CPD Chairman Professor Rehman Sobhan participates in a roundtable discussion on Bangabondhu Sheikh Mujibur Rahman’s visions of Bangladesh, published in Samakal on Saturday, 1 August 2015.
জাতির জনকের প্রত্যাশার বাংলাদেশ: আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে
দুঃখী মানুষের মুক্তিই তার সব কর্মকাণ্ডের মূলে
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বাংলাদেশের ইতিহাসের এ নিষ্ঠুরতম ঘটনার চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এ উপলক্ষে সমকাল আয়োজন করেছিল ‘জাতির জনকের প্রত্যাশার বাংলাদেশ : আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা। এতে অংশ নেন বঙ্গবন্ধুর সময়ের পরিকল্পনা কমিশন সদস্য অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বঙ্গবন্ধুর সহকারী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। আলোচনার সঞ্চালক ছিলেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার
গোলাম সারওয়ার : আপনাদের স্বাগত জানাই। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশার বাংলাদেশ- আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে, এটাই আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্য।
রেহমান সোবহান : বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা কী ছিল, এটা নিয়ে ড. ফরাসউদ্দিন আলোচনা শুরু করতে পারে।
ফরাসউদ্দিন : বঙ্গবন্ধু আমাদের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয়তা দিয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন। একবাক্যে যদি বলতে হয়, বলব- তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আজীবন কাজ করেছেন। সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছেন এজন্যই। তিনি আমাদের এত বেশি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা গ্রন্থনাও দুঃসাধ্য। তিনি স্বল্পতম সময়ে শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সংবিধান রচনা করেছেন। শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রথম পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা তৈরি করেছেন, যার মূলকথা দারিদ্র্য দূর। তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে বরেণ্য শিক্ষাবিদদের দিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন। তার কাছে শিক্ষকদের ছিল বিশেষ মর্যাদা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন- সর্বত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণী শিক্ষকদের দায়িত্ব দিয়েছেন। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কাইয়ুম চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতেন, পরামর্শ নিতেন।
তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন, বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যের মর্যাদা এনে দেন। ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করেন। সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বঙ্গোপসাগর ও চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার জন্য রাশিয়ার সহযোগিতা নেন। সে সময়ে দেশের অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। কিন্তু কোনো কাজ ঠেকে থাকেনি। কৃষির প্রতি মনোযোগ দেন তিনি। শিল্প-কারখানা চালু করেন। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। কানাডা ও সুইডেন থেকে অর্থ এনে রিজার্ভ সৃষ্টি করেন। এসবের পাশাপাশি মুহূর্তের জন্যও মূল লক্ষ্য ভোলেননি- বৈষম্যহীন সমাজ গঠন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে এটাই পথ। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে বিত্তবানদের কাছ থেকে কর আদায় করে দরিদ্রদের স্বার্থ দেখতে হবে। কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। আমাদের তখন খাদ্যসহ সবকিছুতে ঘাটতি। তিনি টিসিবি চালু করেন, কসকর দোকান খোলেন, সংশোধিত রেশন কর্মসূচি চালু করেন। তিনি গরিবদের ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিতে চেয়েছেন।
গোলাম সারওয়ার : দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি নয়, আমাদের দেশেও ছিল অর্থনৈতিক বঞ্চনা- এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
