দৈনিক প্রথম আলো
গত দুই দশকের ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন ও উন্নয়ন সাফল্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে। শান্তিরক্ষী বাহিনীদের অবদান এবং বিভিন্ন অনুন্নত দেশে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এসব কিছু আন্তর্জাতিক সম্পর্কে—বিশ্বশান্তি ও বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ভূমিকার স্বীকৃতি নিয়ে এসেছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নয়ন-সংযোগ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সুযোগের জন্ম দিয়েছে। সব ধরনের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান এ অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা বাড়িয়ে দিয়েছে। সমুদ্রসীমার বিরোধের আংশিক নিষ্পত্তি জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার লক্ষণ আমরা লক্ষ করছি। এসব কিছু ও অন্যান্য কারণ মিলিয়ে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি বিকাশমান ‘অকঠোর’ শক্তিতে (সফ্ট পাওয়ার) পরিণত হচ্ছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিনটি প্রভাবশালী দেশের উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সফরকে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে। জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুইয়া ওকাদা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির বিভিন্ন বক্তব্যে এই প্রস্তাবনার প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির পক্ষে কাজে লাগানোর জন্য সমস্যা কিন্তু কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে আমরা এই অর্জনগুলো ধরে সামনে অগ্রসর হতে পারব কি না?
লক্ষণীয় যে তিনটি সফরের চরিত্র ছিল তিন রকম। জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রীর এজেন্ডায় প্রাধান্য পেয়েছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়াবলি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি জোর দিয়েছেন রাজনৈতিক বিকাশ, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে। ভারতের অর্থমন্ত্রীর ‘রাবীন্দ্রিক কূটনীতি’র ভেতর নিহিত ছিল সামগ্রিক দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা।
তবে আপাত ভিন্নধর্মী এ তিনটি উচ্চপর্যায়ের সফরকে মনোযোগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা লক্ষ করব, এ তিনজন অতিথিই বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে পাঁচটি অভিন্ন বার্তা জানিয়ে গেছেন।
বিনিয়োগ ও অবকাঠামো
প্রথম বিষয় যেটি স্পষ্টভাবে এসেছে তা হলো, ভৌত অবকাঠামোর লক্ষণীয় উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় মাত্রায় বিনিয়োগ বেগবান হবে না। অথচ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারাকে তথা দারিদ্র্য বিমোচন-প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখতে হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এই বিনিয়োগ অনেকটাই আসতে হবে বৈদেশিক উৎস থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের অনুন্নত অবকাঠামো, বিশেষ করে বিদ্যুৎ, গ্যাস, যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থা, শিল্প স্থাপনে জমির নিষ্কণ্টক লভ্যতা ইত্যাদি বিষয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথে অমোচনীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব গতিরোধক দূর করার জন্য অবশ্য বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু চেষ্টা থাকলেও তা জ্বালানি ঘাটতি কমিয়ে বিনিয়োগ পরিবেশে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি আনতে পারেনি। এসব বিষয়ে বিদায়ের প্রাক্কালে জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। তাই বাংলাদেশের আগামী দিনের উন্নয়ন প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে ভৌত অবকাঠামোর ত্বরান্বিত বিকাশকে কার্যকরভাবে রূপ দিতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ
বাংলাদেশে বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ও বিভিন্ন সরকারি পরিষেবায় দুর্নীতির ব্যাপক উপস্থিতি বিদেশিদের হয়রানি ও বিপর্যস্ত করছে। দুর্নীতির মাত্রা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণে আমরা বিগত সাত-আট বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে সাহায্য লাভে ব্যর্থ হয়েছি। হিলারি ক্লিনটন এ বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পদ্মা সেতুর অর্থ সংস্থান করতে গিয়ে নতুন করে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, তা আমাদের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্কে একটি বিব্রতকর মাত্রা যোগ করেছে। জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী পরিষ্কারভাবে বলেছেন, দুর্নীতির এ অভিযোগ সম্বন্ধে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ইতিবাচক সুরাহা না হলে জাপানের অংশের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করা সম্ভব নয়। দুর্নীতি দমনে সরকারের বিঘোষিত নীতি সত্ত্বেও উন্নয়ন প্রশাসন ও সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ এসেছে বিদেশি দাতা, বিনিয়োগকারী ও কূটনৈতিকদের পক্ষ থেকে। আরও অভিযোগ হলো, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে দেশে দুর্নীতির পরিমাণ কম থাকলেও, এটা প্রতিভাত হচ্ছে যে তা এখনো বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় যায়নি। তাই সমাজের সব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি দমনের চেষ্টা আমাদের আগামী দিনে আরও জোরদার করতে হবে।
মানবাধিকার রক্ষা
দেশের ভেতরে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়টি ছিল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। বিশ্বায়নের এ যুগে দেশের মানবাধিকার-পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক সমপ্রসারণের ক্ষেত্রেও বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার, শ্রমের পরিবেশ, ন্যূনতম মজুরিসহ নাগরিকগোষ্ঠীর মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার, সুবিচার পাওয়ার অধিকার সম্পর্কিত বিষয়াবলি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্য সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রশ্নে এসব বিষয় উপস্থাপন করেছেন। তর্কের খাতিরে কেউ হয়তো আফগানিস্তান, ইরাক ও গুয়ানতানামো বেতে মানবাধিকার বিঘ্ন ঘটার উদাহরণ দিতে পারেন। কিন্তু অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিজের দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা না করার পক্ষে যুক্তি হতে পারে না।
অব্যাহত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘর্ষে লক্ষ্য নির্দিষ্ট হয়ে জীবনহানি ঘটা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ববোধ ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ইলিয়াস আলীর হারিয়ে যাওয়া ও শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেন, তখন তা এই নাজুক পরিস্থিতিকেই উৎকটভাবে প্রকাশ করে। তাই বাংলাদেশের নতুন আর্থসামাজিক ও কৌশলগত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমাদের ধ্রুপদী মানবাধিকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক অধিকার, শ্রমিকদের অধিকার, সুশীল সমাজের অধিকার রক্ষার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচন ও সংলাপ
এই সফরগুলোর ভেতর দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে যে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনসহ বাংলাদেশের বিগত দুই দশকের গণতান্ত্রিক শাসন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর যেমন রয়েছে প্রভূত প্রশংসা, তেমনি আগত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রয়েছে প্রচুর উৎকণ্ঠা। তারা মনে করেন নির্বাচন-পদ্ধতি নিয়ে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা তথা গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। তিনজন শীর্ষ অতিথি খুব পরিষ্কারভাবে সংঘাতের পথ পরিহার করে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধান রাজনৈতিক শক্তিদ্বয়কে সংলাপের তাগাদা দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের দুজন বিদগ্ধ নাগরিক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আলাপচারিতায়ও এ বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিদেশি তিনজন অতিথিই স্পষ্ট বলেছেন এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নেতাদের ও জনগণকেই উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশে উন্নয়নের যে ভিত রচিত হয়েছে, তাকে অগ্রসর করার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক শাসন অপরিহার্য।
সম্পর্কের ধারাবাহিকতা
সর্বশেষ যে বার্তাটি এসেছে তা হলো আমাদের বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। একটি প্রশ্নের উত্তরে ভারতের অর্থমন্ত্রী কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই বলেছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুটি রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে যেখানে বিদ্যমান সরকার হলো একটি মাধ্যম। তাই তিনি ইঙ্গিত করেছেন সরকার পরিবর্তন হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হওয়ার কথা নয়।
এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয়াবলি আলোচনা, পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের জন্য একটি কাঠামো প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে যৌথ কমিশন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নিয়মিত ভিত্তিতে উচ্চপর্যায়ে অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে ভবিষ্যতে পর্যালোচিত হবে নতুন সৃষ্ট কৌশলগত অংশীদারির কাঠামোর অধীনে। বাংলাদেশের ক্রমেই প্রকাশমান নতুন অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনার অর্থপূর্ণ বাস্তবায়ন অনেকখানি নির্ভর করছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থিতিশীলতার ওপর।
উল্লেখ্য, চিহ্নিত পাঁচটি বিষয়ে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ বহুদিন ধরে একই কথা বলে আসছে। এখন দেখার বিষয়, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, শক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর এই স্পষ্ট বার্তা অনুধাবন করবে কি না। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের নীতি ও আচরণকে পরিমার্জন করবেন কি না। তা না হলে যে নতুন সম্ভাবনার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সে সম্ভাবনা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে।