Published in Prothom Alo on Thursday, 13 February 2014.
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি ফিরে পাওয়া অনিশ্চিত
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) ফিরে পাওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে এমন আভাসই দিয়েছে। বাংলাদেশের জিএসপি নিয়ে আগামী মে মাসে ওয়াশিংটনে পর্যালোচনা সভা হওয়ার কথা আছে।
বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, কর্মপরিবেশের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলে জিএসপি পুনর্বহালের সম্ভাবনা কম।
গত মঙ্গলবার মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির শুনানিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি পুনর্বহালে বাংলাদেশের কর্মপরিবেশের উন্নয়নে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি। তাই শ্রমিকস্বার্থ সুরক্ষা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে দেশটি।
তৈরি পোশাক কারখানার কাজের পরিবেশ এবং শ্রমিকের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক থাকায় ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করে ওবামা প্রশাসন।
মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর রবার্ট মেনেনদেজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শুনানিতে দুটি প্যানেলে আলোচকেরা শুরুতে বক্তৃতা করেন। পরে তাঁরা মার্কিন সিনেটরদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। প্যানেল আলোচনার প্রথমটিতে বক্তৃতা করেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল, শ্রম দপ্তরের আন্তর্জাতিক শ্রমবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত সহযোগী আন্ডার সেক্রেটারি এরিক বিয়েল ও শ্রমবিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি লুইস কারেশ।
তবে জিএসপি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিএসপি পুনর্বহালের বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা না হলে আমরা কর্মপরিকল্পনার সব শর্ত পূরণের পর এ সুবিধা ফিরে পাব। ১৬টি শর্তের ১২টি ইতিমধ্যেই পূরণ করেছি। বাকি চারটি শর্ত খুব শিগগির পূরণ করতে পারব।’
জিএসপি আলোচনার জন্য গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জিএসপির পুনর্বহালে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া কর্মপরিকল্পনার অবশিষ্ট শর্ত পূরণ নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর জিএসপি স্থগিতের সময় যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিয়েছিল। গত মঙ্গলবার সিনেট কমিটির শুনানিতেও শ্রম পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই জিএসপি ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক যেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে, তা দূর করতে বাংলাদেশকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আলোচনায় এমন মত এসেছে, আগামী মে মাসে জিএসপি পুনর্বহালে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিলে আরও এক বছরের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি পুনর্বহাল না হলে ইউরোপ ও কানাডায় এ সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
প্রসঙ্গত, জিএসপির আওতায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় না। বাংলাদেশ জিএসপির আওতায় মূলত সিরামিক পণ্য, চশমা, তাঁবু, প্লাস্টিক ব্যাগ, উলের তৈরি পাপোশ ও শতরঞ্জি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে।
মার্কিন সিনেটের শুনানি: মার্কিন শ্রম দপ্তরের আন্তর্জাতিক শ্রমবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত সহযোগী আন্ডার সেক্রেটারি এরিক বিয়েল ও শ্রমবিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি লুইস কারেশ সিনেট কমিটির শুনানিতে উল্লেখ করেন, জিএসপি ফিরে পেতে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী পরিস্থিতির যে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়নি, সেটি গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে।
সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও উল্লেখ করেন, ‘কর্মপরিবেশের উন্নয়নে বাংলাদেশ যে অঙ্গীকার করেছিল, তা এখনো পূরণ করেনি। শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে আমরা বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখব।’
তবে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ যেসব ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোও এরিক বিয়েল উল্লেখ করেন। এরিক বিয়েল বলেন, কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়গুলোর সুরাহা এখনো হয়নি, সেটি বাংলাদেশ সরকারকে স্পষ্ট করেই জানানো হয়েছে। বিপুলসংখ্যক প্রশিক্ষিত শ্রম, অগ্নিকাণ্ড ও ভবনের নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রশিক্ষক নেওয়ার পরিকল্পনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখন পর্যন্ত খুবই স্বল্পসংখ্যক পরিদর্শককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে শ্রম আইনে যে সংশোধন আনা হয়েছে, তাতে কর্মপরিকল্পনায় উল্লিখিত উদ্বেগগুলো দূর হয়নি। আবার বিভিন্ন শিল্পের যৌথ দর-কষাকষিতে কঠোর বিধিনিষেধ ও ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে মালিকের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে যথাযথ সুরক্ষাব্যবস্থা কর্মপরিকল্পনায় নেই। এ ছাড়া ২০১২ সালে খুন হওয়া শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
মার্কিন শ্রম দপ্তরের জ্যেষ্ঠ এ কর্মকর্তার মতে, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার (ইপিজেড) শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো আলাদা আইনে পরিচালিত হওয়ায় সেখানকার শ্রমিকদের সুরক্ষার মান ভালো নয়। সেখানে শ্রম ও নিরাপত্তা পরিদর্শকদের নজরদারির বাইরে থাকা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিষিদ্ধ থাকার মতো বিষয়গুলোর সুরাহা হয়নি। সম্প্রতি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের সময় শ্রমিক নেতাদের হয়রানির খবরেও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ রয়েছে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে সিনেটর বেনজামিন কারডিনের প্রশ্নের জবাবে নিশা দেশাই বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে অনেক কঠোর হয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠন নিবন্ধনের সংখ্যা গত বছর অনেক বেড়েছে। পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। পুরো পরিস্থিতির রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের শ্রমমানের উন্নয়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সময়সাপেক্ষ এ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
সিনেটর রবার্ট মেনেনদেজ বলেন, বাংলাদেশে ৩০ লাখ তৈরি পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৪০ হাজার সদস্যকে নিয়ে প্রায় ১০০ ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন হয়েছে। শ্রমমান ও শ্রমিকদের স্বার্থের সঙ্গে আপসের জন্য দেশের ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে কতটা ছাড় দিতে হবে, সেটি বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিকদের পাশাপাশি সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।
রবার্ট মেনেনদেজ বলেন, ‘আমি আশা করি, মালিকেরা এটা বুঝতে পারবেন যে বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকে রক্তের দাগ লেগে থাকলে তা বিক্রি করতে তাঁদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।’