ফরাসউদ্দিন : ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুক্তির সংগ্রামের কথা তিনি বলেছিলেন প্রথমে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দেশকে নিয়ে। তিনি আমাদেরও স্বপ্ন দেখাতেন। তার ছিল দূরদর্শিতা। নিজের সময়কে অতিক্রম করে ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। ১৯৬৬ সালে স্বায়ত্তশাসনের জন্য ৬ দফা দিলেন। কিন্তু লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল। আমরা এখন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তৈরি করি। ২০ বছর পর কোথায় যেতে পারি, সে দূরদর্শিতার অভাব দেখি। বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, নারীমুক্তি, শ্রমিক স্বার্থ- কত কিছুই না তার ভাবনায় ছিল! তিনি ইতিহাস ও সংস্কৃতির পাঠকে গুরুত্ব দিতেন। পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। আবার পাকিস্তান অর্জনের মাত্র ৭ বছর পর ১৯৫৪ সালে বাঙালির রাজনীতির রূপরেখা সামনে নিয়ে আসায় অবদান রাখেন। তিনি মাটি ও মানুষের কাছ থেকে, ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে সর্বদা পাঠ নিতেন।
স্থানীয় চিন্তার সঙ্গে বৈশ্বিক চিন্তার সমন্বয় ঘটাতেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র তিন মাসের মধ্যে তিনি ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের স্বদেশে ফেরত পাঠান। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা-ওআইসির সম্মেলনে কেন পাকিস্তান যাবেন- সেটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু কাছের ও দূরের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বিশ্ব-সমাজে তিনি ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তি। সর্বত্র পেয়েছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদা। আবার দেশে যখন যেখানে গেছেন, একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে আমরা পেয়েছি তাকে। বিশ্বমানব হবি যদি / কায়মনে বাঙালি হ- এ কথা তিনি ধারণ করতেন।
আরেফিন সিদ্দিক : বঙ্গবন্ধু যেদিন সপরিবারে নিহত হন সেদিন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কর্মসূচি ছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনন্য অবদান রাখা এ প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা তিনি দেবেন- এটা সবার জানা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। বাংলাদেশ নিক্ষিপ্ত হয়েছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। শৈশব থেকে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন- সব সময় কাজ করে গেছেন সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলাতে। ডেভিড ফ্রস্টের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমার একমাত্র যোগ্যতা মানুষকে ভালোবাসতে পারা।’ সবচেয়ে বড় দুর্বলতার প্রশ্নেও তার একই উত্তর। মাত্র ৫৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন তার। এর মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন ২৫ বছর- তিনি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং তা বাস্তবায়নও করতে পেরেছেন। তিনি ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে গেছেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে। বিশ্বনেতৃবৃন্দ তাকে ঘিরে ধরেছেন। তাকে হারিয়ে আমাদের পক্ষে তার প্রত্যাশা পূরণ সহজ নয়। আমরা অনেক পেছনে চলে গেছি। তার ঘাতকরা দুই দশকের বেশি বাংলাদেশ শাসন করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। জীবন-জীবিকা পাল্টে দিতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ চক্রান্ত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পূরণের জন্য, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন।
ফরাসউদ্দিন : বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এজন্য যাদের শাস্তি দিয়েছে, তারা মুচলেকা কিংবা জরিমানা দিয়ে রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছাত্রত্ব খুইয়েছেন, জরিমানা দিতে সম্মত হননি। উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিককে ধন্যবাদ, তিনি বঙ্গবন্ধুর সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছেন।
রেহমান সোবহান : বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রতীক। তাকে নিয়ে কেবল ১৫ আগস্টের আগে-পরের কয়েকটি দিন নয়, ৩৬৫ দিনই আলোচনা হওয়া উচিত। তাকে আমাদের বুঝতে হবে, ধারণ করতে হবে। তিনি জনগণ ও নেতার মধ্যে কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হতে দেননি। এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতা হয়েছেন। দুঃখী মানুষের স্বপ্ন তিনি বুঝতে পারতেন। আর কাজ করেছেন তা পূরণের জন্য। প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল স্বাধীনতার প্রেরণা। তার ভিশন ছিল স্পষ্ট। এটা আমরা দেখতে পাই তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। তিনি ডায়েরি লিখেছেন। এগুলো সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ের পরীক্ষায় কমপক্ষে ৬০ নম্বর পেতে হবে। একজন রাজনৈতিক কর্মী কীভাবে নেতা হয়ে ওঠেন, সেটা আমরা তার বই থেকে বুঝতে পারি। তিনি গোটা দেশ ঘুরেছেন। পকেটে পয়সা নেই; খাবেন কী জানেন না। রিকশা, নৌকায় গেছেন; হেঁটেছেন। ট্রেনের থার্ড ক্লাসে ভ্রমণ করেছেন। তার পাজেরো গাড়ি ছিল না।
