Originally posted in সমকাল on 25 January 2024
দীর্ঘদিন ধরে চালের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য চাল। চালের দাম বাড়লে গণমানুষের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়। গত বছর যেখানে মোটা চালের দাম ছিল ৪৬-৫২ টাকা, তা মাসখানেক পার হতে না হতেই ৫০-৫২ টাকায় পৌঁছেছে। এক বছরের মধ্যে দাম বেড়েছে ৪ শতাংশ। চালের ঊর্ধ্বগতির এই প্রবণতা বাংলাদেশের জন্য একেবারেই অপ্রত্যাশিত, বিশেষ করে যখন আমন ধান চলে এসেছে। এ সময় দাম কিছুটা কম হওয়ার কথা। সেই বিচারে এখনও তা উচ্চমূল্য। ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি খাদ্য মজুত ছিল প্রায় ১৬ লাখ টন। তার মধ্যে চালের পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ টন। এই মজুতকে সন্তোষজনক বলে মনে করা যায়।
এ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে আমদানি করা চালের পরিমাণ সাড়ে ৫ লাখ টন এবং গমের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ টন। সব মিলিয়ে ১৪ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমন মৌসুমে প্রায় ৩ হাজার ৯৭২ টন চাল এবং ১০ টন ধান আমদানি হয়েছে। চালের আকারে তা দাঁড়াবে ৩ হাজার ৯৭৮ টনের মতো। বলা হচ্ছে, বেসরকারি উদ্যোগে আনা আরও ৯১ হাজার ৩১০ টন চাল বন্দরে অপেক্ষমাণ। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম প্রতি টন সিদ্ধ ৩৭৫ থেকে ৪৩৪ ডলারের মধ্যে সীমিত। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের বিচারে এভাবে দাম নির্ধারিত। এ অবস্থায় বর্তমান মজুত ও আমদানি সম্ভাবনা এবং মার্চ নাগাদ বোরো আসার বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে চালের দাম কিছুটা কম হওয়া যৌক্তিক ছিল।
এটিও ঠিক যে, বৈশ্বিক দিক থেকে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। চাল ও গম আমদানি করার ক্ষেত্রে সে প্রভাব কিছুটা আছে। যাই হোক, শীতকালের এই মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্য আরেকটু কম থাকার কথা। কিছুদিন আগ পর্যন্তও চালের ঊর্ধ্বগতির কারণের পেছনে একটা যৌক্তিকতা ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের উচ্চমূল্যের কারণে বাংলাদেশের চালের বাজারে তার প্রভাব পড়েছিল।
গম বা আটার উচ্চমূল্যের সঙ্গে চালের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, দুটিকে নিকট বিকল্প ভাবা হয়। একটা পণ্যের দাম বাড়লে অন্যটি ভোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই গমের দাম বাড়লে চালেরও দাম বাড়ে। সাধারণত আরেকটি বিষয়ও হয়ে থাকে। অন্যান্য দ্রব্য বা খাবারের দাম বেড়ে গেলে (যেমন মাছ-মাংসের মতো আমিষ জাতীয় খাবার) তখন সবজি জাতীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অর্থাৎ আমিষ জাতীয় দ্রব্যের দাম বাড়লে আমরা শর্করা দিয়ে উদরপূর্তি করতে চাই। এভাবেও চালের দাম বেড়ে যায়। এর মানে হলো, চালের উচ্চমূল্য শুধু চাল ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে না। বরং অন্যান্য দ্রব্যের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে মানুষ নিরুপায় হয়ে শুধু চালের সঙ্গে ন্যূনতম কিছু একটা দিয়ে ক্ষুধা মেটানোর চেষ্টা করে, বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষ। সেটির কারণেও বাজারে মোটা চালের চাহিদা এক মাসের ভেতরে ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি মাছ-মাংসসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। রুই মাছের দাম ৪ শতাংশ কমলেও ইলিশের দাম ১০ শতাংশ, গরুর মাংসের দাম ২ শতাংশ, খাসির দাম ২ দশমিক .৬ শতাংশ, মুরগির দাম ২ দশমিক ৭ শতাংশ, দেশি মুরগির দাম দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এক মাসের বিবেচনায় এসব পণ্যের দামও বেড়েছে। এ ধরনের পণ্যের দাম বাড়লেও মানুষ শর্করার দিকে ঝোঁকে। ক্ষুধা মেটানোর জন্য ভোক্তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই প্রক্রিয়ায়ও পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
এসবের বাইরে বাজারবহির্ভূত কারণও রয়েছে। চালের প্রক্রিয়াজাতকরণে বড় বড় চালকল মালিক রয়েছে। বাজারে চালের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ তারা সরবরাহ করে থাকে। গবেষণায় উঠে এসেছে, চালকল মালিকরা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চাল নিয়ন্ত্রণ করে।
