Originally posted in The Business Standard on 2 December 2024
আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানোয় গুরুত্ব দেবে সরকার
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট বর্তমান বাজেটের তুলনায় অনেক কম রাখা হবে। কারণ সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন বাজেট ছোট করার পরিবর্তে শুরুতেই ছোট করে ধরে বাস্তবায়ন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য একটি কঠোর বাজেট প্রণয়ন করতে চায়। বিনিয়োগ বাড়াতে এ বাজেটে উন্নয়ন ও রাজস্ব ব্যয়ে উল্লেখযোগ্য কাটছাঁট করার পরিকল্পনা রয়েছে।
নতুন বাজেট দর্শনের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি–কেন্দ্রিক গতানুগতিক উন্নয়ন মডেল থেকে সরে এসে সামাজিক অগ্রগতির দিকে মনোনিবেশ করা হতে পারে। এজন্য আয়বর্ধক উদ্যোগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাড়তি তহবিলের দরকার হবে।
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল প্রায় দুই লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে। আগামী অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির সমান বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
২০২৪–২৫ অর্থবছর বাজেটে ৬.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হবে না। পাশাপাশি এ অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কেই থাকার ধারণা করছেন তারা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বৈশ্বিক ঋণদাতাদের দেওয়া কম প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন। তবে তারা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, সরকারি ব্যয়ে অতিরিক্ত কাটছাঁট অর্থনৈতিক মন্দা আরও তীব্র করতে পারে।
আগামী ২ ডিসেম্বর আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ডেকেছে অর্থ বিভাগ। সেখানে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং আগামী অর্থবছরের বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হবে।
সভায় চলতি ও আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার, মূল্যস্ফীতির হার, কর-জিডিপি অনুপাত, ব্যয়-জিডিপি অনুপাত এবং বহিঃবাণিজ্যের সঙ্গে লেনদেনের ভারসাম্যের প্রাক্কলন করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘বাস্তবতার নিরীখে অর্থনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা জরুরি।’ তিনি উল্লেখ করেন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য ৪–৪.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।
সিপিডি’র (সেন্টার পর পলিসি ডায়লগ) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার ইতোমধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা উন্নয়ন ব্যয় কমাবে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যয় হ্রাসের যুগপৎ চাপ অর্থনীতিতে স্থবিরতা সৃষ্টি করতে পারে।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বাজেটে নির্ধারিত মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা নেই। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে রয়েছে। সরকারের ধারণা, এ অর্থবছরও শেষ হবে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি নিয়ে।
অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৮৭ শতাংশে, যা গত কয়েক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৬৬ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়ালেও মূল্যস্ফীতিতে রাশ টানা সম্ভব হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। সেজন্য পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো, উৎপাদন ও আমদানি সহজ করা এবং কৃষি ও শিল্প খাতে প্রণোদনার উদ্যোগ থাকবে বাজেটে।
পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি ও তার বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা থাকবে। এছাড়া মানুষের আয়বর্ধক কাজে গুরুত্ব দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ বরাদ্দও থাকবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বেশ কঠিন কাজ। ‘মূল্যস্ফীতি ৯.৫ শতাংশ বা ৯ শতাংশের নিচে ধরা হলে সেটি বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে যাবে। তবে মূল্যস্ফীতি পরের বছরে কমে আসতে পারে।’
তিনি বলেন, সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি এবং স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তবে বাজারের কুশীলবেরা অনেক সময় এ সুবিধাগুলো ভোগ করে, সাধারণ জনগণ সুফল পান না।
‘যদিও ভালো খবর হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেই যে বাংলাদেশের বাজারে সবসময় কমে, তা নয়,’ তিনি বলেন।
এ অর্থনীতিবিদ বাজেটের আকার কমানোর এবং ঘাটতি কমানোর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন, কারণ এগুলো করতে ব্যর্থ হলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না।
উন্নয়ন বাজেট কমানোর উদ্যোগ
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট বর্তমান বাজেটের তুলনায় অনেক কম রাখা হবে। কারণ সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন বাজেট ছোট করার পরিবর্তে শুরুতেই ছোট করে ধরে বাস্তবায়ন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ৭.৯ শতাংশ, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এবার নতুন করে কোনো মেগা প্রকল্প নেওয়া হবে না। তবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো খাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে সূত্র।
সূত্র আরও জানায়, চলতি বাজেটে যেসব প্রকল্পের তহবিল নেই বা ন্যূনতম বরাদ্দ রয়েছে, সেগুলো পরবর্তী বাজেট থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে। বিশেষত সংসদ সদস্যদের অভিপ্রায় অনুযায়ী এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাদ দেওয়া হবে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা।
ড. ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ এখনো তীব্র। সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কার্যকর হয়নি। ‘ফিসক্যাল পলিসিকে অবশ্যই সম্প্রসারণমূলক হওয়া এড়াতে হবে। তবে এর ফলে এডিপি বাস্তবায়ন আরও ধীরগতির হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল করা যেতে পারে, তবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে অগ্রাধিকারগুলোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে। একই সঙ্গে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানো প্রয়োজন।’
ড. ফাহমিদা আরও বলেন, ‘টিসিবি এবং ওএমএস ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ লাইন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রমবর্ধমান দুর্দশার প্রতিফলন। এ ধরনের কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়ানো এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় নতুন পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।’
তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বাজেট বড় পরিসরে কমিয়ে দিলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হতে পারে। ‘সরকারের উচিত বিদেশি অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার এমন প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা করছে, যা উদ্ভাবন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়ক এবং দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। এজন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে এ ধরনের প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট ঘাটতিকে ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে না নিয়ে গিয়ে এডিপি ব্যয় নির্ধারণ করা উচিত।
কর-বহির্ভূত রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ
জুলাই–আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বেশ কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঠিকাদার তাদের প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখে অনুপস্থিত থাকে। এতে উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে দাঁড়ানোর পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ও নিম্নমুখী হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব সংগ্রহ ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা কম। যদিও এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও এনবিআর কর্মকর্তারা উল্লেখযোগ্য ঘাটতির আশঙ্কা করছেন।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। বরং জ্বালানি তেলের দাম যতটা কমানো সম্ভব, তারই চেষ্টা করা হবে। তবে কর-বহির্ভূত রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, চার লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এনবিআরের জন্য অবাস্তব।
আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ
এদিকে, বিগত সরকার পতনের পর অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষত বেরিয়ে আসছে। বিশেষত, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। অনেক ব্যাংক পড়েছে তারল্য সংকটে। সাবেক সরকার অর্থনীতির একাধিক সূচক কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানোর ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যায়নি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। তবে উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিশৃঙ্খলার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আসন্ন বাজেটে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিশেষত ব্যাংক খাতের জন্য কিছু নীতি-উদ্যোগ থাকতে পারে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। সরকার বাজার থেকে টাকা তোলা, অর্থাৎ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার নেওয়া কমাবে।
পাশাপাশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে কিছু নীতি-সুবিধা দেওয়ার কথাও ভাবছে সরকার। ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০ বছরের জন্য ১০০ শতাংশ কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। একই ধরনের নীতি-সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রণয়ন করা হবে বলে ওই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।