Originally posted in সমকাল on 15 June 2024
আমাদের নতুন অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট এমন সময়ে পেশ করেছেন, যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপের মধ্যে। অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাজেট প্রণয়নের কাজটি করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় কৃতিত্বের দাবিদার হতেই পারে। তবে এ কথা বলতেই হবে, প্রস্তাবিত বাজেট চলমান অর্থনৈতিক সমস্যার গভীরতা মূল্যায়ন করতে পারেনি। তাই বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা তৈরি এবং সমস্যাবলি দূরীকরণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দিন পর্যন্ত একটি অবস্থায় ছিল। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, নিম্ন মূল্যস্ফীতি, অধিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি– এসব ক্ষেত্রে গত দুই বছরে নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী। সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাজেটে মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও সাধারণ মানুষের স্বস্তির দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু ব্যতিক্রমী সময়ের বাজেট হওয়ার বদলে প্রস্তাবিত বাজেট হয়েছে গতানুগতিক।
বাজেটের আকার ও ঘাটতি
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ১৪.২ শতাংশের সমান। এ বাজেটের পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৪.৬
শতাংশ বেশি।
চলমান অর্থবছর ২০২৪-এ বাজেট ঘাটতি ৫.২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা এখন জিডিপির ৪.৭ শতাংশে সংশোধিত। ২০২৫ অর্থবছরে এটি ৪.৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ এবং দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাজেট ঘাটতি আরও কম রাখা উচিত ছিল। এ ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বরাবরের মতো দেশি ও বিদেশি উভয় উৎসের ওপর নির্ভর করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের একটি বড় অঙ্ক সরকারের ব্যাংক ঋণ থেকে আসবে। ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর সরকারের ক্রমাগত নির্ভরতা এক পর্যায়ে বেসরকারি খাতের জন্য ক্রাউড আউট ইফেক্ট তৈরি করবে। ব্যাংকগুলোতে ইতোমধ্যে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংক থেকে ঋণের সুদের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সরকারের সুদ বাবদ দায় বাড়তেই থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৪ সালের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে মোট রাজস্ব সংগ্রহ ১৩.৩ শতাংশ বেড়েছে। এটি ২০২৩-এর অনুরূপ চিত্র থেকে একটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি। এই উন্নতি সত্ত্বেও ২০২৪-এর বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০২৪ অর্থবছরের বাকি সময়ে রাজস্ব বৃদ্ধি এখনও ওই শতাংশের মতো উচ্চ হতে হবে। এটি অপ্রমাণীয় বলে মনে হচ্ছে। অতএব, ব্যয় পরিকল্পনার জন্য একটি বাস্তব এবং অর্জনযোগ্য লক্ষ্য অপরিহার্য।
কিছু মূল অর্থনৈতিক সূচকের অনুমানও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫-এর বাজেটে ২০২৫-এর জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশ হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ধরনের অর্থনৈতিক চাপের সময়ে এই অভিক্ষেপ উচ্চ। ২০২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অনুমান করা হয়েছিল ৭.৫ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অস্থায়ী প্রাক্কলন থেকে দেখা যায়, ২০২৪-এ প্রবৃদ্ধির হার ৫.৮২ শতাংশ হতে পারে।
একইভাবে জিডিপির একটি অংশ হিসাবে মোট বিনিয়োগ ২০২৫ অর্থবছরে ৩৩.৪১ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। অথচ গত কয়েক বছরে জিডিপির একটি অংশ হিসাবে মোট বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। ২০২০-২৪ এর মধ্যে গ্রস ইনভেস্টমেন্ট-জিডিপি অনুপাতের পতন হয়েছে ০.৩৩ শতাংশ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বেসরকারি বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতও ২০২৪ অর্থবছরে ২৩.৫১ শতাংশে নেমে এসেছে। সুতরাং কীভাবে ২০২৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৭.৩৪ শতাংশ অর্জিত হবে, তা বোধগম্য নয়।
কতখানি মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সহায়ক
বর্তমান অর্থনৈতিক চাপের সময় সরকারকে নিম্নস্তরের ভারসাম্য, অর্থাৎ নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধির জন্য মীমাংসা করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অপারেশন ব্যয়, অনুৎপাদনশীল প্রকল্প এবং কিছু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সহায়তার ক্ষেত্রে ব্যয় কমানো আবশ্যক। সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে দরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের গোষ্ঠীর জন্য উচ্চ বরাদ্দ রাখতে হবে।
সাধারণ মানুষকে অবকাশ দেওয়ার আরেকটি ক্ষেত্র হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি। বেসরকারি বিনিয়োগের অভাবে কর্মসংস্থান সীমিত। যুক্তিসংগত জিডিপি বৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অর্থনীতির সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
দরিদ্রদের জন্য সহায়তার একটি উৎস হলো সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী (এসএসএন) কর্মসূচি। মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে সামগ্রিক এসএসএন বাজেট সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে– ২০২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৭ শতাংশ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে ১৭.১ শতাংশে। জিডিপির শতাংশ হিসাবে এসএসএন বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২.৪০ শতাংশ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে ২.৪৩ শতাংশে।
কিন্তু এখানে আগের মতোই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্য পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ সহায়তা এবং কৃষিতে ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে এসএসএনের জন্য বরাদ্দ বেশি দেখা যায়। এসব বরাদ্দ, যা সরাসরি দরিদ্রদের সাহায্য করে না, তা বাদ দিলে এসএসএনের জন্য প্রকৃত বরাদ্দ অনেক কম। নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর জন্য কর ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনো সমর্থন পাওয়া যায়নি।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখে উন্নীত করা উচিত ছিল। কারণ প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ব্যয় নিম্ন আয়ের পরিবারের বেশির ভাগ উপার্জনকে খেয়ে ফেলে। সরকারের উচিত কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে এবং নতুন উৎস থেকে কর আদায় জোরদার করা। করদাতাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করা। এতে কর ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।
সরকার ২০২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬.৫ শতাংশ। দুর্ভাগ্যবশত এটি একটি অবাস্তব লক্ষ্য। আগামী ১২ মাসের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নীতিনির্ধারকদের বেশ কিছু বাস্তবসম্মত, সাহসী এবং অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এবারের বাজেটে কর কাঠামোর কিছুটা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, যাতে মধ্যবিত্তদের ওপর করের চাপ কিছুটা কমে। উচ্চবিত্তের ওপর করের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। কিছু আমদানি করা পণ্যের শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর প্রস্তাবও করা হয়েছে। তারপরও যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি।
বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৃদ্ধি তেমন একটা হয়নি। অন্যদিকে জনপ্রশাসন ব্যয়, সুদের ব্যয় বেড়েছে। আমরা ক্রমান্বয়ে ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছি। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, যা ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার মতো আছে, এর পুরোটাই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ। এর সুদ ও আসলের পেছনে দেশের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায়।
১০ বছর ধরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা কঠিন হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে যেভাবে সংস্কার করা দরকার, তার কিছুই বাজেটে নেই। করখেলাপিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেই। বরং তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ টাকা বৈধ করার।
মেগা প্রকল্প, কালক্ষেপণ, খাতওয়ারি বরাদ্দের ব্যবহার– ব্যয়ের উৎকর্ষ, অপচয় বন্ধ, সময়মতো কাজ শুরু ও শেষ, ব্যাংক সংস্কার নিয়েও কোনো উল্লেখ নেই।
– ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি