তৈরি পোশাক খাতের বিকাশে ‘উন্নত কাজ, উন্নত জীবন’

Originally posted in প্রথম আলো on 15 June 2024

বেটার ওয়ার্ক, বেটার লাইভস: এলিভেটিং দ্য আরএমজি ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গোলটেবিলের আয়োজন করে আইএলও এবং আইএফসির যৌথ প্রকল্প ‘বেটার ওয়ার্ক বাংলাদেশ’। ১৫ মে ২০২৪ দ্য ডেইলি স্টার ভবনে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে সহযোগিতা করে জাপান সরকারের দ্য মিনিস্ট্রি অফ ইকোনমি ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

অংশগ্রহণকারী

  • নাহিম রাজ্জাক, সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
  • মো. আব্দুর রহিম খান, মহাপরিদর্শক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)
  • টুমো পটিআইনেন, কান্ট্রি ডিরেক্টর, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)
  • আব্দুল্লাহ হিল রাকিব, ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিজিএমইএ
  • মোহাম্মদ হাতেম, নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ
  • শাকিল চৌধুরী, সেক্রেটারি জেনারেল, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন-বাংলাদেশ কাউন্সিল
  • আশরাফ আহমেদ, সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)
  • শহীদুল্লাহ বাদল, জেনারেল সেক্রেটারি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি)
  • মোহাম্মদ জাহিদুল্লাহ, চিফ সাসটেইনেবিলিটি অফিসার, দুলাল ব্রাদার্স লি (ডিবিএল)
  • লেটিশিয়া ওয়েবল রবার্টস, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, আইএলও
  • মাহ্‌ফুজ আনাম. সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

সঞ্চালনা: তানজিম ফেরদৌস, ইন-চার্জ অফ এনজিও অ্যান্ড ফরেন মিশন, দ্য ডেইলি স্টার

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

গত এক দশকে তৈরি পোশাক খাত পেশাগত ঝুঁকির বিষয়টিতে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। এটি অবশ্যই আমাদের একটি অর্জন, তবে আরও অনেক ক্ষেত্র রয়ে গেছে যেখানে উন্নতির প্রয়োজন। এলডিসি থেকে উত্তরণসহ নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের কথাও ভাবতে হবে। আগামী দশকে এ শিল্পের দক্ষতা ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রম অধিকার এবং সামাজিক ও পরিবেশগত ইস্যুগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের বিষয়টি গুরুত্বপুর্ণ হবে। এ ক্ষেত্রে ‘বেটার ওয়ার্ক বাংলাদেশ’ প্রকল্প গত এক দশকে কাক্ষিত উন্নয়ন চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রেখেছে।

বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রাম শুরু হয় ২০১৪ সালে। ওই সময় এ প্রকল্পে এমন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়, যেগুলো আগে আমাদের ভাবনায় ছিল না। আইএলও এবং আইএফসির এই যৌথ উদ্যোগের প্রথম দশক পার হয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য কেবল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি নয়, পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে পরামর্শ প্রদান, প্রশিক্ষণ প্রদান, সামাজিক পর্যায়ে আলোচনা ও অংশীজনদের অন্তর্ভুক্ত করার মতো নানা রকমের কাজ এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।

গত এক দশকে ৫০টি ব্র্যান্ডসহ ৪৭০টি পোশাক কারখানা এবং ১৩ লাখ শ্রমিককে (যা এ খাতের মোট শ্রমিকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) এ প্রকল্পের আওতায় সেবা দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য এ থেকে সুবিধাপ্রাপ্তদের ৫১ শতাংশই নারী।

বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রামের প্রভাব বুঝতে এর আওতায় থাকা কারখানাগুলোর সঙ্গে এ প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন কারখানাগুলোর তুলনা করে দেখা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়—এই প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত কারখানাগুলোর ন্যূনতম মজুরি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি, প্রতি মাসে যা গড়ে ৪৫০ টাকার সমান। এসব কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে সঞ্চয়ের হারও এ প্রোগ্রামের বাইরে থাকা শ্রমিকদের তুলনায় বেশি।

যেসব কারখানার ব্যবস্থাপনা ভালো এবং শ্রমিকরা ভালো সুবিধা পায়, সেখানে দেখা যায় তাদের কর্মপরিবেশ ও মজুরির পরিমাণ ভালো। বেটার ওয়ার্ক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট বা তাদের উচ্চমাত্রায় সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। এসব কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রাপ্তির হার ১০ শতাংশ এবং শিশুদের দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকার হার ৩০ শতাংশ বেশি।

