Originally posted in প্রথম আলো on 26 March 2023
প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক
‘মুক্তিযুদ্ধকে আমরা কী দিয়েছি’
অনেকের ধারণা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবধারিত একটি বিষয় ছিল। ইতিহাসে অবধারিত কিছু হয় না। স্বাধীনতা-পরবর্তী পরিস্থিতিকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা কী দিয়েছি—এই প্রশ্নের উত্তরে বলব, আমরা টেকসইভাবে একটি রাষ্ট্রকাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি। আমাদের এখানে সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় কোনো প্রতিষ্ঠানই ছিল না। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু যে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠালেন, সেটা অন্যতম স্মরণীয় একটি ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের দিকে তাকালে আমরা এর মূল্য অনুভব করব।
স্বাধীনতার পরের ৫০ বছরে আমরা একটি আর্থসামাজিক বিকাশের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। তার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য কমেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, খাদ্যনিরাপত্তা এসেছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। এগুলো রাতারাতি হয়নি, বিভিন্ন সময়ে তৈরি সোপানের মধ্য দিয়ে হয়েছে। আমরা যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করেছি, তারা জানি যে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করার আগেই বাংলাদেশে সেগুলো গৃহীত হয়েছিল। বাংলাদেশের মূল উন্নয়নের ধারার পথে একধরনের ঐকমত্য আছে। এ নিয়ে একসময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে পার্থক্য আমরা ভাবতাম, তা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে কম।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয়েছে আমাদের রাজনীতি। সে জন্য এর মধ্যকার সমস্যাগুলো রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পর্যবসিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত খাদ্যনিরাপত্তার সংকটের সময় আমরা একদলীয় ব্যবস্থায় গিয়েছিলাম। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে প্রথম ধাক্কা বাকশাল থেকে এসেছে। এর পরে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর আগমন কিংবা বিভিন্ন দল থেকে দলছুটদের নিয়ে করা দল প্রভৃতিকে রাজনৈতিক শক্তির বিকৃতি বলা যেতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে ভিন্ন দলের লোকজনের কেনাবেচাও আমরা দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক মনোভাব থাকবে না, অথচ দলগুলো প্রতিষ্ঠান ঠিক রাখবে—এটা একটা অসম্ভব বিষয়।
তাই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার বিষয়টি চলে আসে। যে দলগুলো এসবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি, তারাও আজকাল এসব আয়ত্ত করে নিচ্ছে। আগামী দিনে এরা প্রতিযোগী অবস্থানে যাবে, তেমন সুযোগ আমি দেখছি না। ২০০৬-০৭ সালে আন্দোলন করে আমরা বলেছিলাম, বাণিজ্য করতে ট্রেড লাইসেন্স লাগে, অথচ রাজনৈতিক দল করতে কোনো লাইসেন্স লাগে না। পরে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে এটি করা গেছে। দলগুলোকে এখন টাকাপয়সার হিসাব অন্তত দিতে হয়। এগুলো নাগরিক সমাজেরই অবদান।
আরেকটা বিষয় হলো বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করা। কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ার মধ্য দিয়েই শুধু নয়, মানবিক দিক থেকেও বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আমরা স্থাপন করেছি। এর বড় উদাহরণ হলো শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া।
আমি বলব, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের উদ্ভব ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। নাগরিক সমাজ ভাষা আন্দোলনে এবং ছয় দফা ও উনসত্তরের আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। ১৯৭১ সালে নাগরিক সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাণ হারিয়েছেন। স্বাধীনতার পরেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বা জাহানারা ইমামের আন্দোলনে নাগরিক সমাজ অংশ নিয়েছিল। ২০০৪ থেকে ২০০৫ সালের সৎ ও যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের কথাও স্মরণ করার মতো। বাংলাদেশের ইতিহাসে যখনই রাজনৈতিক উচ্চবর্গ আর নাগরিক সমাজের উচ্চবর্গেরা একত্রে কাজ করেছে, তখনই এ দেশে প্রগতির ধারা অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের মূলধারার নাগরিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অসাম্প্রদায়িক চেতনার এবং প্রগতিশীল শক্তি। রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে প্রগতিশীল ধারার সম্মিলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেমন এসেছে, তেমনই স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্রেও উত্তরণ ঘটেছে; পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতির ক্ষেত্রে এই দুই ধারা একসঙ্গে কাজ করেছে।
সমস্যাটা হয়েছে অন্যত্র। আমরা দুই ধরনের রাজনৈতিক উচ্চবর্গীয় শ্রেণি দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, ক্ষমতায়িত রাজনৈতিক উচ্চবর্গীয় শ্রেণি; দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক উচ্চবর্গীয় শ্রেণি। ক্ষমতার বাইরে থাকলে রাজনৈতিক উচ্চবর্গীয়রা নাগরিক সমাজকে তার সহায়ক মনে করেছে, কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে মনে করছে প্রতিপক্ষ। এই দুর্বলতা থেকেই সহায়ক শক্তিকে তারা প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। তার ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে সহায়ক শক্তিকে সে প্রতিপক্ষ বানাত না।
এখন তো আবার বিকল্প নাগরিক সমাজও আছে। হেফাজতে ইসলামের মতো গোষ্ঠীকে আমি বিকল্প নাগরিক সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করি। মূলধারার নাগরিক সমাজ প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের মূল্যবোধ লালন করে। সংখ্যার দিক থেকে ভাবলে কিন্তু বিষয়টি ভিন্ন। একদিকে সংখ্যার প্রভাব, আরেক দিকে নৈতিক প্রভাব। নাগরিক সমাজের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে প্রগতিশীল উচ্চবর্গীয়দের দ্বন্দ্ব নিরসন করা না গেলে নতুন কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়া হবে না। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে। সেটা একটা বাজে নির্বাচন ছিল, তবে তাতেও একধরনের সমঝোতা ছিল। তথাকথিত এক–এগারোর ঘটনায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক উচ্চবর্গীয়দের সঙ্গে নাগরিক সমাজের সমঝোতা হয়নি। এ কারণে একধরনের রাজনৈতিক বিকৃতি ঘটেছে।
আমরা মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান দিয়েছি, কিন্তু এর দায় শোধ করিনি। এ প্রসঙ্গে আমি তিনটি বিষয় নিয়ে বলব। প্রথমত, ইতিহাস। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো হীন উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত ও বিতর্কিত করেছে। আমরা বিভিন্ন লোকের অবদান অস্বীকার করি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জাতীয় মতৈক্য থাকা উচিত। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা বৈষম্য দূর করা, যা হয়নি। আয়, ভোগ, সম্পদ, নিরাপত্তার অধিকার—এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। তৃতীয়ত, গণতন্ত্রের দুর্বলতা। নাগরিকেরা যদি ভোট দিয়ে নিজেদের ক্ষমতায় নিজেদের পছন্দের প্রার্থী বসাতে না পারে, তা হলে তো কিছুই হলো না। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা তো গণতন্ত্রের চেতনা। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান দিচ্ছি, অথচ দায় শোধ করছি না। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে।
– ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি