Published in শেয়ারবিজ on Friday, 13 April 2018
বড় ঋণখেলাপিদের লেনদেন খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বিদেশে অর্থ পাচার
শেখ আবু তালেব ও মেহেদী হাসান
দেশে হঠাৎ করে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংকট ঘনীভূত হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ অবস্থায় মূলধনী যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য ও তুলা আমদানির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি বড় ধরনের খেলাপিরা বিদেশে অর্থপাচার করছে কিনা সে বিষয়টিও নজরদারি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ট্রাস্কফোর্সের এক বৈঠকে এ বিষয়টি বিষদ আলোচনা হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনি বছরে দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে অর্থ পাচারের বিষয়টি উঠে আসে। অর্থ পাচারের পাশাপাশি সেখানে বড় অংকের খেলাপি ঋণের বিষয়ে আলোচনা হয়। আর এ নিয়ে বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনাÑতা খতিয়ে দেখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বিশেষ করে ভারি শিল্পের জন্য নেওয়া ঋণসংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়।
একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে বিনিয়োগে গতি না থাকলেও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ সন্দেহজনক। বেড়ে গেছে চাল আমদানির পরিমাণ। শুধু চালই নয়, অনেক ভোগ্যপণ্যের আমদানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। এটাই ভাবিয়ে তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজি হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কিছু ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে। সব ব্যাংকে নয়। নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আরও সচেতন হবে। অর্থ পাচার রোধে আমরা বর্তমান কৌশলের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু কৌশল নির্ধারণ করছি। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের উঠা-নামার বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও সজাগ থাকবে।’
সূত্রমতে, নির্বাচনি বছরে সাধারণত সংকোচন ও সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ করেই টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে দিতে নীতিমালা পরিবর্তন করেছে। এর একটি অংশ পাচার হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনের বছরে রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশ থেকে বাড়ে অর্থ পাচার। গত দুইবার জাতীয় নির্বাচনের আগেই এ চিত্র ছিল বলে উঠে এসেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে।
চলতি বছর শেষদিকে আবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে আমদানিতে সম্প্রতি উল্লম্ফন হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। অথচ আমদানির বিপরীতে রফতানি সেভাবে বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে আমদানির বিপরীতে নির্দিষ্ট পণ্য দেশেই আসেনি।
এতে আবারও প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচনের বছরে দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে কিনা? আর এ বিষয়টি নিয়ে এবার সতর্ক অবস্থান নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থ পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে কাজও শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে ব্যাংক খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এমন চিত্রকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশ্লেষকরা বলছেন। যদিও এসব খেলাপির অনেকেই ইচ্ছাকৃত। ফলে অর্থ পাচারের সঙ্গে দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সে তথ্য যাচাই করে দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৭৫১ কোটি ৫০ লাখ ডলার অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। এ ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০১৩ সালে নির্বাচনের বছরটিতে। সে বছর এক হাজার চার কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচার হয়। এর আগে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকালীন বছর ২০০৮ সালে। সে বছর পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৭২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে সাত লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত এক বছরে দেশের ব্যাংক খাতে নতুন করে ১২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ যুক্ত হয়েছে। খেলাপি হয়ে যাওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ। অবলোপনকৃত এ ঋণ যোগ করলে ২০১৭ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এত ঋণ তাহলে যাচ্ছে কোথায়? তাদের মতে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি পাচার হয়ে যাচ্ছে অর্থ। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
এ বিষয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, নির্বাচনী বছরে যে অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় তা আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো নিয়মিত প্রকাশ করছে। গত বছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) পরিসংখ্যানে সিপিডি দেখতে পেয়েছে, পোশাকের কাঁচামাল তুলা আমদানিতে ৭৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অথচ এ সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে মাত্র সাত শতাংশ। এক্ষেত্রে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, টাকা পাচারের সবচেয়ে ভালো ও সহজ মাধ্যম হলো মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। এর মাধ্যমে সহজেই মুদ্রা পাচার করা যায়। বড় আকারে যারা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করেছেন, তা বাংলাদেশে এসেছে কিনা, বা আসলেও কোথায় আছে তা যাচাই করলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করেন না। যারা পাচার করেন, তাদের পরিচয় ও প্রভাব অনেক বেশি।
এদিকে চলতি অর্থবছর এরই মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ মোট তিন হাজার ১১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। এ সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে দুই হাজার ১০৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ হিসেবে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে যা ৫২৮ কোটি ২০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশে ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের চেয়ে ২০১৭ সালের অক্টোবরে ব্যাংক খাতে বিনিয়োগ কমেছে ৫.৮৪ শতাংশ। এক বছরে বিনিয়োগ কমেছে দুই লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। ব্যাংকাররা বলছেন, এ সময়ে মূলত নতুন বিনিয়োগ কম হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চলতি মূলধনই বেশি নিয়েছে। পরের বছর গত মুদ্রানীতিতে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৭) বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১৬ শতাংশ। কিন্তু ডিসেম্বর মাস শেষে তা ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের পুঞ্জীভূত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। হঠাৎ করেই সেপ্টেম্বর মাস শেষে তা বেড়ে হয়েছে আট লাখ এক হাজার কোটি টাকা। বছরের শেষ সময়ে মাত্র তিন মাসে বেসরকারি খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ওই সময়ে শুধু মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয় ১০ হাজার কোটি টাকা। যা গত কয়েক বছরের মধ্যে অস্বাভাবিক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত নির্বাচনি বছরে দেশে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্পের সম্প্রসারণ হয় না। অর্থনীতির আকারও ছোট হয়ে আসে। নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, এ আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে যান না। কিন্তু এবারে দেখা গিয়েছে ব্যতিক্রম।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচনের বছর টাকা পাচার হওয়ার শঙ্কা তো রয়েছেই। পাশাপাশি এ সময়ে অযোগ্য ও অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ দেওয়া হচ্ছে কিনা ব্যাংকারদের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককেও গভীর নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। পাচারের সঙ্গে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে পাচারকারীরা নিরুৎসাহিত হবে বলে মনে করেন তিনি।