Originally posted in বণিকবার্তা on 4 January 2024
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে নজর দিলে আমরা বিভিন্ন খাতে বেশ অর্জন এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখতে পাই। জীবনযাত্রার মান, গড় আয়ুষ্কাল, মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আর্থসামাজিক যে সূচকগুলো রয়েছে সব ক্ষেত্রেই আমাদের উন্নতি হয়েছে বলে মনে করি। পরবর্তী প্রজন্ম আগের প্রজন্ম থেকে ভালো থেকেছে। তার ধারাবাহিকতায় আমি আশা করি, ২০২৪ সালে আমরা পেছনের সেই অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাব। পাশাপাশি এ কথা স্বীকার করতে হবে, আমরা ২০২৪-এ প্রবেশ করছি এমন একটি বছর থেকে যে বছরে আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমনি আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি তেমনি সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রেও আমরা সমান ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছি। সুতরাং এসব ঝুঁকির বিষয় আমলে নিয়ে আমাদের নতুন বছরে পা রাখতে হবে। এসব ঝুঁকি যে শুধু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনার জন্য সৃষ্টি হয়েছে তা নয়, এখানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনারও ভূমিকা রয়েছে। যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনাও এসব ঝুঁকি সৃষ্টির জন্য দায়ী। ২০২৪ সালের দিকে তাকিয়ে সেই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার প্রত্যাশা করি। আবার আমাদের যে অর্জন হয়েছে তার শক্তিমত্তার ওপর দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে হবে। এ দুই ধরনের প্রত্যাশা নিয়েই আমি নতুন বছরকে দেখছি।
২০২৩ সাল জুড়েই উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগেছে সর্বস্তরের মানুষ। বিশেষ করে যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন হয়েছে। এছাড়া নিম্ন মধ্যবিত্তদের ওপরও মূল্যস্ফীতির একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, এ বছর আমাদের প্রথম কাজ হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রমবাজারে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। নতুন বছরে বিনিয়োগ চাঙ্গা না হলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত যেসব বিষয় রয়েছে সেসব দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।
পাশাপাশি সুদহার নীতিতেও পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুদহার নীতি প্রণয়ন করতে হবে। অন্যদিকে সঞ্চয়কারীদেরও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। এক্ষেত্রে বাজারের সঙ্গে যদি সমন্বয় করে আমাদের সুদহার নীতি গ্রহণ করা হয় তাহলে সঞ্চয়কারীর সংখ্যা বাড়বে। এছাড়া আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে বিনিময় হার রয়েছে সেটাকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের হার অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালু রাখতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে বাজারে মুনাফালোভীদের একচেটিয়া যে আধিপত্য বিগত সালগুলোয় আমরা লক্ষ করেছি সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
২০২৪ সালে আমাদের পদক্ষেপের ফলাফল নির্ভর করবে আমরা বাড়তি যেসব পদক্ষেপ নেব তার ওপর। এক্ষেত্রে আমরা যদি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো করতে পারি তাহলে আমাদের এ বছরটা গত বছরের তুলনায় ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে বলে আমার ধারণা। অন্যদিকে আমরা যদি শুধু গড়পড়তা পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করি তাহলে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা ভালো হবে বলে আমি মনে করি না।
এছাড়া ঋণখেলাপি বা করখেলাপি ছাড়াও আমাদের যেসব বিষয়ে এ বছর বাড়তি নজর দিতে হবে তা হচ্ছে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জোর দেয়া। অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। এসব জায়গায় বহু বছর ধরেই দুর্বলতা রয়েছে যার প্রভাব কিন্তু আমাদের অর্থনীতির জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। শুধু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে সেজন্য আমরা কাজ করব বিষয়টি যেন এমন না হয়, আমাদের নিজস্ব গরজেও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া প্রকৃত অর্থে আমাদের বিভিন্ন সংকট মোকাবেলায় আমরা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারব না। সুতরাং আমাদের নিজস্ব তাগিদ থেকেই এসব সংস্কার আমাদের করতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে যেসব আইনের কথা বলা হয়েছে আমরা যেন সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি সেদিকটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। খেলাপি ঋণের ফলে সরকার যে বোঝা বহন করছে সে বিষয়েও সতর্ক হতে হবে। কারণ সরকারের হাতে অর্থ না থাকলে তারা ব্যয় কীভাবে করবে? সরকারের হাতে ব্যয়ের জন্য যখন প্রয়োজনীয় অর্থ থাকবে কেবল তখনই ব্যয়ের প্রশ্ন যুক্তিযুক্ত। সরকার এ বছর এসব বিষয়ে খেয়াল রেখে নতুন নতুন পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় কাজ করবে বলে আমি মনে করি।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বৈদেশিক বিনিয়োগের বিকল্প নেই। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা রয়েছে সেসব দেশেও কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগ রয়েছে অনেক। এসব দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৫-২০) আমাদের আশা ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আমরা পাব, কিন্তু সেখানে আমরা পেয়েছি ১০ বিলিয়ন ডলারেরও কম। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে তুলনা করলে ১ শতাংশেরও কম। আর বিনিয়োগ যেটা আমরা পাচ্ছি সেটা হচ্ছে আগের লভ্যাংশের বিনিয়োগ। তবে নতুন যে বিনিয়োগ প্রয়োজন সেটা আমরা পাচ্ছি না।
সেক্ষেত্রে দেশে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, আমাদের যে কাজ করতে হবে সেটি হচ্ছে, দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। হাল আমলে এক ধরনের যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে সেটি কাটিয়ে উঠতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ডলার এক্সচেঞ্জ খাত ও সুদহার নীতিতে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। এ অবস্থায় বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা আমাদের জন্য দুষ্কর হবে। অন্যদিকে আমাদের ইতিবাচক যে দিকগুলো রয়েছে সেক্ষেত্রেও কাজ করতে হবে। আমাদের যেসব নন-স্টপ সেবা রয়েছে সেগুলো শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে যদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে আমরা বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হব।
এক্ষেত্রে স্মর্তব্য গত বছর আমদানিতে যে সংকোচন নীতি নেয়া হয়েছে তাতে সার্বিক অর্থনীতিতে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে আমি মনে করি। উচ্চ মূল্যসম্পন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি সংকোচন নীতি এক রকম প্রভাব ফেলে, অন্যদিকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য-পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সংকোচন নীতি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়। রিজার্ভ সীমিত থাকার ফলে আমরা আমদানি সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছি, ফলে আমাদের অর্থনীতিতে দুই ধরনের নেতিবাচক প্রভাব আমরা লক্ষ করেছি। প্রথমত, আমরা অনেক প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছি না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক যে মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করছে ব্যবসায়ীদের তার চেয়েও বেশি মূল্যে মুদ্রা ক্রয় করতে হচ্ছে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়ছে এবং তাকে পণ্যটি অধিক দামে বাজারে ছাড়তে হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। এছাড়া আমাদের বাজারে আমদানি সংকোচন নীতির ফলে একটি দুষ্ট চক্র সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে কিছুটা হলেও আমাদের সংকট উত্তরণের পথ সুগম হবে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে বাজারের সমন্বহীনতা দূর করতে পারলে আমদানির জটিলতা কিছুটা কমবে। এছাড়া যারা দেশের টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করছে তাদের ক্ষেত্রে যদি কঠোর নীতি নেয়া যায় তাহলেও আমাদের বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অর্থনীতিবিদ ও সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
শ্রুতলিখন: আব্দুল কাইয়ুম