Originally posted in প্রতিদিনের সংবাদ on 18 August 2022
২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক রপ্তানির পরিকল্পনা ১০০ বিলিয়ন ডলার
গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে এবং সরকারের নীতি সহায়তা পেলে বৈশ্বিক মন্দার মাঝেও একটি ভালো অবস্থানে থাকবে দেশের তৈরি পোশাক খাত। এমনটিই ভাবছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকরা। শুধু তাই নয়, আগামী ৮ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটি ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার। সংগঠনটির ধারণা, ২০৩০ সালে পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬০ লাখে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, ‘বর্তমানে আমরা যেসব পোশাক রপ্তানি করি, তার সঙ্গে বেশি মূল্য সংযোজিত হয়তো এমন পোশাক উৎপাদনের টার্গেট নিয়েছি। সে সঙ্গে আমরা টেকনিক্যাল টেক্সটাইল রপ্তানিতেও জোর দিচ্ছি। আমরা আশা করছি, ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।’ তিনি জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ২০টি লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে টেকসই পোশাক শিল্প গড়তে একটি রোডম্যাপ তৈরির কাজ চলছে। তিনটি আলাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেই কাজ করছে।
যদিও বিদায়ি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ, ১০ হাজার কোটি ডলারের লক্ষ্য অর্জনে আগামী ৮ বছরের মধ্যে বাড়তি ৫ হাজার ৭৮৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করতে হবে।
এর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বা ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বিজিএমইএ। ২০১৪ সালে এই লক্ষ্য ঘোষণার পর একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছিল সংগঠনটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করোনাসহ নানা কারণে লক্ষ্যমাত্রাটি অর্জিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম জানান, বাজার সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করতে চান তারা। এজন্য একটি রোডম্যাপ তৈরির কাজ এখন চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবাই ভালোভাবে কাজ করতে পারলে এটা সম্ভব। ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এটা সম্ভব হবে। এটা অসম্ভব কোনো ব্যাপার না। তিনি বলেন, ‘প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও গত কয়েক বছরের প্রবৃদ্ধিই এই খাতের উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য নির্ধারণে সাহসী করে তুলেছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, এ বছর ১১ বিলিয়ন ডলার বেশি শিপমেন্ট হয়েছে, যেটা আমাদের টার্গেটের কাছাকাছি। আমরা চেষ্টা করব আগামী ৮ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট অর্জন করতে। সম্প্রতি তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের এই সংগঠনটি টেকসই পোশাক শিল্প গড়তে ২০টি লক্ষ্য ঘোষণা করে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসব লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে চায় সংগঠনটি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে পোশাকের রপ্তানি ১০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া।
বিজিএমইএর ২০টি লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম কার্বন নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমানো, টেকসই কাঁচামাল ব্যবহার ৫০ শতাংশে উন্নীত করা, শোভন কাজের পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করা, পানির অপচয় ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা, ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার শতভাগে নামিয়ে আনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার ৩০ শতাংশ হ্রাস, নারী-পুরুষের সমতা শতভাগ নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান ৬০ লাখে উন্নীত করা, উৎপাদনশীলতা ৬০ শতাংশে উন্নীত করা, পৃথিবীর সব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি করা, শতভাগ সুশাসন নিশ্চিতকরণ, মোট কারখানার ৮০ শতাংশ পরিবেশবান্ধব করা, ১০ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি অর্জন ইত্যাদি। এগুলোকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) ১৭টি গোল বা লক্ষ্যের সঙ্গেও সমন্বয় করে করা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকের হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২১ সালের হিসাব এখন প্রকাশ না করলে বাংলাদেশের হিস্যা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে মনে করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে সেটি ১০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করছেন বিজিএমইএ’র নেতারা।?
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ি অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। সংগঠনটির নেতারা মনে করেন, চীন থেকে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছে। আগামী ৮ বছরে এর পরিমাণ আরো বাড়বে। চীন যেহেতু পরিবেশগত কারণে টেক্সটাইল থেকে সরে আসছে, ফলে সেগুলো সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের দিকেই আসবে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই পোশাক খাতে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও নতুন নতুন বাজার খোঁজার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। বিজিএমইএ বলছে, উৎপাদনশীলতা ৬০ ভাগ বাড়িয়ে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সব দেশেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি করতে চান তারা।
পোশাক খাতের মালিকদের দাবি, বাংলাদেশেই এখন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরিবেশবান্ধব কারখানা কাজ করছে। বিশেষ করে ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ও ২০১৩ সালের এপ্রিলে ঢাকার কাছে সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এক হাজারের বেশি শ্রমিক মারা যান। এরপর বেশ কয়েক বছর ধরে পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিয়ে কাজ করেছে ‘অ্যাকর্ড’ ও ‘অ্যালায়েন্স’-এর মতো বিদেশি ক্রেতাদের জোটগুলো।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক। বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কারণে আমাদের আরো ৫ থেকে ৬টি পণ্য বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, ২০৩০ সালের আগেই পোশাক রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে একের পর এক শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। পণ্য উৎপাদন বাড়ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিতে হলে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ পোশাক খাতকে মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তখন আর আমরা ইউরোপসহ নানা বাজারে কোটা মুক্ত সুবিধা পাব না। একই সঙ্গে কমপ্লায়েন্স ইস্যু আরো শক্তভাবে সামনে আসবে। এছাড়া দেশের রাস্তাঘাট, বন্দর, পরিবহন ও জ্বালানির ওপরেও লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করবে। এর বাইরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এছাড়া চীন, ভিয়েতনাম ও তুরস্কের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগোতে হবে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বেশি দামের পণ্যগুলো এখনো আমরা করতে পারছি না, যেগুলো চীন ও ভিয়েতনাম করে থাকে। এগুলো করতে না পারলে লাভের মার্জিন বাড়বে না। আর লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বাজার বহুমুখীকরণ করতেই হবে।’