দৈনিক প্রথম আলো
প্রাক্-বাজেট আলোচনায় যেসব বিষয় ঘুরেফিরে আসছিল, তার প্রায় সব কটিরই প্রতিফলন দেখা গেল বাজেট ঘোষণায়। বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনের একটি বিস্মৃত বিবরণ আছে বক্তৃতায়। তবে সংযুক্ত সারণি থেকে দেখা যায়, সেখানে ‘হচ্ছে হবে’ এ রকম উল্লেখই বেশি।
আগামী অর্থবছরের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এটি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রাক্কলনকে অনুসরণ করে করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় প্রবৃদ্ধি কোনো দিন অর্জিত হয়নি এবং একটি উৎক্রমণকালীন অর্থবছরে তা অর্জিত হবে, সেটি একটি চরম উচ্চাশা, বিশেষ করে যখন তার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ দৃশ্যমান নয়।
অপর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার যেটা ৭ শতাংশে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, যখন এপ্রিল ২০১৩-এ তা ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি আরও কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরবর্তী মুদ্রানীতিতে কী কৌশল ঘোষণা করে তা দেখার বিষয়। কিছুটা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কেমন থাকে তার ওপর।
তবে বাজেট বিশ্লেষণের সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য দিক হচ্ছে বাজেটের মূল্যকাঠামো অর্থাৎ আয়-ব্যয় ও ঘাটতি অর্থায়ন। এ ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করি, আগামী অর্থবছরে মোট ব্যয় বৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ আর মোট রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয়েছে ২০ শতাংশের মতো। রাজস্ব বৃদ্ধি সঠিকভাবেই ব্যয় বৃদ্ধির চেয়ে বেশি ধরা হয়েছে। আবার ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির হার কাঙ্ক্ষিতভাবে অন্যান্য চলতি ব্যয় বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি ধরা হয়েছে। কিন্তু বাহ্যিকভাবে সঠিক এই কাঠামোকে আরেকটু নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করলে বেশ কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়। যেমন ব্যয়ের ক্ষেত্রে ২০১২-১৩ অর্থবছরের মূলত বাজেটে এ রকম ধারারই বরাদ্দ ধরা হয়েছিল। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এসে দেখা গেল, কার্যত অনুন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির চেয়ে অনেকটা বেশি এবং তার ফলে মোট দেশজ আয়ের অংশ হিসেবে প্রথমটি বৃদ্ধি পায় এবং দ্বিতীয়টি কমে যায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্যয় কমানোর এই প্রবণতার পরিবর্তন হবে, তার নিয়শ্চতা তো দেখি না।
অপরদিকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও জটিল। ২০১২-১৩ সংশোধিত বাজেটে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। মূল বাজেটের মোট অঙ্কে ও তার বিন্যাসে। কিন্তু আমরা জানি, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থেকে যাবে। সে ক্ষেত্রে ২০১৩-১৪ সালে মোট রাজস্ব বৃদ্ধির হার আরও বাড়াতে হবে এবং যা হবে বাস্তবের সঙ্গে সংগতিহীন। তবে রাজস্ব কাঠামো দেখে মনে হচ্ছে, সরকার প্রত্যক্ষ করের ভূমিকা সঠিকভাবেই আরও বাড়াতে চাইছে। আমদানি শুল্কের অনুমিতি সঠিকভাবেই কিছুটা কম দেখে মনে হচ্ছে, আগামী বছরও আমদানি পরিস্থিতি তথা বিনিয়োগ কিছুটা দুর্বল থাকবে বলে বাজেটপ্রণেতারা মনে করছেন। এককথায় ২০১৩-১৪ সালের বাজেট কাঠামোতে উল্লিখিত রাজস্ব আদায় ও রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, উভয় ক্ষেত্রেই তা বেশি ধরা হয়েছে। অর্থাৎ বহু বরাদ্দই বাস্তবে খরচ হবে না, আবার বহু রাজস্ব আদায় হবে না। ফলে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
তবে ২০১৩-১৪ সালের জন্য অনুমিত বাজেট ঘাটতি নিয়ে দু-একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক অনুদান ও ঋণপ্রাপ্তি যা ধরা হয়েছে তা উচ্চাশার প্রতিফলন। তার পরও সরকারকে বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া ঋণের ওপর বড়ভাবে নির্ভর করতে হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকঋণের অবদান ধরা হয়েছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ, যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সেটি ধরা হয়েছে ৪৭ শতাংশ; দেখা যাক শেষ পর্যন্ত তা কত গিয়ে দাঁড়ায়। তবে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, বর্তমান সরকারের আমলে অর্জিত পরিমাণগুলো ক্রমান্বয়ে প্রাক্কলনের কাছাকাছি চলে এসেছে, যা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গুণগত মানোন্নয়নই ইঙ্গিত করে।
অর্থনৈতিক খাতগুলোর বরাদ্দ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মোট ব্যয় জনপ্রশাসন খাতে যাবে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ, এর মূল কারণ অর্থ বিভাগে শেয়ার মূলধন, ইক্যুইটি ও মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ ইত্যাদির জন্য বড় অঙ্কের বরাদ্দ প্রদান। এর পরই রয়েছে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক কালে ঋণ গ্রহণের পরিণতি, এর পরই আছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যে শিক্ষা ও প্রযুক্তি (১১ দশমিক ৭ শতাংশ)। তবে লক্ষণীয় কৃষি ও তৎসংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ ও অনুপাত—দুটিই কমেছে। এর মূল কারণ ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তা কমে আসা। তবে বছর শেষে ভর্তুকি কী দাঁড়ায়, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দামের পরিপ্রেক্ষিতে তা হবে দেখার বিষয়। ২০১৩-১৪ তে পরিবহন খাতকে দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি (২৩ দশমিক ৩ শতাংশ), অবশ্য তার সিংহভাগই হচ্ছে পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ। বলা বাহুল্য, পদ্মা সেতুর টাকা খরচ না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই এই বরাদ্দের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
রাজস্ব পদক্ষেপগুলোতে আয় বাড়ানোর ভীষণ চেষ্টা আমরা লক্ষ করি। সে ক্ষেত্রে একমাত্র তালিকাভুক্ত টেলিফোন কোম্পানির মুনাফার ওপর কর বৃদ্ধি প্রশ্নের জন্ম দেবে।
অপরদিকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপের মুখে বেশ কিছু সুবিধা প্রদান লক্ষ করা যায়। আর আছে বিনিয়োগ চাঙা করার জন্য কিছু প্রণোদনা প্রদানের চেষ্টা, যার প্রকৃত সুফল প্রশ্নসাপেক্ষ।
তবে জনতুষ্টির মূল জায়গাটি সম্পদ বরাদ্দের চেয়ে রাজস্ব পদক্ষেপে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন শেয়ারবাজারে সমর্থন, আয়করের ন্যূনতম সীমা বাড়ানো, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে করের ন্যূনতম পরিমাণ কমানো।
লেখক: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ গবেষক