বেটার ওয়ার্কের মূল প্রকল্পগুলোর দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে: প্রথমত, এটি সামাজিক পর্যায়ে আলোচনা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্ব দেয়। এসব আলোচনায় শ্রমিক, ব্যবস্থাপক ও সুপারভাইজারদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা হয় যে শ্রমিকদের দাবিগুলো উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্জন হলো দ্বিপক্ষীয় কমিটি ও কারখানাগুলোর নন-কমপ্লায়েন্সের হার ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।

বেটার ওয়ার্ক প্রকল্পের কারণে কমিটিগুলোতে গত পাঁচ বছরে নারী সদস্যের প্রতিনিধিত্ব প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় থাকা কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে সক্রিয় কমিটি ১৩ শতাংশ, যেখানে প্রকল্পের বাইরের কারখানার ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ।

গত প্রায় এক দশকে (২০১৪-২২) পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ইস্যুতে নন-কমপ্লায়েন্স ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। দুর্ঘটনার তথ্য জানানো ও আগুন থেকে সুরক্ষা বিষয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ বেড়েছে এবং নিরাপত্তা কমিটি ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় নন-কমপ্লায়েন্স কমেছে। এসব উন্নতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, সার্বিকভাবে নন-কমপ্লায়েন্স উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন কারখানার সঙ্গেই ব্যবসা করতে পছন্দ করে, যারা শ্রমিকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাকে গুরুত্ব দেয়। কেননা, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির পেছনে অর্থ ব্যয়কে তারা খরচ বা অপচয় নয়; বরং বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা কারখানাগুলোতে অন্য কারখানার তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি, শ্রম ব্যয় হ্রাস, নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি, চাকরিতে কর্মীদের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও পণ্যের ভালো দাম পাওয়ার মতো কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে।

বেটার ওয়ার্ক প্রকল্পের আওতায় জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি রিটার্নস প্রোগ্রামের মতো বিশেষায়িত উদ্যোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে নারীদের সুপারভাইজারের মতো পদে উন্নতি ও বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে সহযোগিতা করা হয়। এ ছাড়া ১০৩টি কারখানার ২ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিককে মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা বলয়ের আওতায় আনা

হয়েছে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও কমপ্লায়েন্সের ২ হাজার কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ব্রেস্টফিডিংয়ের সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার মাধ্যমে সদ্য মা হওয়া কর্মীদের মধ্যে অনুপস্থিতির হার কমিয়ে আনা গেছে।

এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে দায়িত্বশীলতার মধ্যে আনা হচ্ছে। এর পাশাপাশি শ্রম ও সামাজিক ইস্যুতে

উন্নত মানদণ্ড নিশ্চিত করা এবং কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়ানোও সম্ভব হচ্ছে।

টেকসই পদ্ধতির চর্চা ও দায়িত্বশীলতা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব উদ্যোগ নেওয়া কারখানাগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো দাম পাওয়ার দাবিদার। সরকার, নিয়োগদাতা ও শ্রমিকদের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তিতে নীতিমালায় সংস্কার সাধন দরকার হতে পারে।

পরিশেষে, ব্যবসা খাতে টেকসই পদ্ধতির চর্চা ও দায়িত্বশীলতা উৎসাহিত করার মাধ্যমে শ্রম ও সামাজিক ইস্যুতে উচ্চতর মানদণ্ড নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে দেশের পোশাকশিল্পকে আরও ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেটার ওয়ার্ক প্রকল্পের রয়েছে।

সুপারিশ

  • এলডিসি থেকে উত্তরণের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য আরএমজি খাতকে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং সামাজিক ও পরিবেশগত ইস্যুগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।
  • আরএমজি খাতের শ্রমিকদের একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে হবে।
  • প্রতিটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে দিতে হবে, যারা শ্রমিকদের দাবিগুলো নিয়ে কথা বলবে।
  • বেটার ওয়ার্ক প্রকল্পের সাফল্যের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যান্য কারখানায় প্রয়োগ করতে হবে। প্রকল্পের নানা উদ্যোগ ও এদের সাফল্যের তথ্য-উপাত্ত একটি তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
  • কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, শ্রমিকের সার্বিক জীবনমান ও জেন্ডারের মতো ইস্যুতে আরও কাজ করতে হবে।
  • দ্বন্দ্ব নিরসনে কারখানা পর্যায়েই আলোচনার ক্ষেত্র গড়ে তুলতে হবে।
  • শিল্প খাতে ব্যবহৃত প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে।
  • আরএমজি খাতে নারী কর্মীদের ধরে রাখতে তাদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
  • সংশ্লিষ্ট কমিটি ও অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং এসব কমিটি ও কারখানায় তদারকি পর্যায়ের দায়িত্বে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
  • বিশেষায়িত দক্ষতা গড়ে তুলতে কারখানাগুলোতে ইন্ডাস্ট্রি-বেজড ট্রেনিং (আইবিটি) সেন্টার গড়ে তোলা জরুরি।