Published in সমকাল on Sunday, 26 February 2017
কয়েক বছর ধরেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার দর স্থিতিশীল রয়েছে। একটা সময় ছিল যখন মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার দাম নিয়মিত কমে যাচ্ছিল। ‘টাকার আরেক দফা অবমূল্যায়ন’_ এটা ছিল সংবাদপত্রের নিয়মিত শিরোনাম। এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো বাংলাদেশ ব্যাংকে, তবে তাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সায় থাকত। এ অবস্থায় এক যুগেরও বেশি আগে ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট থেকে ম্যানেজড ফ্লোটিং রেটে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটে। পরের বছরগুলোতে ডলার এবং অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় বাংলাদেশের টাকার কখনও অবমূল্যায়ন ঘটেছে, কখনও বা স্থিতিশীল রয়েছে। একটা সময় মনে হচ্ছিল, এক ডলারের মূল্য ১০০ টাকায় পেঁৗছাতে পারে। অফিসিয়াল রেট ও বাইরের বিনিময় হারেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে শেষ পর্যন্ত ডলার কিনতে ১০০ টাকার প্রয়োজন পড়েনি। টাকা ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। বরং বিনিময় হারে এক ধরনের স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মুদ্রার তুলনায় টাকার অবস্থান বেশ ভালো ছিল।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রবণতা মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। খোলা বাজারে বা কার্ব মার্কেটে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য বেশি। এ অবস্থায় প্রবাসে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশি তাদের আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠাতে নিরুৎসাহ বোধ করছে। খোলা বাজারে যদি এক ডলারের বিনিময়ে ৮২ টাকা মেলে, তাহলে কেন তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়ে ৭৮ টাকা গ্রহণ করবে? ধরা যাক, প্রতি মাসে ব্যাংকের মাধ্যমে ১০০ কোটি ডলার দেশে আসে। অফিসিয়াল ও কার্ব মার্কেটের রেটের পার্থক্যের কারণে প্রাপকরা তাহলে কিন্তু ৪০০ কোটি টাকা কম পাবে।
বিনিময় হারে কয়েক বছর স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ সময়ে রফতানিকারকরা সুবিধা পেয়েছে। প্রবাস থেকেও অর্থ প্রবাহ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ছিল নিয়ন্ত্রণে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে কখনও দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। বরং আমরা দেখি, ক্রমাগত এর পরিমাণ বেড়ে চলছিল। রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ- এমনটিও সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে অনেকবার। এ সময়ে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করি- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহতভাবে ৬ শতাংশের ওপরে থাকা, যা সাত শতাংশও অতিক্রম করার পর্যায়ে রয়েছে। উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও বাংলাদেশ তার এ অবস্থান ধরে রাখতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই অংশীদার চীন ও ভারত। তবে দুটি দেশ থেকেই আমাদের রফতানির তুলনায় আমদানি অনেক বেশি। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বের নজর কাড়তে শুরু করেছে অনেক আগেই। বিশ্ববাজারে রয়েছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে তাদের রফতানি প্রচুর। আবার এসব দেশেই বাংলাদেশের রফতানি পণ্য, বিশেষ করে পোশাকের বাজার। ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল থাকায় রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, এমন অভিমত বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যেতে থাকে। তারা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে টাকার মূল্যমান কিছুটা কমানোর সময় এসেছে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, গত কয়েক বছরে ডলারের বিপরীতে এশিয়ার প্রায় সব প্রধান মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। কিন্তু টাকার দর স্থিতিশীল ছিল। ফলে টাকা এখন ‘অতিমূল্যায়িত’। বাংলাদেশের পণ্য যারা আমদানি করে তারা এ অবস্থায় নিরুৎসাহ বোধ করবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের রফতানিকারকদের তুলনায় তারা আমাদের প্রতিযোগীদের কাছ থেকে সুবিধাজনক সরবরাহ-দর পেয়ে যায়।
প্রবাসীদের মাধ্যমে যে অর্থ আসে, বৈধ চ্যানেলে তার গড় পরিমাণে সম্প্রতি ভাটার টান- এমন খবর নিয়মিত গণমাধ্যমে আসছে। অর্থমন্ত্রীও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। এর কারণ সঙ্গত- অফিসিয়াল ও কার্ব মার্কেটের রেটের পার্থক্যের কারণে প্রেরকরা বিকল্প সন্ধান করে এবং হুন্ডি-চক্র তার সুযোগ নেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন নতুন জমানা- ডোনাল্ড ট্রাম্প নিত্যদিন সংবাদ শিরোনাম। তার নীতি রক্ষণশীল। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো হবে, এমন আলোচনা চলছে। ফলে ডলার আরও তেজি হবে। এ কারণে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে ধারণা। আমরা বর্তমান ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট ধরে রাখলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স, উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে, ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমানো হলে আমদানি বাণিজ্যে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি এবং এ অবস্থায় পরিবর্তন ঘটার কথা নয়। আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য হচ্ছে পোশাক। এ শিল্পের প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ কাঁচামালও আমরা আমদানি করে থাকি। রফতানি আয় বাড়াতে গিয়ে আমদানি ব্যয়ও কিন্তু আমরা বাড়িয়ে ফেলব, যার প্রভাব শিল্প-বাণিজ্যে ও জনজীবনে পড়বে।
তবে আরেকটি বিষয়ের প্রতিও খেয়াল রাখা দরকার। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে। বিশ্ববাজারে মাঝে মধ্যে তেলের দাম কিছুটা বাড়ার প্রবণতা রয়েছে। তবে ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যমান কিছুটা কমানো হলেও আমাদের দেশীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাব খুব একটা পড়বে না। আমাদের এক সময়ে প্রচুর চাল আমদানি করতে হতো। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। দেশের চাহিদা মেটাতে সামান্য পরিমাণ চাল দেশে আমদানি হয়। ভোজ্যতেল, গম ও ডালের বাইরে অন্যান্য খাদ্যপণ্যের আমদানিও খুব বেশি নয়। তবে অনেক শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের জন্য আমরা যেহেতু আমদানির ওপর নির্ভরশীল, সে কারণে শিল্প খাতে কিছু সমস্যা হতেই পারে।
এই সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রার মূল্যমানের প্রতি রাখা চাই বিশেষ নজর। আমাদের পোশাকের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব শিল্পকে সংরক্ষণ সুবিধা দিতে সচেষ্ট রয়েছে। এ জন্য তারা আমদানি শুল্ক বাড়াবে। তবে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির খবর যে, যুক্তরাষ্ট্রে এখন পোশাক তৈরির শিল্প নেই।
অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)