Originally posted in বিবিসি বাংলা on 19 August 2022
জ্বালানি তেল: বিশ্ববাজারের সাথে বাংলাদেশে দাম সমন্বয় হয় না কেন?
বাংলাদেশে সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানোর পর সরকারের তরফ থেকে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছিলো যে বিশ্ববাজারে দাম কমলে বাংলাদেশেও দাম কমানো হবে।
তবে গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে আসলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমানোর কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সরকার গত ছয়ই অগাস্ট ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা এবং পেট্রলে ৪৪ টাকা বাড়িয়েছে।
একবারে জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন এমন বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। এর প্রভাবে বাজারে যেমন সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে পরিবহন খরচও।
এভাবে দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যা দিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছিলো যে ২০২১ সালের তেসরা নভেম্বর স্থানীয় পর্যায়ে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য বৃদ্ধি করে পুনর্নির্ধারণ (ডিজেল ৮০ টাকা ও কেরোসিন ৮০ টাকা) করা হয়।
সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা সত্ত্বেও অকটেন ও পেট্রলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি।
এর আগে ২০১৬ সালে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে পুননির্ধারণ করেছিলো।
অর্থাৎ এর পর দীর্ঘদিন আর আন্তর্জাতিক বাজারের দামের ওঠানামার সাথে সমন্বয় করা হয়নি।
বিশ্ববাজারে দামের হেরফের
গত জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম শুধু বেড়েই যাচ্ছিলো। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি ২০-২৭ ডলারের জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ১২০ ডলারের মতো হয়ে গেলে উদ্বেগে পড়ে বাংলাদেশ সহ উঠতি অর্থনীতির দেশগুলো।
কিন্তু দাম যখন কম ছিলো, তখন সরকার দেশে তেলের দাম না কমিয়ে লাভ নিয়েছে। কিন্তু এখন যখন আবার কমছে, তখন সংকট এড়াতে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কিছুটা কমে আসার ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য আরও বেড়ে যায়।
ক্রুড অয়েলের মূল্য এ বছরের জুনে ব্যারেল প্রতি ১১৭ মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছিলো। গত কয়েকদিনে সেটি কমে এসে ৯৫ ডলারের আশেপাশে আছে।
মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। কিন্তু তখনো মূল্য সমন্বয় করার পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত ডিজেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ১৭০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। তবে বাংলাদেশ দাম সমন্বয় করেনি।
কিন্তু যখন বিশ্ববাজারে দাম কমছে, তখন এক সাথে ব্যাপক ব্যবধানে দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সমন্বয় করে না কেন?
আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সাথে সমন্বয় না করার যুক্তি হিসেবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ধাপে ধাপে দাম বাড়ালে লিটার প্রতি দশ টাকা করে প্রতি মাসেই বাড়াতো হতো।
যদিও গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ডঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন যে মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সাথে প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয় না।
১. অভ্যন্তরীণ মার্কেটে মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রিত দাম। এমনকি এলএনজি ছাড়া অন্য কিছুতে বেসরকারি খাত নেই বলে কোন প্রতিযোগিতাও নেই। তেল আনাই হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসির মাধ্যমে।
২. সরকার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে তেল ক্রয় করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে।
অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ মার্কেটে সরকার যে দাম ঠিক করে দেয়, সে দামেই ভোক্তা ক্রয় করে। আর এই দাম নির্ধারিত হয় সরকারি সিদ্ধান্তে, বাজারের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়।
“সরকার হয়তো গণমানুষ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তা করে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা থেকে ভোক্তাদের বাইরে রাখতে চায়। কিন্তু মাঝে মধ্যে এটা ভোক্তার জন্য সমস্যাও হয়ে দাঁড়ায়,” বলছিলেন মিস্টার মোয়াজ্জেম।
আবার সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে তেল কেনে। আর সে চুক্তি হয় মূলত কত জাহাজ ও লিটার তেল কেনা হবে তার ওপর।
ফলে যখন যে চুক্তি হয়, সে চুক্তি অনুযায়ীই তেল পাওয়া যায়- বিশ্ববাজারে দাম যাই হোক না কেন।
অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি হলে এখন যে দাম আছে, সেই দামে কিনলে দাম আরও কমলেও চুক্তির দামই দিতে হবে।
“লং টার্মে গেলে তুলনামূলক কম দামে তেল পাওয়া যায়। শর্ট টার্মে ঝুঁকি বেশি। সরকার এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে কিনেছিলো। শুরুতে সুবিধা পেয়েছিলো। কিন্তু পরে অনেক বেশি দামে কিনতে হয়েছে। আর এখন তো দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিই করাই যাচ্ছে না,” বলছিলেন মিস্টার মোয়াজ্জেম।
বিশ্ববাজারে দাম তুলনামূলক কম থাকার সুবাদে ২০১৪ সালের পর থেকে বিপিসি পরবর্তী সাত বছরে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে।
যদিও ২০১৪ সালের আগে বেশ কয়েক বছর ক্রমাগত লোকসানের কারণে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে আবার প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১১শ কোটি টাকা লোকসানের কথা জানিয়েছে বিপিসি যদিও সংস্থাটি গত কয়েক বছরের লাভ থেকে প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছে।
“ফলে বিপিসি এফডিআর অক্ষত রেখে তেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করেছে আর ভোক্তাকে এখন নিজের এফডিআর ভেঙ্গে সে তেল কিনতে হচ্ছে। এ জন্য ভোক্তাকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল দিতে মাঝে মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয়টাও দরকার,” বলছিলেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।