কীভাবে আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে, কীভাবে বঙ্গবন্ধু জনগণের স্বপ্ন অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন- এটাই হতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়। পাকিস্তানের মূল দ্বন্দ্ব ছিল শাসকরা গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করেছিল। ১৯৫৪ সালের পর প্রথমবারের মতো একজন নেতা ১৯৭০ সালে জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। তিনি জনগণকে বোঝালেন স্ব-শাসনের কথা। তাদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করলেন। তিনি বলেছেন, দুঃখী মানুষরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের জন্য কিছু করতে হবে। তিনি জানেন, এই দুঃখী মানুষরাই সবচেয়ে কমিটেড। স্বাধীনতার আন্দোলনে তারাই সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল, তারাই বেশি রক্ত দিয়েছে। তারা আপসের কথা ভাবেনি। আমি মনে করি, দুঃখী মানুষের মুক্তি- এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় বিষয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নে আমরা কয়েকজন জড়িত ছিলাম। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, ড. কামাল হোসেন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু দিতেন গাইডেন্স, দিকনির্দেশনরা। সার্বিক সমন্বয় করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। প্রকৃতপক্ষে আমরা নই, বরং বঙ্গবন্ধুই এ ইশতেহারের প্রগতিশীল, গণমুখী ধারাগুলো যুক্ত করায় উৎসাহ দিয়েছেন। পাকিস্তানে যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন, সেটা বাংলাদেশে দেখতে চান না। পাকিস্তানে ছিল মুষ্টিমেয় লোকের হাতে বেশিরভাগ সম্পদ। সেখানে ছিল ২২ পরিবার। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল বঞ্চিত।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছে। আমি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে বের হই আগরতলার পথে। গণহত্যা চলছে। তার মধ্যেই গ্রামে গ্রামে দেখেছি কৃষক-মজুর-ছাত্ররা বাঁশ ও দা-বঁটি হাতে দাঁড়িয়ে। যারা স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে অহেতুক, অর্থহীন বিতর্ক করে, তারা এটা উপলব্ধি করতে পারবে না। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগের দুটি বছর বঙ্গবন্ধু তৃণমূল পর্যায়ে ঘুরেছেন। মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীও এটা বুঝতে পারে। তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়- কেবল কয়েক ব্যক্তিকে আটক বা হত্যা করলেই স্বাধীনতার চেতনা ধ্বংস করা যাবে না। জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে। এ কারণে গণহত্যা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু এমন সমাজ গড়তে চাননি যেখানে এই দুঃখী মানুষের স্বার্থ থাকবে না।
ফরাসউদ্দিন সংবিধান এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কথা বলেছে। এতে যে ভিশন, সেটা এসেছে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। তিনি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা বলেছেন। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে কেবল ব্যক্তিকে হত্যা নয়- একটি জাতির স্বপ্নকে হত্যা করতে চেষ্টা করা হয়েছে। একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
গোলাম সারওয়ার : প্রকৃতই একটি দেশের ইতিহাসকে, একটি দেশের জনগণকে হত্যা করতে চেয়েছিল ঘাতকরা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : বঙ্গবন্ধুর আরও সাতটি ডায়েরি প্রকাশ করা হবে। এগুলো সবার পাঠ অত্যাবশ্যক করা উচিত। তিনি মধুমতী নদীতীরের গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। শৈশব থেকেই গ্রামের মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক। রাজনৈতিক জীবনে তিনি সব মানুষকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্য কাজ করেছেন। তারই ফল আমরা দেখি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। কেরানি থেকে সচিব; সবাই সক্রিয়ভাবে এক ব্যক্তির কথায় সাড়া দিয়েছেন- এমন নজির কোথাও নেই।
অজয় দাশগুপ্ত : বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস বলা হয়েছে। স্বাধীনতার সময় আমরা প্রকৃতই দরিদ্র দেশ ছিলাম। অনেক কিছুতেই ঘাটতি ছিল। এ দেশটি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল?
