কাজে না লাগলে জ্ঞান কি ভেজে খাব? – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in কালের কন্ঠ on Friday, 10 June 2016

কাজে না লাগলে জ্ঞান কি ভেজে খাব?

Dr Debapriya Bhattacharya

শরণার্থী হয়েছেন জীবনে দুবার। রাজনীতি করবেন বলে নটর ডেমে ভর্তি না হয়ে ঢাকা কলেজে পড়েছেন। বাম চিন্তা থেকে রাশিয়ায় পড়তে গেছেন। দেশে ফিরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যর মুখোমুখি হয়েছেন ওমর শাহেদ। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান

আপনার জন্ম? আদি নিবাস?

১৯৫৬ সালের ২৯ এপ্রিল কলকাতায় জন্ম। আদি নিবাস টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায়। মামা বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা। মা-বাবা দুই পরিবারেরই জমিদারি ছিল। বাবা [বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য] খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে আইনে এলএলবি। তিনটি পরীক্ষার সবগুলোতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। প্রেসিডেন্সিতে জ্যোতি বসু ও তিনি একই ব্যাচে পড়েছেন।

আর মা?

বাবা ওকালতি পাস করে ময়মনসিংহ এসে পেশা জীবন শুরু করেন, মা তখন আনন্দমোহন কলেজে বিএ পড়েন। মায়ের ভাইয়েরা সবাই বামপন্থী রাজনীতি করতেন, সেভাবেই তাঁদের পরিচয়। ১৯৪৭ সালে মা-বাবার বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক মাস পরই তো পাকিস্তান হলো। তখন দেখা গেল, বাবার ডাবল দোষ—দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে তিনি একদিকে হিন্দু, অন্যদিকে কমিউনিস্ট। ফলে বিয়ের পরপরই তাঁকে জেলে নিয়ে গেল। বাবার জেলজীবন খুব ঘটনাবহুল। জেলে তাঁরা রাজবন্দির অধিকারের জন্য সে সময়ের সবচেয়ে দীর্ঘ ৬৭ দিনের অনশনটি করেছেন। অনশনের সময় জোর করে খাওয়াতে গিয়ে একজন মারা যান।

মা তখন কী করলেন?

পড়াশোনা স্থগিত রেখে ময়মনসিংহের রাধা সুন্দরী স্কুলে শিক্ষিকা হলেন। জমিদারের সন্তান কমিউনিস্ট হলে বাবা খুব খুশি হন না। ফলে বাবার জেলখরচ এবং নিজের ভরণপোষণ চালাতে মা চাকরি নিলেন। অনেকেই আমার বাবার কথা জানেন, কিন্তু মায়ের ব্যক্তিত্ব ও ভূমিকাটিও আমার পরিষ্কার করে বলা উচিত। এই মা আমার ষাটের দশকের শেষে আবার পড়ালেখা শুরু করলেন। তখন দিদি [দেবলীনা ভট্টাচার্য] বড় হয়েছে, আমিও স্কুল শেষ করব, ছোট ভাই দীপেন [ভট্টাচার্য] সেভেন-এইটে পড়ে। বড় ধরনের ব্রেক অব স্টাডি থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. এ কে নাজমুল করিমের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ২০-২২ বছর পর মা বিএ পরীক্ষা দিলেন। ১৯৬৯ সালে মাস্টার্সে ভর্তি হলেন। স্বাধীনতার আগে এমএ ফার্স্ট পার্ট পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছেন। স্বাধীনতার পর সেকেন্ড পার্ট দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর কাছে তিনি সর্বজনীন বৌদি। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রকাশক মফিদুল [হক] ভাইও ছিলেন। মা তাঁদের চেয়ে নিদেনপক্ষে ১৫-২০ বছরের বড়। তাঁরা সমানে বৌদি, বৌদি বলে তাঁর কাছ থেকে চায়নিজ খেতেন। তাঁকে আবার পড়ালেখায় নিয়ে আসা, পরীক্ষার অনুমতি নেওয়া—সব কিছুর পেছনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা ড. মালেকা বেগমের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। মালেকা পিসি তাঁর নারী আন্দোলনের পবিত্র ব্রত হিসেবে মাকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। পরে মালেকা পিসির উৎসাহে মা নারী আন্দোলনে যোগ দেন, সুফিয়া কামালের নেতৃত্বাধীন মহিলা পরিষদের সহসভানেত্রী ছিলেন দীর্ঘ সময়। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৯৬-২০০১ সালের সংসদে টাঙ্গাইলের নারী আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।

