ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
দেশের থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে খ্যাত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে নতুন সরকার। এগুলো হলো প্রথমত, সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা। দ্বিতীয়ত, পুনর্জীবনী কর্মসূচি ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল করা। আর তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো।
গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে সমাজসচেতন এই বিশ্লেষক আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে তার কূটনৈতিক ব্যাখ্যা করলে এটা পরিষ্কার তারা নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আরেকটা নির্বাচন চাইছে। এ বক্তব্যগুলো বিদেশের যে কোনো নাগরিক কিন্তু দিচ্ছে না। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে। এটা দেশ হিসেবে আমাদের সবলতা নাকি দুর্বলতার লক্ষণ?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। যদি দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মধ্যমেয়াদি সংকটে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। উৎপাদক পর্যায়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি করছে। গত দুই বছরের বিনিয়োগের পতনের ধারাকে আরও জোরদার করছে। এর ফলে পর পর তৃতীয়বারের মতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের পতন ঘটতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তিন দশকের এক শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি বাড়ার ধারা থেকে দেশ বিচ্যুত হতে পারে। এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বলতম বিষয় হলো বিনিয়োগ হারের পতন। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ। গত দুই বছর সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের কমতিকে পুষিয়ে নেওয়া গেছে কিছুটা। অর্থাৎ ব্যক্তি খাতে পতন হলেও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় মোট বিনিয়োগ মোটামুটি আগের বছরের সমান ছিল। এ বছর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এবং সরকারি খাতের বিনিয়োগ_ উভয়ই কিন্তু এখন নিম্নমুখী হয়ে গেছে। তাই এবার মোট বিনিয়োগে হারের পতন ঘটতে পারে। তার মতে, বেসরকারি খাতে যে বিনিয়োগ কমে গেছে, তার প্রমাণ হলো গত জুনে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের হার যা ছিল, এখন তা আরও কমে গেছে। শিল্প ঋণের বৃদ্ধির হারও ঋণাত্দক। ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য ৮৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। তফসিলকৃত মন্দ ঋণের হারও গত পাঁচ মাসে আরও বেড়ে গেছে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় আমদানি প্রবাহে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। স্থবির আমদানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিনিয়োগের ধারাবাহিক পতনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বড় ভূমিকা রাখছে। অনিশ্চিত রাজনীতিতে কোনো বড় বিনিয়োগ হয় না। সরকারি বিনিয়োগ যে এবার কমে যাচ্ছে, তার বড় প্রমাণ হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে এ বছর সর্বনিম্ন। গত বছরের প্রথম চার মাসের ২০ শতাংশের বিপরীতে তা এখন ১৫ শতাংশের মতো মনে করা হচ্ছে। এডিপি বাস্তবায়নে অর্থায়নের সমস্যা হচ্ছে সরকারের কর আদায় এ মাস পর্যন্ত ৬ হাজার কোটি টাকা কম। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ না পাওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে প্রাক্কলিত পরিমাণে বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্য না আসা। গত অর্থবছর প্রথম চার মাসে যেখানে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর নিট বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল, এবার সেখানে ৮৫ মিলিয়নের মতো এসেছে। একই সঙ্গে উন্নয়ন প্রশাসন স্থবির হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘে কাজ করা সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগও বাড়ছে না। গত বছরের মতোই আছে। বছর শেষে হয়তো ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আশপাশেই থাকবে। বাংলাদেশ একটি নিরাপদ বৈদেশিক বিনিয়োগস্থল হিসেবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স আয়ের ধারাবাহিকভাবে পতন ঘটছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বিদেশে মানুষ যাওয়ার পরিমাণ প্রায় ২১ শতাংশ কমে গেছে। এটা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে রপ্তানি ভালো আছে। জিএসপি বাতিল ও রানা প্লাজা বিপর্যয় সত্ত্বেও রপ্তানি ভালো আছে। কিন্তু এ ভালো যে থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। রপ্তানি যেটুকু ভালো আছে, এটুকু শুধুই তৈরি পোশাকনির্ভর। আর পোশাকশিল্প বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন। পাট, চামড়াজাত পণ্য ও হিমায়িত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এ বছর উন্নতি নেই। তার মতে, কৃষিতে এবার আমন ভালো হয়েছিল। কিন্তু পণ্য চলাচলে সমস্যা হওয়ার কারণে ধান কল ও পাইকারি পর্যায়ে পণ্য আটকে যাচ্ছে। এর ফলে পুরো সরবরাহব্যবস্থায় অসুবিধা হচ্ছে। ফলে টাকা নিচে যাচ্ছে না। পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে এবং সরবরাহ অনিশ্চিত হওয়ার জন্য পণ্য খুচরা বাজারে আসতে পারছে না। পণ্য সরবরাহ কমে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। সিপিডির সাবেক নির্বাহী পরিচালক বলেন, এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার সরকার গেলেও তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা খুবই সংকুচিত। এ সরকারের নৈতিক বৈধতা হবে খুবই সংকীর্ণ। সে ক্ষেত্রে সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও হবে বেশ কম।