Published in প্রথম আলো on Tuesday, 3 January 2017
তেজি ডলারে অর্থ পাচারের শঙ্কা বাড়ছে
বদরুল আলম
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ১ ডলার কিনতে খরচ হতো ৭৭ টাকা ৯৫ পয়সা। ২০১৫ সালেও একই মূল্যে ডলার কেনা যেত। কিন্তু ২০১৬ সালে ডলারের মূল্য বেড়ে হয় ৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এখন তা আরো বেড়ে হয়েছে ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই শক্তিশালী হয়েছে ডলার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর মুদ্রাটি আরো শক্তিশালী হবে। ডলারের এ তেজি ভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থ পাচারের প্রবণতা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা অর্থনীতি বিশ্লেষকদের। দেশে আমানতের নিম্নসুদ অর্থ পাচারের প্রবণতা আরো বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন তারা।
সম্প্রতি খোলাবাজারেও আগের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এক মাস আগেও ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের মূল্যে পার্থক্য ছিল ২-৩ টাকা। নগদ ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে খোলাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৩-৮৫ টাকায়।
ট্রাম্প সরকারের নীতির কারণে শক্তিশালী ডলার আগামীতে আরো তেজি হবে বলে মনে করেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশীয় (মার্কিন) শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছেন ট্রাম্প। এর প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারেও। দেশটির পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা লগ্নি অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারেন। এর মাধ্যমে মার্কিন বাজারে ডলারের সহজলভ্যতা হ্রাস পেতে পারে। এসবের প্রভাবে ডলার আরো শক্তিশালী হবে।
ডলার শক্তিশালী হওয়ায় এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাবই দেশের অর্থনীতিতে পড়বে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ডলার শক্তিশালী হলে স্বাভাবিকভাবেই রফতানিতে সুবিধা পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে বৈধ পন্থায় দেশের বাইরে ডলার রাখার পাশাপাশি অবৈধ পন্থায় পাঠানোর প্রবণতাও আরো বাড়বে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বাইরে অর্থ পাচারের বিষয়টি বাস্তবায়ন হয় মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। ডলার শক্তিশালী হওয়ায় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে আমদানিকারকদের মধ্যে এ প্রবণতা বাড়তে পারে। এটা বেশি দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকারকদের মধ্যে। তবে রফতানিমুখী শিল্পেও অনেক পণ্য আমদানি হয়। অর্থ স্থানান্তর করেন যার যার সুবিধা অনুযায়ী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও বলছে, ভোগ্য ও অন্তর্বর্তী পণ্য (অয়েল সিডস, প্লাস্টিক ও রাবার, কেমিক্যালস প্রভৃতি) আমদানি ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে আমদানি ব্যয় ছিল ২ হাজার ৩৪৮ কোটি ডলার। পরের অর্থবছর এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪২৪ কোটি ডলারে। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এ খাতে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৫৭৮ কোটি ডলার।
আমদানি-রফতানিতে মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায়ও। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মিস ইনভয়েসিং বা অস্বচ্ছ লেনদেনের মাধ্যমে পাচার হয়েছে ৮০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর মধ্যে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হয়েছে ১৪৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হয়েছে ৬৮৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
জিএফআইয়ের হিসাবে, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে পাচার হওয়া মোট অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ডলার। ২০১০ সালে পাচার হয় ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এছাড়া ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ও ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ডলার অবৈধ পন্থায় দেশের বাইরে চলে গেছে।
ডলার শক্তিশালী হওয়ায় বিনিয়োগের জন্য দেশের বাইরে অর্থ সরিয়ে নেয়ার আশঙ্কাও করছেন অনেকে। বিনিয়োগের জন্য দেশ থেকে পুঁজি স্থানান্তরে নিয়মনীতির জটিলতা একে আরো উত্সাহিত করতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
ডলার শক্তিশালী হওয়ার বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি স্বীকার করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনও। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে কোনো আইনের মাধ্যমেই অর্থ পাচার রোধের উপায় নেই। অর্থ বিনিয়োগের জন্য। আর দেশে যদি বিনিয়োগের পরিবেশ থাকে, তাহলে ডলার বাইরে রেখে ব্যবসায়ীরা কী করবেন? এছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যেতে পারেন না, বড়রাই পারেন। এখন বাংলাদেশের অনেক বড় ব্যবসায়ী দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে চাইছেন। আমি মনে করি, অর্থ পাচার রোধে আইনি পন্থায় দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
দেশের বাইরে অর্থ স্থানান্তরের অবৈধ পন্থাগুলো আসলে কী, তা শনাক্ত করে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার আরো সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্ত। তিনি বলেন, বৈধ উপায়ে দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সীমারেখা দেয়া আছে। আর সেসব পন্থায় দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুব বেশি নয়। যেমন ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হতে পারে। সেটা ডলার শক্তিশালী হলেও সম্ভব, না হলেও সম্ভব। তবে ডলার শক্তিশালী হওয়ার পূর্বাভাসের ফলে অনেকে ডলারের স্পেকুলেটিভ হোল্ডিং করতে পারেন। এটা সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়।