোষণা দিতে হতো, তাহলে এ অবস্থা তৈরি হতো না। এ বিষয়ে তিনি আরও অনেক কথা বলেছেন। তার সাক্ষাৎকারের বিশেষ অংশ নিচে দেওয়া হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এসএম আলমগীর
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সাধারণত নিয়ন্ত্রিত বাজার, যেগুলোতে সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, সেসব ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের পর বাজার পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। যথাযথ মূল্যে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে কিনা সেগুলো তদারকি করতে হয়। চামড়া খাতের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছিল। যেহেতু এতদিন দেশের ভেতরে পর্যাপ্ত চাহিদা ছিল, সেহেতু চামড়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। বিক্রি হয়ে যেত সব চামড়া। তা ছাড়া সব সময় নির্ধারিত মূল্য যেহেতু তুলনামূলকভাবে ট্যানারি মালিকদের স্বার্থেই বা তাদের উপযোগী করেই নির্ধারণ করা হয়। ফলে যখন চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে তখন এতদিন খুব একটা সমস্যা হয়নি।
আরেকটি বিষয় হলো সরকার বাজারটি নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে, এতদিন রফতানিও করতে দেয়নি। ফলে এ বাজারের বিক্রেতা তারা এখানে চামড়া বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। সেখানেও এতদিন তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ দীর্ঘদিন থেকে চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণেই ছিল এবং বাজারে চামড়ার চাহিদাও ছিল। তবে এই বাজারে সব সময় একটি অভিযোগ শোনা যায় যেমন সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমানো হয়। সাধারণত নিয়ন্ত্রিত বাজারে এ রকম সুবিধাভোগী গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায় এবং তাদের এক ধরনের প্রবণতা থাকে, যেহেতু অন্য কোনো বাজারে এ পণ্য বিক্রর সুযোগ নেই কিংবা বাজারে তেমন কোনো কম্পিটিশন নেই, সেহেতু এই সুবিধাভোগী গ্রুপ নিজেদের স্বার্থে বাজারে প্রভাব বিস্তার করে। এ ধরনের সুবিধাভোগী গ্রুপ এ বাজারে আগেও ছিল, কিন্তু আগে তেমন একটা সমস্যা হয়নি কারণ চামড়ার চাহিদা ও জোগান মিলে মোটামুটি বিক্রি হয়ে যেত এবং ভালো মূল্য পাওয়া যাচ্ছিল।
তবে গত দু-তিন বছরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে থাকে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের পর বিদেশি ক্রেতাদের একটি প্রত্যাশা ছিল যে এখানে হয়তো মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেটি এখনও করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিদেশি ক্রেতারা যে প্রত্যাশা নিয়ে এখানে এসেছিলেন, সে প্রত্যাশা তাদের পূরণ হয়নি অনেক বিদেশি ক্রেতাই বাংলাদেশের বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে দেশের চামড়া ও চামড়া পণ্য রফতানিতেও। গত দুবছরের রফতানির তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের সার্বিক রফতানি কম হয় ১২ শতাংশ। এর মধ্যে প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানি কম হয় ২০ শতাংশ, চামড়াজাত পণ্যের রফতানি কম হয় ২২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও চামড়া খাতের রফতানির চিত্র প্রায় একই রকম ছিল। এ বছরে চামড়া খাতের মোট রফতানি কম হয়েছে ৬ শতাংশ। এর মধ্যে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার রফতানি কম হয়েছে ১০ শতাংশ, চামড়াজাত পণ্যেও রফতানি কম হয়েছে ২৭ শতাংশ এবং চামড়া জুতার রফতানি কম হয়েছে ৭ শতাংশের মতো। বিগত দুবছরে এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকার ফলে ট্যানারি মালিকরা বিগত বছরে যে চামড়া কিনেছে সারা দেশ থেকে তার বড় একটি অংশ তারা বিক্রি করতে পারেনি। এমনকি তারা বলছে ৪০-৫০ শতাংশ মজুদ রয়েছে পুরনো চামড়া। এই চামড়া বিক্রি করতে না পারায় ট্যানারি মালিকদের হাতেও পর্যাপ্ত টাকা আসেনি। তা ছাড়া চামড়া বিক্রি করতে না পারায় আগের বছর নেওয়া ব্যাংক ঋণও পরিশোধ করতে পারেননি ট্যানারি মালিকরা। ফলে একদিকে তাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই, অন্যদিকে ব্যাংকও তাদের নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না। এ চক্রের ভেতরে পড়ে ট্যানারি মালিকদের হাতে এবার পয়সার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বিগত বছরের মজুদ চামড়ার সঙ্গে যদি আমদানিকৃত চামড়া যোগ হয় এবং সিনথেটিক লেদারের ব্যবহার যদি বাড়তে থাকে, তাহলে প্রাকৃতিক চামড়ার চাহিদা কিন্তু কমে যাবে। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। এবারের ঈদে যে পরিমাণ চামড়ার জোগান হয়েছে তার সব কেনার মতো অবস্থা ট্যানারি মালিকদের নেই। কারণ গত বছরেরই অনেক চামড়া মজুদ আছে, গত বছর প্রায় ১১১ মিলিয়ন ডলারের চামড়া আমদানি হয়েছে, যার মূল্য ৯০০ কোটি টাকারও বেশি। সে সঙ্গে সিনথেটিক লেদারের ব্যবহার বাড়ায় প্রাকৃতিক চামড়ার চাহিদা কমেছে। তা ছাড়া মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি দেওয়ার হারও বাড়ে। এবারও অনেক বেড়েছে। বলা হচ্ছে এবার ১ কোটি ২০ লাখ পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। এত পরিমাণের চামড়া কেনার মতো অবস্থা বাজারে ছিল না। সুতরাং চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিতে হতো অনেক আগেই। সরকার এমন সময় চামড়া রফতানির ঘোষণা দিয়েছে, যখন আসলে বাজারে প্রভাব ফেলার কোনো সুযোগ ছিল না। আগে থেকে যদি এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো তাহরে এবারের কোরবানির চামড়ার বাজারে ইতিবাচক প্রভাব দেখা যেত।
তিনি বলেন, এবার চামড়া বাজারে যে পরিস্থিতি হয়েছে, কিছুদিন আগে ধান-চালের বাজারে যে রকম অবস্থা হয়েছিল তর সমরূপ। সমরূপ এ অর্থে বাংলাদেশে কৃষি এখন ঘাটতি কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত কৃষিতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আমদানি। চামড়ার ক্ষেত্রেও ঠিক একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই যে উদ্বৃত্ত চামড়া হচ্ছে এই পরিস্থিতি আগামী বছরগুলোতেও থাকবে, যদি না চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখতে না পায়। সহসাই যে রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি হবে সেটিরও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। সুতরাং আবার চামড়া উদ্বৃত্ত হবে এবং রফতানির প্রয়োজন হবে।
এবার অনেকটা বাধ্য হয়ে মাঠ পর্যায়ের ফড়িয়া বা আড়তদারদের চামড়া ফেলে দিতে হয়েছে বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়েছে। তাদের এভাবে চামড়া ফেলে দিতে হতো না, যদি চামড়ার সাপ্লাই চেইনে চামড়া সংগ্রহের মেসেজটি ঠিকমতো যেত। যেহেতু এবার ট্যানারি মালিকদেরও চামড়া কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ও প্রস্তুতি নেই, আবার আড়তদাররাও ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে আগে থেকে সে রকম কোনো প্রতিশ্রæতি পাননি চামড়া ক্রয়ের, সে কারণে আড়তদাররা ঠিকমতো চামড়া কেনেননি এবার। সে কারণে আগে থেকে একটা প্রস্তুতি নিতে হতো চামড়া রফতানির। ’৯০-এর দশক পর্যন্ত চামড়া রফতানি করা হতো। আমার মতে পুরো চামড়া যেহেতু ব্যবহারের মতো অবস্থা এখন নেই, সেহেতু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে চামড়া রফতানির অনুমতি দেওয়া দরকার। দুই বছর আগেই আমি চামড়া রফতানির কথা বলেছিলাম।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ট্যানারি মালিকরা চামড়া রফতানির বিরোধিতা করছেন। কিন্তু তাদের বিরোধিতার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তা ছাড়া কী কারণে তারা বিরোধিতা করছেন তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন না। তবে তারা বলছেন লবণযুক্ত চামড়া রফতানির অনুমতি দিলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ কমে যাবে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এবার হবে না বা নেই। সুতরাং তারা যে বলছে শিল্পের ক্ষতি হবে, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং রফতানির সুযোগ দিলে বাজারে যে সুবিধাভোগী গ্রপগুলো আছে তারা আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, বাজারে তখন একটি সুস্থ অবস্থা বিরাজ করবে। তখন চামড়া নিয়ে নেগোসিয়েশন হবে, ভালো দাম পাওয়া যাবে এবং ট্যানারি মালিকদের বাকিতে চামড়া কেনার প্রবণতাও দূর হবে। সরকার চামড়া রফতানির যে সুযোগটি দিয়েছে সেটি ওয়েটবøু পর্যন্ত বিস্তৃত করা দরকার। তবে তার আগে ঠিক করতে হবে দেশের ভেতরে কী পরিমাণে চাহিদা রয়েছে সেটা নিরূপণ করে তবেই যেন নির্দিষ্ট পরিমাণে চামড়া রফতানির সুযোগ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, এবারের চামড়া সংকটের জন্য সাভারের ট্যানারি পল্লীর অব্যবস্থাপনা ও অসম্পূর্ণ কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়টি দুই ভাগে ভাগ করে বলতে চায়। একটি শর্টটার্ম ইস্যু, অন্যটি লংটার্ম ইস্যু। ট্যানারি পল্লীর পরিবেশগত মানদন্ড ঠিক করা একটি দীর্ঘকালীন বিষয় এবং সমস্যাটি এ বছরের নয়, বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি। এখানে অবশ্যই বলতে হবে ট্যানারি পল্লীকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি করা হয়নি। এ বিষয়ে ট্যানারি মালিকদের অভিযোগ বিসিক এ কাজে অভিজ্ঞ না, তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে মালিকরাও দায় এড়াতে পারেন না। শুরু থেকে এটির সঙ্গে তাদেরও যুক্ত থাকা দরকার ছিল এবং বিশ্বের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা দরকার ছিল। তাহলে কিন্তু প্রকল্পের বাস্তবায়ন আরও ভালো হতো এবং এখানকার এ অবস্থার তৈরি হতো না।