Published in
on Saturday 18 May 2019চাল উদ্বৃত্ত, দামও কম, তবু আমদানি
দেশে এখন চাহিদার তুলনায় বেশি ধান-চাল রয়েছে। বোরো ধান কাটা শেষের দিকে। দামও কমছে। উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে ধান বেচতে হচ্ছে কৃষককে। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সরকারি-বেসরকারিভাবে গত ১০ মাসে ২ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৩ লাখ ৮০ হাজার টন চাল।
২০১৭ সালের মে মাসে হাওরে আগাম বন্যায় ফসলহানির পর সরকার চালের আমদানি শুল্ক উঠিয়ে দেয়। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, এই ক্ষতির ফলে ঘাটতি হবে ১০ লাখ টন চালের। কিন্তু গত দুই বছরে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। গত নভেম্বরে সরকার ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক পুনর্বহাল করে। এতে চাল আমদানি কমলেও বন্ধ হয়নি। বাড়তি উৎপাদন ও আমদানির চাল বাজারে চাপ তৈরি করছে, ফলে দাম নিয়মিত কমছে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বিপদে পড়েছেন কৃষকেরা। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ-কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি হিসাব বলছে, দেশে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এই বাড়তি চাল রপ্তানির বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেন দেশে চাল আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, মূলত উদ্বৃত্ত চালের কারণেই ধানের দাম বাড়ছে না। ১০-১৫ দিনের মধ্যে বোরো ধান পুরোপুরি কাটা হয়ে যাবে। এর মধ্যে যদি দেশে কোনো দুর্যোগ না হয়, তাহলে সরকার চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেবে। এতে ধানের দাম বাড়তে পারে।
সরকার যেখানে চাল রপ্তানির চিন্তা করছে, সেখানে কেন চাল আমদানি হচ্ছে, এর কারণ জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী বলেন, দেশের পাঁচ তারকা হোটেলে ও ধনীরা সুগন্ধি-সরু চাল খেতে পছন্দ করে। তাদের প্রয়োজনে এসব চাল আমদানি হতে পারে। তবে আমদানি বেশি হয়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে সরকার আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে আরও বাড়ানোর কথা চিন্তা করবে।
২০১৬ সালে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ অর্থ পাচার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩-১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যত চাল বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তার আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ডলার। অথচ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি প্রায় ৫০০ ডলার। ওই বাড়তি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে সিপিডির প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়।
- দেশে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে
- বাড়তি চাল রপ্তানির বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে
- গত দুই বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি
- কেন দেশে চাল আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন
এ ব্যাপারে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উচিত হবে ধান-চালের সংগ্রহ দ্রুততর করা ও সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানো। এতে ধানের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আর আমদানি বন্ধে শুল্কের পরিমাণ আরও বাড়ানো যেতে পারে। চাল আমদানির নামে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত।
সরকারের সংগ্রহের প্রভাব বাজারে নেই
সরকার এ বছরের মে মাস থেকে ১৩ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছে। চলবে তিন মাস। মে মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২৬৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। বেশির ভাগ চালকলমালিক বাজার থেকে ধান কেনা শুরুই করেননি। কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁসহ বেশির ভাগ বড় মোকামে ধান-চাল কেনা প্রায় বন্ধ রয়েছে। চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা পুরোনো চাল তাঁরা সরকারি গুদামে দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার এই সময় দেশের ১৬ হাজার চালকলের প্রায় সবই চালু থাকে। কিন্তু বর্তমানে চালু রয়েছে প্রায় ১ হাজার চালকল। কারণ হিসেবে চালকলমালিকেরা বলছেন, তাঁদের কাছে থাকা পুরোনো চালই বিক্রি হয়নি। ফলে তাঁরা আর নতুন করে ধান কিনছেন না।
সরকারি সংগ্রহের কোনো প্রভাব ধান-চালের দামের ওপরে না পড়ার কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকার মূলত কেনে চাল আর তা চালকলমালিকদের কাছ থেকে নেয়। চালকলমালিকেরা ফড়িয়াদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে। সরকার প্রতিবছর ১ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কোনো সময়ই তা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হয় না। ফলে সব সময় বড় কিছু চালকলমালিক ধান-চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে সরকারকে দেখানো উচিত ছিল তারা ধানের দাম বাড়ানোর জন্য তৎপর। কিন্তু সরকার এখনো চালকলমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে জানতে পর্যন্ত চায়নি যে কেন তারা ধান কিনছে না। ধান না কিনে পরিকল্পিতভাবে চালকলমালিকেরা দাম কমাচ্ছেন কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।
বাম্পার উৎপাদনে বাম্পার লোকসান
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ চলতি মাসে বিশ্বের দানাদার খাদ্যের বৈশ্বিক উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ বছর উৎপাদন হতে পারে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টন চাল, যা বিশ্বের প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে এ বছর বোরো মৌসুমে ১ কেজি চাল উৎপাদনে ৩৬ টাকা খরচ পড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল, দেড় লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং দেড় লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে। কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা দরে সেদ্ধ চাল, ৩৫ টাকা দরে আতপ চাল এবং ২৬ টাকা দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। গত ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ধান-চাল সংগ্রহ চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। অর্থাৎ চালের সংগ্রহ মূল্যেই কৃষকের জন্য কোনো লাভ ধরা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে চালের দাম কম। এই কয়েক মাস আগেও দাম এত কম ছিল না। দাম বেড়ে গেলে সরকারের অনেক কিছু করার থাকে। কিন্তু কমে গেলে ঠেলে দাম ওঠানো কঠিন। দেশে যখন প্রচুর চাল আমদানি হচ্ছিল, তখনই ভাবা উচিত ছিল কৃষকের ধান উঠলে দাম কমে যেতে পারে। এখন সরকারের উচিত হবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ধান-চাল সংগ্রহ দ্রুত বাড়ানো। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ধান সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।
Click here to read the news in English.
সংবাদটি ইংরেজি-তে পড়তে ক্লিক করুন।