রেহমান সোবহান : হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস বলে পরিহাস করেন। সে সময়ে বিশ্বব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা বাংলাদেশের ওপর নানা চাপ সৃষ্টি করেন। আমার মনে আছে, ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের বিদেশি ঋণের দায়ভাগ গ্রহণের জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ওপর চাপ দেয়। বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্যাংকের সহসভাপতিকে বলেন, পাকিস্তান তো আমাদের স্বীকৃতিই দেয়নি। তাদের দায় কীভাবে নেব? প্রয়োজনে ঘাস খেয়ে থাকব, কিন্তু চাপের কাছে মাথা নত করব না। বিশ্বব্যাংক বলে, দায় না নিলে সাহায্য দেব না। বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আপস নয়। তার কাছে সবকিছুর ওপর ছিল জাতীয় স্বার্থ।
শাহেদ চৌধুরী : বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের জন্য কাজ করতেন। এত বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তিনি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছর কেন ক্ষমতায় থাকতে পারলেন? কেন তাকে হত্যার পর প্রতিরোধ গড়ে তোলা গেল না? তিনি দেশের জন্য, জনগণের জন্য এত কিছু করেছেন।
ফরাসউদ্দিন : দেশবাসী ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে হতচকিত হয়ে পড়ে। তবে ক্রমে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ১৯৭১ সালে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। এটা করেছে পাকিস্তানি আর্মি। ১৯৭৫ সালে আবার সেই আর্মি। পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে জীবন বাঁচাতে এক কোটি লোক ভারত গেছে। এবারে বাঙালি আর্মি ক্ষমতায়। পালাবার পথ নেই- এ শঙ্কা ছড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ তৃণমূলে সংগঠিত ছিল। কিন্তু ভয়, দুশ্চিন্তাও ছিল।
রেহমান সোবহান : আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠিত। জনগণকে একত্র করার ক্ষমতা তাদের ছিল। কেন প্রতিবাদী হতে পারেনি- সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
গোলাম সারওয়ার : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এদের ক্ষমা করেননি। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ থাকা কাউকে তিনি ক্ষমা করেননি।
ফরাসউদ্দিন : এ ধরনের গুরুতর অভিযোগে ১৭ হাজার অপরাধী জেলে ছিল। গোলাম আযমসহ ৭ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের যে স্বপ্ন দিয়ে গেলেন, সেটা পূরণ করতে হবে। তিনি অসাম্প্রদায়িক দেশ চেয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করেন, তখনও মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার চিন্তাধারার লোক ছিল। বঙ্গবন্ধু অকুতোভয়ে অসাম্প্রদায়িক আদর্শের পক্ষ নিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের শক্তি কেন্দ্র লাহোরে বসে ৬ দফা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। দেশের ভেতরে বেশি যোগাযোগ ছিল চাষাভুষাদের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে বলতেন, ভদ্রলোকদের ভয় করি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে ছিলেন। ১৫ আগস্টের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ৩০ জুলাই তারা জার্মানি যান।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ঘাতকদের খেদোক্তি ছিল- সাপ মরল, কিন্তু লেজের বিষ থেকে গেল। শেখ হাসিনা ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসন আমলে তিনি ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট শাখার সহসভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুই সন্তানকে পড়ানোর মতো অর্থ ছিল না। অন্যের সহায়তায় তাদের পড়াতে হয়েছে। এটা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথমে তেমন প্রতিবাদ হয়নি। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেতরেও তারা ছিল। ১৯৮১ সালে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হলো। তৃণমূল আওয়ামী লীগই উদ্যোগী হয়ে শেখ হাসিনাকে দলের নেতৃত্বে নিয়ে এলো। তার হয়তো বঙ্গবন্ধুর মতো ক্যারিশমা নেই, কিন্তু একই ধরনের সাহস আছে, বুদ্ধি আছে। আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাইছি। উন্নত দেশের সারিতে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চলেছি। এ পথে ঘাতকরা শেখ হাসিনাকে বড় বাধা মনে করে। টুঙ্গিপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে হত্যার চেষ্টা, ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে একযোগে হত্যার চেষ্টা- এসব ১৫ আগস্টের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন গরিব মানুষের গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্র চেয়েছেন বাংলাদেশের ধাঁচে। তিনি বলতেন- ব্যক্তিমালিকানা, সমবায় ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা- সব থাকবে। ক্ষেতমজুর-কৃষকরা সমবায়ে যোগ দেবে। রাষ্ট্র কৃষিকাজে সহায়তা দেবে। জমির মালিক, কৃষক যার যার মতো ফসলের ভাগ পাবে। তিনি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন। এসব যাতে সফল না হয় সেজন্যই তাকে হত্যা করা হয়। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু আর মাসখানেক সময় পেলে সবকিছু গুছিয়ে ফেলতে পারতেন। হত্যাকারীরা প্রচার করেছিল- তিনি মুসলমানদের দেশটিকে ভেঙেছেন, হিন্দুস্তান বানিয়েছেন। হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন- বাস্কেট কেস। আবার এটাও বলেছেন, অনেক রাজা-বাদশা দেখেছেন, বাংলাদেশে জাতির পিতা দেখলেন। এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। বঙ্গবন্ধু চাটার দলের কথা বলেছেন। এই চাটার দল যাতে শেখ হাসিনার চাটুকারে পরিণত না হয়, তার প্রতি নজর রাখতে হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে চাই সম্পদের সুষম বণ্টন।
আমাদের অগ্রগতি আছে। ১৯৭২ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। এখন ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তবে বৈষম্য বেড়েছে। তারপরও বলব, কম আয়ের লোকেরা আগের চেয়ে ভালো আছে। শেখ হাসিনার অনেক কর্মসূচি আছে গরিবের জন্য। সামাজিক সুরক্ষা-বলয় ফল দিতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার সময় নারীদের মাত্র ৪ শতাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। এখন ৪০ শতাংশ। এক কোটি টন থেকে আমরা সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি খাদ্য উৎপাদন করছি। এসবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার জন্য। দেশ বিশ্ব-সমাজে মর্যাদার আসন ফিরে পেতে শুরু করেছে। বিশ্বের তিনটি বড় অর্থনীতির দেশ ভারত, চীন ও জাপান বাংলাদেশের পাশে আছে।
মুস্তাফিজ শফি : ষাটের দশকে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটতে দেখেছি। সেখান থেকে কেন আমরা পিছিয়ে পড়ছি সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও অপরাধের শাস্তি এড়াতে পারছে না। কিন্তু কেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জীবন পাই না? গ্রামে গ্রামে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সক্রিয় রয়েছে। জঙ্গিবাদ সামাজিক ভিত্তি তৈরি করছে। এগুলো রুখে দাঁড়াতে হবে।
সবুজ ইউনুস : আমাদের অগ্রগতি দৃশ্যমান। মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছি। কিন্তু সুস্থ রাজনৈতিক ধারার চর্চার অভাব হলে উন্নয়ন কতটা টেকসই হবে? সুস্থ রাজনৈতিক ধারা না থাকলে অগ্রগতি ধরে রাখতে পারব কি? নাকি ঝুঁকির মুখে পড়ব নতুন করে?
রেহমান সোবহান : প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। এজন্য শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে হবে। কেউ কেউ বলেন, বিশ্ব বদলাচ্ছে। বাংলাদেশ বদলাচ্ছে। আমাদের ভিশনও বদলাতে হবে। এ প্রশ্নের উত্তর সবার অভিজ্ঞতা দিয়ে খুঁজতে হবে। আমাদের সাধারণ মানুষ, বঙ্গবন্ধুর দুঃখী মানুষ কি মনে করে, দেশে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? তাদের কি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন হয়েছে? নাকি কিছু লোক সরকারি সুযোগ-সুবিধায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে? এ মহলই কি শক্তিশালী হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ দূরে সরে গেছে? এটা হয়ে থাকলে সেটা বঙ্গবন্ধুর ভিশনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গোটা বিশ্বের অভিজ্ঞতা- অসাম্য, বৈষম্য বাড়ছে। মুষ্টিমেয় লোক সুবিধা অনেক বেশি পাচ্ছে। এ অবস্থায় নির্বাচনে ধনীরাই বেশি সুবিধা পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ কি এখন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে? ১৯৭০ সালে ১০ শতাংশ প্রার্থীরও গাড়ি ছিল না। তোফায়েল আহমেদসহ তরুণ নেতারা, নিম্নবিত্ত প্রার্থীরা কত টাকা পকেটে নিয়ে তখন সাকা চৌধুরীর মতো ধনবান প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন? এই ধনীরা পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের কাছ থেকে অঢেল টাকা পেয়েছে। এখন টাকা ছাড়া মনোনয়ন মেলে না, নির্বাচন করা যায় না। গণতন্ত্রের দুটি দিক_ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র আসে না। নির্বাচনে, সমাজের অন্যান্য কর্মকাণ্ডে সমান সুযোগ থাকা চাই সবার জন্য। বঙ্গবন্ধু কোটিপতির সন্তান ছিলেন না। সাধারণ পরিবারে কষ্টের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। তার আদর্শের অনুসারীদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা চাই।
রাশেদ মেহেদী : সাংস্কৃতিক চেতনা ছাড়া উন্নত জীবনবোধ হয় না। এখন ছাত্রনেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন। এজন্য শিক্ষকদেরও দায় আছে, মনে করি। সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন ছাড়া ছাত্ররা নেতৃত্ব দিতে পারে কি-না?
