Published in যুগান্তর on Sunday, 25 February 2018
এলডিসি উত্তরণে গুরুত্ব বাড়ছে এফটিএ’র
সম্ভাবনা ও ঝুঁকি দুই-ই আছে * সাফল্য নির্ভর করবে উদ্যোক্তার সক্ষমতা ও আলোচনায় দরকষাকষির দক্ষতার ওপর
শাহ আলম খান
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) কার্যক্রমে বাংলাদেশের পথচলা বরাবরই ধীরগতির। এ ইস্যুতে ভারত, চীন, তুরস্ক, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে। কয়েকটি দেশের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরও সংশ্লিষ্ট উদ্যোগ ফাইলবন্দি আছে। কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে দ্বিপক্ষীয় আগ্রহ ও প্রস্তাবের ভেতরেই। এক শ্রীলংকা ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এখন পর্যন্ত এফটিএর উদ্যোগে অগ্রগতি প্রায় শূন্য। সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়ার কারণে এতদিন বাংলাদেশ এফটিএ চুক্তির বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। এখন প্রেক্ষাপট বদলাতে শুরু করেছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাওয়া বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভাবনায় অনেক উদ্যোগের সঙ্গে ঘুরেফিরে সেই এফটিএ উদ্যোগ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।
২০১০ সালে প্রণীত দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নীতিমালা অনুযায়ী কোনো দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি নিরূপণের লক্ষ্যে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ভারত ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের বিষয়ে বলেছেন, দেশ দুটির সঙ্গে এফটিএর বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এ ক্ষেত্রে অধিকতর পর্যালোচনার পরই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কোনো এফটিএ সরকার করবে না। ২০১০ সালে এফটিএ বিষয়ক মূল্যায়ন কমিটি ভারত, মালয়েশিয়া এবং নেপালের সঙ্গে পৃথক এফটিএ করার সুপারিশ দিয়েছিল। কমিটির সুপারিশ ছিল কোনো দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে হলে সে দেশের পণ্য ও সেবাভিত্তিক বাণিজ্যিক খাতের অগ্রাধিকার নির্ণয় করতে হবে। যার মূল উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানির প্রবেশাধিকার বাড়িয়ে বাণিজ্য-ঘাটতি কমিয়ে আনা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো চুক্তি সই করেনি বাংলাদেশ। এদিকে দেরিতে হলেও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের আগেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা হারানোর সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার উপায় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবনা শুরু হয়ে গেছে। এর লক্ষ্যে জোর দেয়া হচ্ছে আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ওপর। আর এ ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এফটিএর ওপর। ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রফতানি শাখা, এফটিএ উইং, ডব্লিউটিও সেল, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), ফরেন ট্রেড ইন্সটিটিউট (বিএফটিএ) এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন একযোগে কাজ শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে বিশ্ববাণিজ্য ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না, বরং বাণিজ্য আরও বাড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশকে ডিউটি ফ্রি ও কোটা ফ্রি বাণিজ্য সুবিধা দিচ্ছে। এ সুবিধা যাতে ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে সে বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট দেশ ও ডব্লিউটিওর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তখন উন্নত বিশ্ব থেকে জিএসপির পরিবর্তে জিএসপি প্লাসসহ সব বাণিজ্য সুবিধা পেতে যেসব সক্ষমতা থাকা জরুরি, তা অর্জনে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) করে বাণিজ্য বৃদ্ধি করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রীলংকার সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। থাইল্যান্ডের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের ১৯৮টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৭১টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বিশাল এ ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ সইয়ের উদ্যোগ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লিখিত দেশগুলো ছাড়াও রয়েছে সিঙ্গাপুর, ফিলিস্তিন ও ভুটান। বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, এফটিএ এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে উন্নয়ন ঘটানো যায়। তবে তা কতটা টেকসই ও ফলপ্রসূ হবে নির্ভর করছে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রদানকারী সংস্থা ও কর্মকর্তাদের দরকষাকষির দক্ষতা এবং উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার ওপর। এফটিএর উদ্যোগে এর ব্যত্যয় ঘটলে বাণিজ্য উন্নয়নে সম্ভাবনার পরিবর্তে দেশীয় শিল্প নিয়ে ঝুঁকির মুখেও পড়তে হবে বাংলাদেশকে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সব দেশের সঙ্গে এফটিএ করা যাবে না। আবার যে দেশের সঙ্গে এফটিএ চুক্তি করা হবে সে দেশে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার কোন অবস্থায় রয়েছে এবং ভবিষ্যতে চাহিদা কতটা বাড়ানো যাবে তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বোপরি দেখতে হবে ওই পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কতটা সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে দ্বিপক্ষীয় দরকষাকষির দক্ষতা একটি কার্যকরী উপায় হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় দরকষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য সব পণ্যে শুল্ক সুবিধা আদায় করতে হবে। একই সঙ্গে ওই দেশের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সহনীয় শুল্ক ধার্যের অবস্থানে অনড় থাকবে হবে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে এ ধরনের দরকষাকষি বেশি সুফল দিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।