Originally posted in সমকাল on 7 August 2022
ডিজেল-কেরোসিনের মতো জ্বালানিকে বিবেচনা করা হয় জীবনযাত্রার খরচের ‘সংক্রামক’ পণ্য হিসেবে। এর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের খরচের পারদও চড়তে থাকে। থমকে যায় জীবন চলার গতি। সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ায় খরচের নিচে বেশি চাপা পড়বে সাধারণ মানুষ। করোনা অতিমারির পর মানুষ এমনিতেই ধুঁকছে। তার ওপর সরকার এমন এক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে গেল, যখন দেশের পণ্যবাজার অস্থির।
গেল ফেব্রুয়ারির শেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হয়ে ওঠে অস্থিতিশীল। এরপর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কয়েক বছরের মধ্যে শীর্ষে ওঠে। প্রতি ব্যারেলের দর ১১০ ডলারে গিয়ে ঠেকে। যদিও সম্প্রতি তা ৯৪ ডলারে নেমেছে। জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ বাজারে দর সমন্বয় করেনি। তবে বিশ্ববাজারের পড়তি সময়ে এসে গত শুক্রবার রাতে সরকার দেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
এদিকে জ্বালানি তেলের দর বাড়ার পটভূমিতে গতকাল শনিবার রাতে দূরপাল্লার বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আর মহানগরের বাস ও মিনিবাসে ভাড়া কিলোমিটারে বাড়ানো হয়েছে ৩৫ পয়সা।
পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিজেলের নতুন দরের কারণে বাসের পাশাপাশি লঞ্চের ভাড়াও বাড়বে। ট্রাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁদের খরচ বাড়বে আরও বেশি। রড, স্টিল, সিমেন্ট খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁদের উৎপাদন খরচ বাড়বে ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত। খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ীরা উৎপাদন ও পরিবহন খরচ ১০ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, কাঁচামাল আনার সময় যেমন খরচ বাড়বে, প্রস্তুত পণ্য সরবরাহেও বাড়তি খরচ করতে হবে।
আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়বে দ্রুত। সরকারের ভর্তুকি খরচ হয়তো কিছুটা কমবে। তবে হঠাৎ ব্যাপক হারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন বা টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ বেড়ে যেতে পারে। সময়মতো উদ্যোগ না নেওয়ার খেসারত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো হয়েছে। এখন কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন খরচ বাড়বে। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, যা মূল্যস্ম্ফীতিকে উস্কে দেবে। এতে দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ও বৈষম্য বাড়বে। কমবে শিল্প খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। তাঁরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের বাস্তবতা আছে। তবে একবারে এত বেশি না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে করা যেত। মানুষকে খাপ খাওয়ানোর সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের যে সাশ্রয় হবে, সে অর্থ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে সরাসরি দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তারা নিম্ন আয়ের বয়স্ক, বিধবা, অন্তঃসত্ত্বা এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্যও সরকারের খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সাশ্রয়ী দামে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে, যেখানে গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নইলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির বড় অবনতির শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে তিন মাস ধরে মূল্যস্ম্ফীতি ৭ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এ হার গত ৮ থেকে ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সর্বশেষ জুলাইয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ম্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যসূচকে মূল্যস্ম্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। খাদ্যসূচকে গত বছরের একই মাসের চেয়ে বেড়েছে ৩ দশমিক ১১ শতাংশীয় পয়েন্ট। আর জুলাইয়ে খাদ্যবহির্ভূত সূচকে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ মূল্যস্ম্ফীতি হয়েছে। এ সূচকে এক বছরে বেড়েছে মাত্র ৪৯ শতাংশীয় পয়েন্ট। জ্বালানি তেল ও পরিবহন ভাড়া খাদ্যবহির্ভূত সূচকের মধ্যে পড়ে। ফলে এখন এ সূচকে বাড়তি চাপ তৈরি হবে, পাশাপাশি খাদ্যের দামও বাড়বে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে। ফলে সার্বিক মূল্যস্ম্ফীতির হার আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুর্যোগের এ সময়ে জ্বালানি তেলের দাম এত বেশি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত এবং অনপোকারী। সরকারের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির গভীর কাঠামোগত সমস্যা প্রকাশ পেয়েছে। সরকার আর্থিক সংহতিকরণের মাধ্যমে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় যেতে পারেনি। কর আহরণের হার কম থাকায় সরকারের হাতে এই জটিল সময়ে ব্যয়যোগ্য সম্পদ নেই। ভর্তুকিকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন সময়ে কাঠামোগত সংস্কার না করার অবধারিত পরিণতি। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ। যাদের বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ার সঙ্গে আয় বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, “আমি মনে করি, সরকারের এ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আইএমএফকে ‘সাক্ষী গোপাল’ মানার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজের অর্থনীতির ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে। আইএমএফের ওপর চাপালে মনে করতে হবে, আমরা নিজেদের নীতি সার্বভৌমত্বকে পরিত্যাগ করেছি।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা আছে। তবে ধাপে ধাপে বাড়ানো যেত। তিনি বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। এ ধরনের মানুষকে বাড়তি খরচের চাপ থেকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতা ও ভাতাভোগী বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যবস্থায় সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, একবারে এত দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বেড়ে গেল। দিনমজুর, কৃষকসহ নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে টিকে থাকতে পারে সেজন্য বিকল্প উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। অযৌক্তিকভাবে পরিবহন ভাড়া যাতে না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্কুলগুলোতে পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শহরে যানজট যাতে কমে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এক কথায় মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। বাড়াতে হবে সরকারের রেশন ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে সরবরাহ। অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা কমাতে নিতে হবে উদ্যোগ।
আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ার প্রভাব সবক্ষেত্রেই পড়বে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচের ১২ থেকে ২০ শতাংশ ডিজেল বাবদ খরচ হয়। তেলের দাম বাড়ার ফলে বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খরচও। তিনি বলেন, এতে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি যারা সরকারের সঙ্গে পণ্য সরবরাহের চুক্তি করে ফেলেছে তারা বেশি চাপে পড়বে। অনেক প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন হবে না।
এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেই পড়বে। উৎপাদন, পরিবহন সবক্ষেত্রেই প্রভাব পড়বে। এতে খরচ বেড়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। আগামীতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশেও কমানোর অনুরোধ করেন তিনি।
অ্যাক্সেসরিজ উৎপাদনকারীদের সংগঠন বিপিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের খান বলেন, হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে শিল্পে মহাসংকট দেখা দিয়েছে। শুক্রবার রাত থেকেই ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বিদ্যুৎ স্বল্পতার কারণে আগেই কারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থায় ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে ২০ শতাংশ। এখন আবার এর ওপর ৪০ শতাংশ দাম বাড়ায় ব্যাপারটা হয়েছে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো।
এদিকে নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও ওভেন পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর চট্টগ্রাম অংশ আলাদা আলাদা বিবৃতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিকেএমইএ বলেছে, এ সিদ্ধান্তের কারণে চাপে পড়বে রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। সংগঠনটি বিকল্পভাবে সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম বিজিএমইএ বলেছে, এ সিদ্ধান্তে পোশাকশিল্পে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। ফলে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়তে হবে। এতে শ্রম অসন্তোষসহ পোশাক শিল্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, জ্বালানি তেলের দর পোশাক খাতে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। নতুন করে রপ্তানি আদেশ নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে। ইতোমধ্যে নেওয়া রপ্তানি আদেশের পোশাক উৎপাদন এবং ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করতে লোকসানে পড়বে এই খাত। এ কারণে কিছু কারখানা টিকতে পারবে না। বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না। এমনিতে কয়েক দিন ধরে জ্বালানি সাশ্রয়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের সমস্যায় রয়েছে কারখানাগুলো। সে কারণেও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর ওপর এই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ভার নেওয়ার সক্ষমতা নেই এই শিল্পের। এ কারণে নতুন বছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, রাজস্ব সংগ্রহ বিবেচনায় নিয়ে সরকার ভর্তুকি বাবদ খরচ বাড়াতে চাচ্ছে না। এই অর্থবছরের বাজেটে সার, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বাবদ ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে সার, গ্যাস, জ্বালানি তেলের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে এ পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে বছর পার করা সম্ভব হবে না। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল বাজেটে এসব খাতে ভর্তুকি বাবদ ৪২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর পরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্থবছর শেষে ভর্তুকি ৬৬ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে।
জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, অনেকেই বলছেন, তেলের দাম একবারে এত বাড়ানো উচিত হয়নি। ভর্তুকি দিলেই হতো। কত ভর্তুকি দেওয়া যায়, একটা সীমাবদ্ধতা আছে। হয় টাকা ছাপাতে হতো, না হয় অন্য খাতে ভর্তুকি কমিয়ে জ্বালানি তেলে দিতে হতো। এতে সামগ্রিক বাজেটের ঘাটতি আরও বেড়ে যেত।
এদিকে জ্বালানি বিভাগ বলছে, পাচার ঠেকাতে এবং বিপিসির আর্থিক সক্ষমতা ধরে রাখতে তেলের দাম না বাড়িয়ে উপায় ছিল না।