আরেফিন সিদ্দিক : ছাত্রনেতাদের বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন উপলব্ধি করতে হবে। ১৯৪৮ সালে তরুণ বয়সেই তিনি বুঝেছিলেন, বাঙালির মুক্তি পাকিস্তান কাঠামোতে সম্ভব নয়। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। অশিক্ষা, অপশক্তির বাধা বুঝতেন। স্বাধীনতার পর কত ষড়যন্ত্র! বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, ক্যান্টনমেন্টে হত্যা। জেলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা। আমরা কেবল বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ঘাতকদের বিচার করেছি। তাদের সঙ্গে কারা ছিল ষড়যন্ত্রে- সেটা দেশবাসীর জানা দরকার। সমাজের সর্বত্র তারা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সহযোগীরা রাজনৈতিক অধিকার পেতে পারে না। তাদের কার কী ভূমিকা ছিল সেটা চিহ্নিত করার জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা উচিত। কারা ঘাতকদের বিচার রুখতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ করেছে? তিনি তরুণ ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতা হয়েছেন, জাতির পিতা হয়েছেন। তাকে অসময়ে হারানো ছিল দুর্ভাগ্যজনক। তবে হতাশায় বসে থাকা ঠিক নয়। বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
রেহমান সোবহান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেতাদের বলেছেন, সেরা ছাত্র হতে হবে। ড. ফরাসউদ্দিন অনার্স ও এমএ পরীক্ষায় অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি ছিল। ১৯৬১ সালে রাশেদ খান মেনন ডাকসুর ভিপি। তার ভাইভা নিতে আমি জেলে গেছি। এখন ছাত্রনেতাদের অনেকে ব্যবসায়ী। তাদের দাপট অনেক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিজের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য হতে পারে না। যারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার তাদের যোগ্য হতে হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। একটু একটু জীবনমান উন্নত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়াই সমস্যা। তিনি মানুষকে কীভাবে দেখতেন তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। উদার চিন্তার মানুষ ছিলেন তিনি। শুধু অর্জন নয়, ভোগ নয়; দেশকে দিতে হবে। এখন সংসদে অনেক ব্যবসায়ী। বঙ্গবন্ধুর আমলে তিন-চারজন ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন ব্যবসায়ী বেশি। তারা টাকা ঢালছে। টেন্ডারবাজি চলছে। দুর্বৃত্তায়ন দেখছি। ছাত্রনেতাদের দেখি দামি গাড়ি, বডিগার্ড। ষাটের দশকের ছাত্রনেতারা হেঁটে যেতেন হলে হলে। একটি মাত্র মোটরসাইকেল ছিল সিরাজুল আলম খানের। এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা নেই। সেরা ছাত্রছাত্রীরা ভিপি-জিএস হওয়ার সুযোগ পায় না। ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বয়স ২৯ বছর। কেন? ২৫-২৬ বছরেই এমএ পাস হয়ে যায়। এখন অর্থপ্রাপ্তিই মুখ্য তাদের কাছে। বঙ্গবন্ধু তো দেওয়ার কথা বলেছেন। জীবনমুখী, সংস্কৃতিমুখী ধারা থেকে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। ইতিহাস চিন্তা থেকে বিচ্যুত হচ্ছি। মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ- তারা সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। এখন পুঁজিবাদের হাতে আত্মসমর্পণ করছেন অনেক নেতা। পুঁজিবাদের কাজ দানব সৃষ্টি। সেখান থেকে নিষ্কৃতি চাই। আমরা যেন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছি। ধর্ম মানুষের মঙ্গলের জন্য। আর ধর্মতন্ত্র শোষণের জন্য। বঙ্গবন্ধু এটা বিশ্বাস করতেন বলেই তার নামে কুৎসা রটানো হয়েছে। তিনি ধর্মের নামে শোষণ চাননি। নিজে ধর্ম পালন করতেন। ভাসানীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। অতিথিপরায়ণ ছিলেন। তার বাড়িতে গিয়ে না খেয়ে আসা যেত না। তাকে পাঠ করতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে।
লোটন একরাম : বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে কী পরামর্শ দেবেন?
