Originally posted in দৈনিক সমকাল on 12 March 2024
গত ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের ফেসবুক পেজে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য তাঁতি সমবায় সমিতি টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি পেয়েছে। এ খবরে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা এ ধরনের কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারও প্রতিক্রিয়া জানায়। পরে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ অনুসৃত হয়েছে কিনা, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, ভারত ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইর জন্য আবেদন করে। চার বছর ধরে ক্রমাগত যাচাই এবং সংশোধন শেষে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘দি ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ইন্ডিয়া পেটেন্টস ডিজাইন ট্রেডমার্ক জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস’ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তাঁতি সমবায় সমিতি লিমিটেডের অনুকূলে ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে জিআই সনদ ইস্যু করে। এই চার বছর বাংলাদেশ এ ব্যাপারে অবগত ছিল না বা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত ছিল। ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট ভারতের মেধাসম্পদবিষয়ক অফিস ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ইন্ডিয়া এ বিষয়ে জার্নাল প্রকাশ করে এবং জিআই সনদ দেওয়ার আগে কারও আপত্তি থাকলে তা জানানোর আহ্বান জানিয়ে জার্নালটি তাদের ওয়েবসাইটে পাঁচ মাস রাখা হয়। দুঃখজনক, বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) এবং ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন অনুমোদিত তিন মাস সময়ের (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর, ২০২৩) মধ্যে আপত্তি জানাতে ব্যর্থ হয়। নয়াদিল্লির দিক থেকেও ঢাকাকে সতর্ক করা হয়নি। সমনামি পণ্যের ক্ষেত্রে, যেখানে অন্য পক্ষ জিআই দাবি করতে পারে; সতর্ক করার রেওয়াজ রয়েছে।
ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার পর বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ২০২৪ সালের ১৯ মার্চের মধ্যে সব নিবন্ধিত ও নিবন্ধনের উপযোগী জিআই পণ্যের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। শিল্প মন্ত্রণালয় টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই আবেদন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি জরুরি বৈঠক ডাকে। এর মাত্র এক দিন পর অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইর জন্য ডিপিডিটিতে আবেদন করে। এর পর প্রধানমন্ত্রী গত ১১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেশের সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোকে জিআই নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাঁর ব্রিফিংয়ে জানান, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো বৈরিতা হলে বাংলাদেশ যথাযথ আন্তর্জাতিক সংস্থায় (সম্ভবত ডব্লিউআইপিও তথা বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার প্রতি ইঙ্গিতপূর্বক) সমাধানের জন্য যেতে পারে এবং এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে।
সঠিক পথ কোন দিকে
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত সমস্যাটিকে আমলে নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, টাঙ্গাইল শাড়ির মালিকানা বিষয়ে সরকার কি সঠিক কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে? আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত নই। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, সরকার এই ইস্যুতে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিবেচনা না করে কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। সরকারের প্রতিক্রিয়ার ধরন অনেকটা জনসংযোগ চর্চার মতো। যদি আইনসম্মতভাবে এবং সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিভিন্ন পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে টাঙ্গাইল শাড়ির ওপর আমাদের ন্যায়সংগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার সব চেষ্টা নিরর্থক হবে।
আমরা মনে করি, পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক আইন, ২০১৩ (নিবন্ধন ও সংরক্ষণ)-এর নির্দেশিত প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ এবং যথাযথভাবে অনুসরণ করে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া উচিত। ভারতের নিবন্ধনের প্রতিক্রিয়ায় ডিপিডিটি তাড়াহুড়ো করে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু করে। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসন মাত্র এক দিনের মধ্যে আবেদনের কাজ সম্পন্ন করে; কেবল আগে থেকে প্রক্রিয়া এগিয়ে থাকলে যা সম্ভব বলে আমাদের কাছে মনে হয়। কিন্তু সেই প্রস্তুতি ছিল কিনা, আমাদের জানা নেই।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি ডিপিডিটি টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে ‘স্বীকৃতি’ দিয়েছে বলে ঘোষণা আসে। বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা বাসস সংবাদ প্রকাশ করে। এখানে ‘স্বীকৃতি’ শব্দটি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। মূলত ডিপিডিটি জেলা প্রশাসনের আবেদন অনুমোদন করে এবং ৯ ফেব্রুয়ারি জিআই জার্নাল প্রকাশ করে। এর অর্থ এই নয়– টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ অনুমোদন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন গণমাধ্যমে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সংবাদ প্রকাশিত হয়, প্রধানমন্ত্রী টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ গ্রহণ করেছেন। বস্তুত ডিপিডিটি এখনও আইন অনুযায়ী টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শেষ করেনি। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এখনও জিআই পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ি তালিকাভুক্ত হয়নি।
পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক আইন, ২০১৩ (নিবন্ধন ও সংরক্ষণ)-এর অধ্যায় ৪-এর ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রেজিস্ট্রার যদি মনে করেন, আবেদনে সব শর্ত পূরণ করা হয়েছে, তাহলে আবেদনটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশিত হবে। আইনের চার অধ্যায়ের ১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী আগ্রহী কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে পণ্যটির নিবন্ধন বিষয়ে আপত্তি জানাতে পারে। এর মানে, আইন অনুযায়ী শুধু ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিলের পর ডিপিডিটি টাঙ্গাইল শাড়ির নিবন্ধন করতে সক্ষম হবে।
ভারতে আইনের আশ্রয়
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে টাঙ্গাইল শাড়ির নিবন্ধন ভারতকে এই পণ্যকে জিআই হিসেবে ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে পারবে না। তারা এর বাণিজ্যিক সুফল গ্রহণ করতে থাকবে। এদিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিয়ে ফেসবুক ও টুইটার থেকে তাদের পোস্ট সরিয়ে নিয়েছে। তারা এই জিআই উদ্যোগ বাতিল করেছে মর্মে আমাদের দেশের কয়েকজন মন্ত্রী বক্তব্য দিয়ে আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। তাদের বক্তব্য সঠিক নয়। কেননা, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে এখনও ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’ জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে।
আমরা মনে করি, স্থানীয় তাঁতিদের অন্যায্য প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করতে সরকারকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই ইস্যুতে ভারতকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। ‘সুই জেনেরিস’ শীর্ষক পদ্ধতিগতভাবে জিআই পণ্য যেহেতু জাতীয়ভাবে অনুমোদিত ও স্বীকৃত হয়, সেহেতু বাংলাদেশকে প্রথমে টাঙ্গাইল শাড়ির ওপর নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের আদালতে যেতে হবে। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আপিলেট বোর্ডের (আইপিএবি) কাছে তিন মাসের মধ্যে আপিলের কথা বলা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে আগামী ২ এপ্রিলের মধ্যে আপিল করতে হবে।
অবশ্য ২০২১ সালে আইপিএবি ভেঙে দেওয়া হয় এবং দিল্লি হাইকোর্ট ও মাদ্রাজ হাইকোর্টে মেধাসম্পদ বিষয়ে দুটি আলাদা শাখা গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল রিফর্মসের (র্যাশনালাইজেশনস অ্যান্ড কন্ডিশনস) অধীনে ভারতের রেজিস্ট্রার অব জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস বরাবর এবং দিল্লি হাইকোর্ট ও মাদ্রাজ হাইকোর্টে আপিল করা যেতে পারে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনে যদি জিআই সম্পর্কিত কোনো আইনের লঙ্ঘন হয়, তাহলে রেজিস্ট্রার অথবা হাইকোর্টের জিআই বাতিল বা স্থগিত করার ক্ষমতা রয়েছে।
বাংলাদেশের এই ইস্যুতে শক্ত যুক্তি রয়েছে। ভারত তাদের জিআইতে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ ব্যবহার করেছে। টাঙ্গাইল বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাঁতিদের অভিবাসনের মাধ্যমে দক্ষতা এবং জ্ঞান স্থানান্তরের যে যুক্তি দিয়ে ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধন করেছে, তা বাস্তবভিত্তিক নয়। জিআই অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য হতে হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে সমাধান যেভাবে
মনে রাখতে হবে, বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা-ডব্লিউআইপিওর অধীনে টাঙ্গাইল শাড়ি ইস্যুতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আপাতত কোনো অবকাশ নেই। কেননা, বাংলাদেশ এবং ভারত কোনো দেশই দ্য লিসবন এগ্রিমেন্ট ফর দ্য প্রটেকশন অব অ্যাপলেশনস অব অরিজিন অ্যান্ড দেয়ার ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন (১৯৫৮)-এর স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। লিসবন চুক্তি হলো জিআই সুরক্ষার জন্য একমাত্র আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ। বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ে এ চুক্তিতে স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিতে পারে। উপরন্তু ডব্লিউআইপিওর সদস্য দেশগুলোর জন্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা আছে।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে এবং ভারতের আদালতে কোনো ফলাফল না এলে বাংলাদেশ ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপস) চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে পারে। ট্রিপস চুক্তির অধ্যায় ২২ অনুযায়ী ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’ শিরোনাম পণ্যের সঠিক উৎসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে– এ অভিযোগ আনা যেতে পারে।
উপসংহারে বলা যেতে পারে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধন বাতিল এবং বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে এর নিবন্ধন সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং বহু ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকারের এ তৎপরতাকে কার্যকর ও অর্থবহ করতে আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়কে সহায়তাকারী একটি ‘টাস্ক টিম’ গঠনের সুপারিশ করছি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও নাইমা জাহান তৃষা যথাক্রমে সম্মাননীয় ফেলো ও প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট, সিপিডি