চাল আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় ১৫-২০ শতাংশও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। চালের বিকল্পও তেমন কিছু নেই। সুতরাং বাজারে অল্প পরিমাণেও চাল কমে গেলে কিংবা চালকলের মালিকদের হাতে ১৫-২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, তার মাধ্যমে পণ্যমূল্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। দ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে মজুত ও সরবরাহ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে তাদের প্রভাব থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এ ধরনের সরবরাহ চক্র নিয়ম-কানুনের মধ্যে পরিচালিত হওয়া দরকার। পুরো সরবরাহ চক্রে যারা যুক্ত তারা প্রত্যেকেই জবাবদিহির মুখোমুখি হবে। তাদের অধিকাংশই রেজিস্টার্ড হতে পারে। চলমান রেজিস্ট্রেশনগুলো এখন পর্যন্ত কেবল ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার মতোই রেজিস্টার্ড। কিন্তু আমরা মনে করি, সাপ্লাই চেইনের ভিত্তিতে রেজিস্ট্রেশনের বিধান করা দরকার। অর্থাৎ যে চাল-সংক্রান্ত ব্যবসা করবে; উৎপাদক পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত পাইকার, আড়তদার, চালকল মালিক, ব্যাপারী, ডিলার বা মজুতদার প্রত্যেকের চাল-সংক্রান্ত আলাদা লাইসেন্স থাকতে হবে। এই লাইসেন্সধারী ছাড়া কেউ চালের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে না; সেটি পাইকারি হোক, মজুত হোক কিংবা বিপণন। লাইসেন্সধারী এসব ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সবার তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত সংরক্ষণ করা জরুরি, যাতে এগুলোর যথাযথ তদারকি করা যায়।
ইতোপূর্বে সরকার কিছু উদ্যোগের ফলও পেয়েছে। যেমন ২০১৪ সালের আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে মতিয়া চৌধুরী যখন কৃষিমন্ত্রী ছিলেন, তখন সার ডিলারদের ক্ষেত্রে তিনি বেশ কড়া নজরদারি অবস্থা নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ রেখেছিলেন। এ সময় তিনি সরাসরি কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এসব কারণে বাজারে ডিলার ও মজুতকারীরা খাদ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করতে পারেনি এবং দ্রব্যমূল্য অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। উদ্যোগটি কার্যকর করতে গিয়ে জেলা পর্যায়ের প্রতিটি ডিসি অফিসকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। জেলা পর্যায়ে যারা চাল ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত হবে, তাদের প্রত্যেকের তথ্য-উপাত্ত জেলা পর্যায়ে সংরক্ষিত থাকবে। ব্যবসায়ীরা চালের মজুতের পরিমাণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মজুত, বিক্রি, চালের মূল্য-সংক্রান্ত প্রতিদিনের তথ্য-উপাত্ত সপ্তাহ ভিত্তিতে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠাবে। এ কাজটি তিনি সারের ক্ষেত্রে করেছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছিল, মজুত করে রাখা কিংবা পরে বিক্রি করা এবং বেনামে রাখা– এ ধরনের হিসাব করতে গিয়ে অনেকে ধরা পড়েছিল। এতে মজুতের প্রবণতা কমে আসছিল।
আমরা মনে করি, জেলা পর্যায়ে এ ধরনের মনিটরিং প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা ভোক্তা অধিকারের কিছু খুচরা উদ্যোগ দেখতে পাই। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ দিয়ে পুরো সরবরাহ চক্রে সুশাসন আনা কষ্টকর। আমার মনে হয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যদি জেলা পর্যায়ে যৌথভাবে ডিসি অফিসের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করে কিংবা এককভাবে কোথাও কাজ পরিচালনা করে (তদারকি, নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠানো, গুদামগুলোর হিসাব সঠিক আছে কিনা, যাচাইয়ের সুযোগ রয়েছে) তাহলে সমস্যাগুলো নিরসন করা সম্ভব। বেনামে কিংবা রেজিস্টার্ড না হয়ে পণ্য মজুত করলেও তা এখান থেকে বেরিয়ে আসবে। এভাবে নজরদারি করলে সুশাসন আনা এবং বাজারে অযাচিত ঘটনাগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব।
মোদ্দা কথা, চালের ক্ষেত্রে খাদ্য মন্ত্রণালয়, উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বিপণনের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং এই তিনটি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে অন্যান্য সাপ্লাই চেইনের মতো ধান বা চালের পুরো সরবরাহ চেইনকে একক সাপ্লাই চেইন বিবেচনা করতে পারে। সংশ্লিষ্ট সব এজেন্সিকে রেজিস্টার্ড করা এবং তাদের নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত জেলা পর্যায়ে পাঠানো এবং সেগুলোর ভিত্তিতে নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা চালু করা গেলে ধীরে ধীরে সাপ্লাই চেইনগুলোতে বাজারবহির্ভূত কারণগুলো (মুনাফার প্রবৃদ্ধি, পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা) অনেকটুকু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)