ফরাসউদ্দিন : বঙ্গবন্ধুকে সর্বজনীন করতে হবে। তিনি দলের নন; সবার। এখন বৈষম্য বাড়ছে। যে পরিবারে তিন সন্তান; একজনকে মাদ্রাসায় দেওয়া হয়। সেখানে থাকা-খাওয়া ফ্রি। অর্থনীতির কারণে এ সমস্যা। আমাদের অর্থনীতিতে যুক্তদের অনেকে কেবল ব্যবসা বোঝেন। তাদের শিল্প সৃষ্টিতে মনোযোগী হতে হবে। এভাবেই সবার কাজ মিলবে, আয়-রোজগার হবে। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। মানুষকে ভালোবাসতেন। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সবাইকে যুক্ত করতে চাইতেন।
রেহমান সোবহান : সবার জন্য সুযোগ সৃষ্টি হতে হবে। পোশাকশিল্পে ৪০ লাখ নারী কাজ করছেন। ৫-৬ হাজার টাকা মাসে বেতন, ১২ ঘণ্টা দিনে কাজ। অন্ধকারে বাড়ি থেকে কারখানায় রওনা দেয়; অন্ধকার হলে ফেরত যায় বাসায়। তার মালিক উচ্চবিত্ত। কেউ কেউ কানাডা-মালয়েশিয়ায় বাড়ি করেছেন। ৪-৫টা গাড়ি। ৪০ লাখ শ্রমিকের বেশিরভাগ গ্রাম থেকে এসেছে। সামান্য বেতন পেলেও তাদের মুখে হাসি আছে। কিন্তু তাদের মালিকরা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যায়। বেড়াতে যায় ইউরোপ-আমেরিকা। এ অবস্থায় যারা শ্রম দেয় তাদের মুখের হাসি কতদিন থাকে? আমি মনে করি, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কেবল বেতন নয়, শেয়ারহোল্ডার করতে হবে। বাংলাদেশকে ন্যায়ভিত্তিক সমাজে পরিণত করতে হলে মালিকানা দিতে হবে। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী ইশতেহারে এটা ছিল। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে। যারা ঢাকা শহরের সেরা স্কুলে পড়ে, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে তাদের সঙ্গে যেন দুঃখী মানুষদের সন্তানদের শিক্ষাজীবন শেষে সমাজে সুযোগ লাভে কোনো পার্থক্য না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল জিপিএ ৫ পাওয়া নয়; এমন শিক্ষা চাই যাতে জীবনে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারি। এজন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ চাই, জিডিপির ২ শতাংশ নয়, ৬-৭ শতাংশ বরাদ্দ চাই। দুঃখী মানুষকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে- এটাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। বাংলাদেশে বেশিরভাগ সময় তারাই ক্ষমতায় ছিলেন যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করেন না। তারা প্রত্যাশা পূরণের জন্য কাজ করেননি। আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পেলে, ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে পারলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা পূরণ হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করেন যারা তারা ক্ষমতায় থাকলে এ কাজ সহজ হবে। শেখ হাসিনার সরকারের দুর্বলতা আছে। এসব থেকে মুক্ত হতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে সামনে আনতে হবে। তারাই চালিকাশক্তি। বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদিন পাঠ করতে হবে। কেবল নির্দিষ্ট উপলক্ষে নয়; তাকে প্রতিদিন স্মরণে রাখা চাই।
গোলাম সারওয়ার : সবাইকে ধন্যবাদ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চির অম্লান হোক।