আপনার লেখাপড়ার শুরু?

১৯৬০ সালে লক্ষ্মীবাজারে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে। স্কুলটি মেয়েদের। তবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেরাও পড়ত। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় আমাদের পরিবার বাধ্য হয়ে সাময়িকভাবে দেশ ছাড়ে।

তখন থাকতেন?

ওয়ারীর র্যাংকিন স্ট্রিটে। তিন ভাইবোনই স্কুলে পড়ি। গুজবে আদমজীর শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হলো। পরে তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার, নারায়ণগঞ্জে ছড়িয়ে গেল। মনে আছে, সেদিন ছিল পৌষসংক্রান্তি। মায়ের তৈরি পিঠা খেতে আশপাশের প্রতিবেশী ও বন্ধুরা বাড়িতে এসেছেন। পরের দিন সারা রাত আমরা প্রতিবেশীর দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছি। দেখছি, পুরান ঢাকায় বাড়িগুলোতে আগুন জ্বলছে। আমাদের বাড়ির সামনে যে মুচিটি বসত, কেউ ছুরি দিয়ে তার পেটে আঘাত করেছে। ড্রেনে পড়ে সে সারা রাত কাতরাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে প্রশ্ন এলো—রবি দাস তো নিম্ন বর্ণের হিন্দু। সাম্প্রদায়িকতা তো উঁচু-নিচুর ভেদ করে না। আমরা উভয়েই তো সমান আক্রান্ত, আতঙ্কগ্রস্ত। পরে সকালে কেউ তাঁকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। দেশে ফিরে দেখি, রাস্তার মোড়ে বসে সে আবার সেলাই করছে, পেটে তার সেলাইয়ের বিরাট দাগ।

৬৪ দাঙ্গার সময় কি ড. রাজীর বাড়িতে ছিলেন?

১৯৫২ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাবা ঢাকা এসে ওকালতি শুরু করেছিলেন। তাঁর এক মক্কেল ছিলেন পাবনার বেলকুচির মুসলিম লীগ নেতা আবদুল মতিন [তত্কালীন এমএনএ], ‘মতিন কাকু’। দাঙ্গা শুরু হলে তিনি আমাদের বের করে তাঁর গোপীবাগের বাসায় নিয়ে গেলেন। তিন-চার দিন থাকলাম। সেখানেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় বাবার আরেক বন্ধু বিশিষ্ট আইনজীবী ড. আলীম আল-রাজী এসে নিয়ে গেলেন তাঁর আজিমপুরের বাসায়। আসলে ১৯৬৪ ও ১৯৭১—দুবারই আমাদের বাঁচাতে আলীম কাকুর ভূমিকা অনন্য। আমাদের টাঙ্গাইলের এই মানুষটি মাদ্রাসা থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে বিলেতে পড়েছেন। ইতিহাস ও আইনে ডাবল পিএইচডি, পিনস্ট্রাইপ স্যুট পরতেন। বাবাকে ডাকতেন ‘গুরু’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের মানুষ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক এই আলীম কাকু।

কিভাবে দেশ ছাড়লেন?

কাকিমা [ড. মালেকা আল-রাজী] তখন ইডেন কলেজের শিক্ষক। আজিমপুর কলোনিতে তাঁদের তিন রুমের সরকারি কোয়ার্টারে আমরা আরেকটি ফ্যামিলি উদ্বাস্তু হয়ে উঠলাম। তাঁরা তিনজন, আমরা পাঁচজন। ২১ দিন ছিলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না কলকাতার সঙ্গে ঢাকার প্লেন চালু হলো। মা ও তিন ভাইবোন কলকাতা গেলাম। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানে তো কোনো হিন্দু পরিবার নিজেদের নিরাপদ মনে করত না। বোন মাসির কাছে থেকে গেল, আমি পিসির বাসায়। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলে থ্রি থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। সেই জীবনও এক অর্থে শরণার্থীর জীবন। আত্মীয় হলেও অন্যের বাসায় কয় দিনই বা থাকা যায়? ১৯৬৫ সালের পাক-ভারতের যুদ্ধের পর মা-বাবা আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৬৬ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে সিক্সে ভর্তি হলাম। এ স্কুল থেকেই ১৯৭২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছি।

মাঝে তো ১৯৭১ এলো?

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মা-বাবা আমাদের দুই ভাইকে দেশের বাড়ি এলেঙ্গায় রেখে এলেন। ১৮ মার্চ তাঁরা আবার ঢাকা চলে এলেন। সেদিন জয়দেবপুরে অস্ত্র কারখানায় বিদ্রোহ হয়। বাবা ভেবেছিলেন, বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া খানের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো কোর্ট খুলবে। তবে তারপর থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত তাঁরা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন—জানতেও পারিনি। তবে বাবার এক জুনিয়র আইনজীবী আবদুর রউফের [সাবেক নির্বাচন কমিশনার] শ্বশুরবাড়ি, আলীম কাকুর বাসায় তাঁরা আত্মগোপন করেছিলেন। পরে আলীম কাকুর জুনিয়র, ব্যারিস্টার ইউসুফ নিজ গাড়িতে মা-বাবাকে ১৯৭১ সালের আগস্টের শেষ দিকে টাঙ্গাইলে নিয়ে এলেন। আমরা নৌকা করে তাঁদের নিয়ে এলাম। আমরা তখন এলেঙ্গার বাড়ি ছেড়ে অন্য গ্রামে—মুক্তাঞ্চলে।

টাঙ্গাইলে কিভাবে ছিলেন?

যুদ্ধের কিছুদিনের মধ্যে আমাদের গ্রামের বাড়িতে শান্তি কমিটি অফিস করল, বাড়ির কিছু অংশ আগুনে পুড়িয়ে দিল। আমি, ছোট ভাই, কাকা-কাকিমা, গ্রামের মানুষ যুমনার চরে পালিয়ে গেলাম। দিনে কারো আশ্রয়ে থাকি, সারা রাত নদীর ধারে জেগে বসে থাকি—মিলিটারি বা ডাকাতরা যদি নদীর ধার দিয়ে আসে। মিলিটারি সকালে আসে বলে দুপুরের পর ঘুমাই। সন্ধ্যায় গোল হয়ে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনি। এর মধ্যে অবশ্য একবার ডাকাতরা আমার বুকে বসে গলায় তলোয়ার ধরেছিল।

মা-বাবা আসার পরে?

আমরা আগেই ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। আমরা চলে যাব শুনে এলাকার হিন্দু-মুসলমান সবাই অসহায়বোধ করতে লাগলেন। বললেন, তাঁরাও যাবেন। ৬ সেপ্টেম্বর দুই শ-আড়াই শ মানুষ, বিরাট-লম্বা তিন গয়নার নৌকায় যাত্রা করলাম। একসময় আসামের মানকেরচরে পৌঁছলাম। সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ মাস আবার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকতে হলো। ১৯৭২ সালের ১৩ বা ১৪ জানুয়ারি ড. কামাল হোসেনের ফোন পেয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্লেনে বাবা ঢাকা এসে বঙ্গভবনে শপথ নিলেন। ফেব্রুয়ারিতে আমরা ফিরে এলাম। তখন র্যাংকিন স্ট্রিটের বাসায় একটি খাট-চেয়ারও নেই। সব লুট হয়ে গিয়েছে।

ছাত্র হিসেবে কেমন ছিলেন?

[হাসি] শরণার্থী থেকে দেশে ফিরে ১৯৭২ সালে তিনটি লেটার নিয়ে সায়েন্স থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেছি। মেরিট লিস্টে প্রথম ২০ জনের মধ্যে ছিলাম। আমার স্কুলের সবাই তো নটর ডেমে ভর্তি হতো। তবে আমি রাজনীতি করব বলে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম।

রাজনীতির ঝোঁক কেন হলো?

শুরুটি পরিবারের পরিবেশ থেকে। বাবা খুবই আশাবাদী, ইতিবাচক, সামনের দিকে তাকানো মানুষ ছিলেন। এমন সময় বড় হয়েছি, সেই ষাটের দশক; এখনো বলি, এটিই ছিল আর্থসামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বর্ণযুগ। সৌভাগ্য যে বাড়িতে অজিত গুহ [শহীদ], সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অধ্যাপক সাইদুর রহমানের মতো মানুষরা আসতেন। বাবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। তখন তো স্কুলে পড়ি, বসে বসে তাঁদের কথা শুনতাম। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা থাকার জায়গা পেতেন না, আমাদের বাসায় থাকতেন। পার্টির অনেক কাজও বাসায় হয়েছে। মণি সিংহ ১৯৬৯ সালে রাজশাহী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গোপনে আমাদের বাসায় আসতেন। খোকাদা [খোকা রায়], অনিল মুখার্জি আত্মগোপনে ছিলেন। তাঁরাও আসতেন। তখন স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো গোর্কির ‘মা’ মঞ্চস্থ হবে। পুরো নাটকের মহড়া আমাদের বাসায় হয়েছে। সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেছেন। রওশন জামিল ছিলেন ‘মা’।

ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে কি পলিটিকস শুরু করে দিলেন?

গিয়ে শুরু করিনি, পলিটিকস নিয়েই ঢুকলাম। পলিটিকস শুরু করেছি ১৯৬৯ সালে। পাকিস্তান সরকার অখণ্ডতা বোঝানোর জন্য একটি নতুন বই বাধ্যতামূলক করেছিল—‘পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি’। কিন্তু আমরা কিছুতেই তা মেনে নিতে রাজি হইনি। রাজনীতি থেকে অনেক দূরের, সফল-উচ্চবিত্তদের ছেলেদের স্কুল সেন্ট গ্রেগরিজ থেকে ১৯৬৯ সালে প্রথম মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়েছি। দেশ তখন ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে।

ঢাকা কলেজের জীবন?

স্বাধীনতা-উত্তর খুবই অস্থির সময়ে ঢাকা কলেজে পড়েছি। একদিকে ছাত্রলীগ, অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন। জাসদের উদ্ভব হচ্ছে, সর্বহারাও আছে। কলেজে সব কিছুরই প্রতিফলন ছিল। মিটিং-মিছিল থেকে সম্মেলন করা—একদিকে সবই ছিল সহজ, অন্যদিকে কঠিন। বিশেষত বামপন্থী ছোট দলের সমস্যা বেশি ছিল। একদিন মিছিল নিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ একজন জড়িয়ে ধরল, ‘কেমন আছেন? মিছিল করছেন?’ তারপর বুকে জড়িয়ে ধরল। বুঝলাম, অস্ত্র আছে, সাবধান করল। ক্যান্টিনে কর্মিসভা করছি, কেউ এসে ফ্যানে গ্লাস ছুড়ল, কাচ ভেঙে চারপাশে ছড়াল, আমাদের দিকে চেয়ার ছুড়ে মারল। সারা দেশ থেকে মেধাবীরা এখানে আসত, মফস্বল থেকে আসা  ছেলেরা এমন পরিস্থিতিতে খুব অসহায় বোধ করত। তাদের তো অত সামাজিক শক্তি নেই। ফলে তাদের ছোটানো খুব সহজ ছিল। দেখা গেল, সন্ধ্যায় হোস্টেলে কর্মিসভা করব, অন্যরা এসে দরজায় লাথি মারছে, ঘাড় ধরে রুম থেকে বের করে দিল। তখন খুব যে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করছি, তা নয়। তখন তো বাম আওয়ামী লীগের ঐক্যের রাজনীতি চলেছে।

রাজনীতির পাশাপাশি আর কিছু করতেন?

স্বাধীনতার পরের সময়টি ছিল এক অনির্বচনীয় উদ্ভাসিত সময়। ১৯৭২-৭৫ সালে একদিকে বামপন্থী রাজনীতি করছি, অন্যদিকে সংস্কারবাদী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে মগবাজার মোড়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অফিসে, এখনো সেটি আছে, রিকশাওয়ালাদের সাক্ষরজ্ঞান দিতে নাইট স্কুল চালাচ্ছি। স্কুলে পড়াত এ রকম অনেককে চিনবেন—সহপাঠী আনু মুহাম্মদ, মণি সিংহের ছেলে ডা. দিবালোক সিংহ, মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান মৃধা বেণু। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে রুটি সংগ্রহ করে কমলাপুর রেলস্টেশনে বিলি করেছি।

পরীক্ষার রেজাল্ট?

এ নিয়ে বড় টেনশন ছিল। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক, আরো অনেক ভালো শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা বকাবকি করতেন। চক-ডাস্টার-হাজিরা খাতা নিয়ে তাঁরা ক্লাসে যাচ্ছেন, তাঁদের সামনে দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে আমি করিডর পেরোচ্ছি। আরো চ্যালেঞ্জ ছিল—প্র্যাকটিক্যালের নম্বর পাব কিভাবে? ক্লাস তো বেশি করিনি। তবে খুব কৃতজ্ঞ—স্পেশাল প্র্যাকটিক্যাল করিয়ে শিক্ষকরা সাহায্য করেছেন। সেবার প্রায় দেড় লাখ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছি। সেবারই প্রথম নকল বন্ধ করতে রক্ষীবাহিনী নামানো হয়েছিল। ঢাকা বিভাগে সেবার ১১১ জন ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল, এর মধ্যে ৫২ কী ৫৩ জন ছিল ঢাকা কলেজের, আমিও তাদের একজন। মুখ রক্ষা হয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কিভাবে হলো?

তখন প্রায় সার্বক্ষণিক ছাত্ররাজনীতি করি। মা ভাবলেন, আমার পড়ালেখা আর হবে না। একদিন ডেকে বললেন, ‘তোর সব বন্ধুরা চলে যাচ্ছে, তুইও বিদেশে যা।’ আমাদের স্কুলের ব্রাদারদের সার্টিফিকেটে অনেক সহপাঠীই তখন যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছে। ফলে বিদেশে ভর্তি হওয়া কোনো সমস্যা নয়, অর্থও সমস্যা নয়। বললাম, যাব কিন্তু আমেরিকা নয়, রাশিয়া যাব। নতুন সমাজ গড়ার জন্য, নতুন মানুষ কিভাবে বানানো যায় তা শিখব। দেশ গড়ার কারিগর হব। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু মারা গেলেন। ফলে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়ার তাগাদা বোধ করলাম। যাই হোক, ১৯৭৫ সালের আগস্টের শেষে মস্কো গেলাম।

রাশিয়া গিয়ে?

রুশ ভাষা শিখতে এক বছর ইউক্রেনের দানিয়াস্ক শহরে থেকেছি। সে শহরের কথা এখনো মনে আছে। ফলে যুদ্ধ আক্রান্ত দানিয়াস্কের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে কষ্ট হয়। পরে মস্কো এসে প্লেখানভ ইনস্টিটিউটে [প্লেখানভ রাশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকস] অর্থনীতিতে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে অনার্স, মাস্টার্স করেছি। ১৯৯২-৯৩ সালে অক্সফোর্ডে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা গড়ে তোলার ওপর ‘বাংলাদেশের পরিকল্পনার তুলনামূলক বিচার’ বিষয়ে পিএইচডি ও উত্তর-পিইচডি করেছি। স্ত্রী [ইরিনা] একই ইনস্টিটিউটে পড়ত। ভালো ছাত্রী বলে বৃত্তি নিয়ে ভ্লাদিভোস্টক থেকে মস্কোতে পড়তে এসেছিল। সেও অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছে। ১৯৮০ সালে আমাদের পরিচয়, দুজনেই তখন পিএইচডি করছি। পিএইচডি শেষে ১৯৮৪ সালে বিয়ে করলাম।

দেশে ফিরে?

বিআইডিএসে [বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ] অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল না কিন্তু তিনি মা-বাবাকে জানতেন। তিনি জিজ্ঞাস করলেন, ‘তুমি কী শিখে এসেছ?’ ভাবলাম, অপ্রচলিত কিছু শিখেছি বললে তো চাকরি দেবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যেসব বিষয় পড়ানো হয় তাই বললাম। তিনি বললেন, ‘তাহলে তোমার বিশেষত্ব কী? ভিন্ন কিছু তো শিখে আসনি। প্রচলিত অর্থনীতিই শিখে এলে, তোমাকে দিয়ে আমার উপকার কী? এ যোগ্যতা তো অন্যদেরও আছে।’ তখন আস্তে আস্তে বলা শুরু করলাম, স্যার অপ্রচলিত বিষয়ও কিছু কিছু পড়েছি। তিনি উৎসাহিত হলেন, ‘বলো, বলো।’ বললাম। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইংরেজিতে কেমন?’ বললাম, ‘আমি কোনো অসুবিধা দেখি না।’ তখন বললেন, ‘সামনের সোমবার থেকে কাজে এসো।’ ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে বিআইডিএস পরিচালনাধীন তাঁর একটি প্রকল্পে চাকরি শুরু করলাম।

কী কাজ করতেন?

তখন তো দেশ চরমভাবে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীল। সেই প্রকল্পে ‘বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতার সংকট’ নিয়ে কাজ করেছি। একসময় বিআইডিএসে নিয়মিত চাকরি হলো। সেই থেকে ৩০ বছর তাঁর সঙ্গেই আছি। তিনি আমার পেশাজীবনের গুরুদেব। একসময় তিনি অবসর নিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হলেন। সিপিডি [সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ] প্রতিষ্ঠা করলেন। আমিও এই প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্ত হলাম।

তারপরের গবেষণা?

পরের সব কাজই শিল্প অর্থনীতি নিয়ে। রেশম-মসলিন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বস্ত্রখাত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করেছি। আমরা শিল্পায়নের চেষ্টা করি। কিন্তু কৃষিনির্ভরতা থেকে শিল্প বিকাশে যেতে হলে তো রপ্তানি বাড়াতে হবে। রপ্তানি করতে হলে ব্যক্তি খাতে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে হবে, উত্পাদন বাড়াতে হবে—এসব নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে কাজ করেছি। ১৯৯৬ সালে বর্তমান সরকারের আগের আমলের শিল্পনীতিটি আমার হাতে তৈরি। ২০০০ সালের পরে আমাদের গ্যাস খাত নিয়ে যে প্রবল বিতর্ক হয়েছে, এমনকি ভারতে গ্যাস রপ্তানির কথা আলোচনা হয়েছে, তখনকার বিএনপি সরকার প্রকৃতপক্ষে দেশে কতটুকু গ্যাস আছে বা গ্যাস রপ্তানি করা ঠিক হবে কি না বুঝতে যে কমিটি করেছিল আমি তার সদস্য ছিলাম। গ্যাস রপ্তানি ঠেকিয়ে কিভাবে তা দেশের কাজে লাগানো যায়, কমিটিতে এই মতামত সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছি। একইভাবে ১৯৯৬ সালের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরিতে কাজ করেছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য কাজ?

সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি ডাব্লিউটিওকেন্দ্রিক [বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা] বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে। ১৯৯৬ সালে ডাব্লিউটিও গড়ে ওঠার পর থেকে সেখানে দেশের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব—সেই দরকষাকষিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছি। দুই দশক এ খাতে কাজের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দোহা বাণিজ্য আলোচনাকে সম্পূর্ণ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে ডাব্লিউটিওর সদর দপ্তর জেনেভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের দুদিন আগে নিজের বিবেচনাবোধ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। যদিও নতুন সরকার পাঁচ মাস পর সেটি গ্রহণ করেছে। এরপর সিপিডিতে ফিরে এলাম। এর আগে তো এখানে আট বছর নির্বাহী পরিচালক ছিলাম।

ছেলেমেয়ে?

আমাদের এক সন্তান। সে আইনজীবী। আলেকজান্দ্রা গ্রিন হেরাল্ড থেকে ‘ও’ লেভেল করে দুই বছর অক্সফোর্ডে ‘এ’ লেভেলে পড়েছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে এলএলবি, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনির্ভাসিটি থেকে এলএলএম করেছে। এখন জেনেভায় জাতিসংঘের এজেন্সি ডাব্লিউআইপিওতে [ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন] মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে কাজ করে।

দেশে ফিরে এসে তো রাজনীতি করেছেন?

১৯৮০-এর দ্বিতীয় ভাগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছি। ‘ঢাকা ঘেরাও’-এ ছিলাম। কারফিউ ভেঙে মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধে গিয়েছি। আধা-সরকারি চাকরি করি, রাজপথে মিছিল-সমাবেশও করি। ফেরার পাঁচ-ছয় বছর তো আন্দোলনেই কেটেছে।


Dr Debapriya Bhattacharya-kalerkantha02পলিটিকস কেন ছাড়লেন?

[দীর্ঘশ্বাস], দলীয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি; মূল্যবোধের রাজনীতি নয়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সিপিবিতে কোনো পদে ছিলাম না, সাধারণ কর্মী হয়েই খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের সংগ্রামে থেকেছি। সমাজ বদলের বিজ্ঞান আত্মস্থ করতে চেয়েছি, একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে চেয়েছি। জানতে চেয়েছি, সমাজকে সাধারণ মানুষের সার্বিক বিকাশের পক্ষে কিভাবে দাঁড় করানো যায়। একসময় দেখলাম, যে সমাজব্যবস্থাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম, তা বাস্তবে টেকসই হলো না। সে পরিপ্রেক্ষিতে মন ভাঙল, দলও ভাগ হয়ে গেল। নানা উপচিন্তা বেরোলো। তখন থেকে দলীয় রাজনীতি ছেড়ে নতুন আত্মজিজ্ঞাসায় ব্যাপৃত হয়েছি।

আবার করবেন?

আমরা তো জ্ঞান চর্চার মানুষ। জ্ঞান যদি মানুষের কাজে না লাগে সে জ্ঞান দিয়ে কী করব? জ্ঞান কি ভেজে খাব? জ্ঞানকে প্রয়োগ করে পরিবর্তন আনতে চাই। এভাবেই তো জ্ঞানের সঠিকতা যাচাই হয়। দেখলাম, অধীত জ্ঞান সর্বদা সত্যতা যাচাইয়ে সফল হচ্ছে না। ফলে প্রয়োগ থেকে আবার জ্ঞান অনুশীলনে ফিরতে হলো। পরিবর্তনের লক্ষ্যে নতুন প্রয়োজনে অবশ্যই নীতি বিশ্লেষণ থেকে নীতি প্রয়োগে আবার যুক্ত হব।