Originally posted in Bonik Barta on 5 April 2023
ঝুঁকি থেকে বের হয়নি বাংলাদেশের অর্থনীতি
মূল্যস্ফীতির হার গত মাসেও ছিল ৯ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চলতি হিসাবের ঘাটতি। শঙ্কা কাটেনি রিজার্ভ নিয়েও। বরং সামনের দিনগুলোয় আরো অনিশ্চয়তার ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণেও ঠিক এ কথাই উঠে এসেছে। সংস্থাটি মনে করছে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের চাপ আগামীতেও থেকে যেতে পারে। এর ধারাবাহিকতায় বাড়তে পারে টাকার অবমূল্যায়ন, যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে ঠেলে দেবে আরো বড় অনিশ্চয়তার মুখে।
সংস্থাটির ভাষ্য হলো মহামারীর অভিঘাত পার করে বেশ নির্বিঘ্নেই পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু অর্থনীতির বহিস্থ প্রভাবকগুলোর ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলায় নেয়া পদক্ষেপগুলো ছিল অপর্যাপ্ত। দেশে এখন ব্যবসায়িক অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ও সুদহার পরিস্থিতি। আর্থিক খাতকে দায়গ্রস্ত করছে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধনের অপর্যাপ্ততায় ভুগছে আর্থিক খাত। সব মিলিয়ে এখন টেকসই অর্থনীতির বেশকিছু ঝুঁকির মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচনের আগে ব্যয় বাড়লে বা নীতিগত সংস্কারগুলো পিছিয়ে দেয়া হলে ভবিষ্যতে বাজেট ঘাটতির মাত্রাও অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে।
‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের এ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সংস্থাটির কার্যালয়ে গতকালই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশকালে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের চিফ অর্থনীতিবিদ বার্নাড হ্যাভেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সাবেক লিড অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এতে স্বল্পমেয়াদে কিছু সুফল পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তা কোনো কাজে আসবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পরিসংখ্যানের সূত্র ধরে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০২০-২১ অর্থবছরেও দেশে ব্যালান্স অব পেমেন্টের উদ্বৃত্ত ছিল ৯৩০ কোটি ডলার। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে আমদানির মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। রফতানিতে চাহিদা বাড়ায় মাধ্যমিক পণ্যের (ইন্টারমিডিয়ারি গুডস) আমদানি বাড়িয়েছিলেন শিল্পোদ্যোক্তারা। আবার তাদের উৎপাদন ব্যয়কে বাড়িয়ে তোলে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে। বেড়ে যায় সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতিও। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৩০ কোটি ডলারে।
এমন পরিস্থিতিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চলতি হিসাবের ঘাটতি সংকোচনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় এলসি খোলার মাত্রা কমে। এর সঙ্গে আবার রফতানির প্রবৃদ্ধিও বজায় থাকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ। একই সময়ের আবার দেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি নেমে আসে ৫০০ কোটি ডলারের ঘরে। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল হাজার কোটি ডলারের বেশি। গত অর্থবছরে দেশে চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল জিডিপির ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে তা ২ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
চলতি হিসাবের ঘাটতি কমলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি বেড়েছে। আমদানি কমার পাশাপাশি বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতার মধ্যে বাণিজ্য ঋণের প্রবাহও হ্রাস পেয়েছে। একই সময় সুদহার বাড়িয়ে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণও কমে গেছে। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪০ কোটি ডলারে। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় এর পরিমাণ ছিল ২১০ কোটি ডলার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিঃসন্দেহে সংকটে না হোক একটা বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে রয়েছে। সরকারের আয়-ব্যয় ও ঘাটতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য এবং চলতি, বাণিজ্য ও সামগ্রিক—সব হিসাবেই সমস্যা রয়েছে। সময়মতো মোকাবেলা করা না গেলে এ দুই ধরনের সমস্যা বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আমদানি ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে সাময়িক কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স বাড়ায় কিছুটা স্বস্তি আসবে। কিন্তু আমাদের যে মৌলিক সমস্যা ছিল সেগুলো তো দূর হয়নি। এজন্য যে ধরনের সংস্কার করা দরকার ছিল, সেটা করা হচ্ছে না। এমনটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে অঙ্গীকার করেও সরকার পুরোটা করছে না। এর একটি হলো সুদহারকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা এবং টাকার বিনিময় হারকে শিথিল করা। ব্যাংক খাতের সংস্কারের মতো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার এটি সত্য। কিন্তু যে ধরনের দ্রুততার সঙ্গে ও গভীরভাবে এসব সংস্কার করার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না। সমস্যা মোকাবেলার জন্য সরকার যে ধরনের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেনি। ফলে ঝুঁকিগুলো রয়ে গেছে। সরকারের এ মুহূর্তে টাকার অভাব রয়েছে। ব্যাংক খাতে তারল্য ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি টাকা সরবরাহ করে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। এ ঝুঁকি কিন্তু ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সমস্যা হচ্ছে এগুলো মোকাবেলায় সরকার যেভাবে সংকোচ নিয়ে এগোচ্ছে তাতে ঝুঁকি আরো বাড়ছে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় যা করছে, তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। নীতি সংস্কারের দুর্বলতার পাশাপাশি নীতি সমন্বয়হীনতাও আমাদের আরো একটি বড় সমস্যা।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের ভেতরে অর্থনীতি বিভিন্ন ধরনের চাপের মধ্যে ছিল। আমরা একটা প্রবৃদ্ধির গল্প রচনা করেছিলাম। কাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়গুলো আমরা স্বীকার করতে চাইনি। এর ফলেই আজকে এ পরিস্থিতি হয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতি বাড়ায় চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশে আটকে থাকতে পারে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রকৃত মজুরি ও সঞ্চয় কমায় ভোক্তাব্যয় শ্লথ হয়ে আসতে পারে। বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে চাহিদা পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা, বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনীতির অনিশ্চয়তা এবং মূলধনি পণ্যের বর্ধিত দাম। আবার টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং কিছু ভোক্তাপণ্যের ওপর আমদানিতে শুল্কবৃদ্ধি সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির আশঙ্কাকেও বাড়িয়ে তুলেছে। উচ্চমূল্যস্ফীতি একই সঙ্গে এখন দারিদ্র্য বিমোচনকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। আবার দেশের রফতানি আয়কে চাপে ফেলতে পারে বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি।
বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক বিনিময় হার থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সংস্থাটির ভাষ্য হলো দেশে এখন ডলারের একাধিক বিনিময় হারের জটিল এক পদ্ধতি চালু রয়েছে। এর কারণে রফতানি ও রেমিট্যান্স আয় নিরুৎসাহিত হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ন্ত্রণে ২০২১ সালের জুন থেকে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভের ক্রমাগত পতনের মুখে গত পঞ্জিকাবর্ষের জুনের শুরুর দিকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়নের গতি বেড়ে যাওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই ফ্লোটিং বা বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের পথ থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগস্টের মধ্যেই ডলারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময় হার ৯৫ টাকায় ধরে রাখলেও কার্ব মার্কেটে তা ১২০ টাকায় উঠে যায়। তবে এক পর্যায়ে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বিনিময় হার এক প্রকার অকার্যকর হয়ে পড়ে। কারণ বিক্রেতারা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত হারে ডলার বিক্রি করতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন না। সেপ্টেম্বরের দিকে একাধিক বিনিময় হারের এক জটিল পদ্ধতি চালু করা হয়। এক্ষেত্রে রফতানিকারক, আমদানিকারক ও আন্তঃব্যাংক লেনদেনের জন্য ডলারের ভিন্ন বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়।
একাধিক বিনিময় হারের এ পদ্ধতি এখন ব্যালান্স অব পেমেন্টে চাপ সৃষ্টি করছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। এ বিষয়ে সংস্থাটির ভাষ্য হলো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণ করায় দেশে এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। আবার রফতানিকারকদের আয় নির্ধারণ হচ্ছে বাজারের চেয়ে কম বিনিময় হারের ভিত্তিতে। ফলে তারাও এখন এ আয় দেশে আনার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী না। আবার আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং করেও অনেকে প্রণোদনা পাচ্ছেন বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সংস্থাটি বলছে, বর্তমান বাস্তবতায় বাণিজ্য সংস্কারের দিকে এগোতে হবে সরকারকে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বাণিজ্য খাতে সংস্কার প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। কারণ, চাহিদা ও জোগান দুদিক থেকেই সমস্যা রয়েছে। জোগানের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জোগানের ক্ষেত্রে আর্থিক নীতিমালা বাজেট ঘাটতি কমাতে কোনো কাজে লাগছে না।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক অর্থনীতির তিনটি দিক প্রাসঙ্গিক। একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার কোন দিকে যাচ্ছে। আরেকটি হচ্ছে পণ্যবাজারের মূল্য কোন দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, সার, লোহা, সিমেন্ট ও শিল্পের কাঁচামাল। তৃতীয়টি হচ্ছে ডলারের বিনিময় হার কোন দিকে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহারের আভাস সম্পর্কে বলা যায়, যতটা ভাবা হয়েছিল এটি ততটা বাড়বে না। প্রশ্ন হচ্ছে এটি কমবে কিনা কিংবা স্থির থাকবে কিনা? এ দুটি যদি হয় তাহলে আমাদের জন্য ভালো। আর সেটি যদি না হয় এবং সুদহার বাড়তে থাকে, তাহলে আমাদের ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। পণ্যবাজারের দামের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে বলা যায় এটি কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল আবার কিছুটা অস্থিরতাও রয়েছে। ডলার নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা রয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হলে ডলারের বিনিময় হারেও অস্থিরতা দেখা যেতে পারে। এসব ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য আমাদের কিছু সামষ্টিক নীতি সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে যে শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে সেটিকে আরো বেগবান করতে হবে। এছাড়া আমাদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সংস্কার করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সুদহার ও টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। বিনিময় হারে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে রফতানি ও রেমিট্যান্স দুই মাধ্যমেই ডলারের সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বিনিময় হারকে যদি বাজারভিত্তিক করা হয় তাহলে আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে ডলারের সরবরাহ বাড়বে। আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হলো বিদ্যমান বিনিময় হারের কারণে আমরা গত সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসে ৫০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স হারাচ্ছি। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে রফতানির অর্থ প্রত্যাবাসন বেড়ে যাবে। আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ যে আমরা মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে বলে বিনিময় হারকে চেপে রাখছি। কিন্তু আমার তো মনে হয় চেপে রাখার কারণেই মূল্যস্ফীতি বেশি হচ্ছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটে ভুগছে দেশের পুঁজিবাজার। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে এ বিষয়টিও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন একেবারে তলানিতে। গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ার দরের ওপর ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। এতে পুঁজিবাজারের তারল্য দ্রুত কমে যায়। মর্গান স্ট্যানলি ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল (এমএসসিআই) তাদের ইকুইটি ইনডেক্স হিসাব করার সময় বাংলাদেশের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছে। এর ফলে সংস্থাটির ফ্রন্টিয়ার মার্কেটস ইনডেক্স থেকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বাদ পড়েছে।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, গোটা বিশ্বেই এখন পুঁজি, পণ্য ও মুদ্রাবাজারের উত্থান-পতন বাজার প্রভাবকগুলোর বিপরীতে স্বাভাবিক আচরণ করছে না। অনেক দেশেই দেখা দিয়েছে মারাত্মক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির উত্তেজনাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। বাস্তব রূপ নিতে শুরু করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বিপাক নিয়ে যাবতীয় আশঙ্কা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ব্যাংক ধসে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক আর্থিক খাতে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ পরিস্থিতি। বাংলাদেশও এখন এর বাইরে নয় বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান পরিস্থিতিকে আমি বলব যে এটি রক্তক্ষরণ এবং একই সঙ্গে দেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে হয়তো এ অবস্থাকে আরো কিছু দূর টেনে নেয়া যাবে এবং এভাবে চলতে থাকলে আমাদের অবস্থা আরো দুর্বল হতে থাকবে। আমাদের অর্থনীতির ভিতগুলো সার্বিকভাবে সব জায়গাতেই খারাপের দিকেই যাচ্ছিল এবং যাচ্ছে। বাহ্যিক পরিস্থিতির কারণেই যে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়েছে এমনটি নয়। ভারতের ক্ষেত্রেও তো বাহ্যিক ঝুঁকি ছিল কিন্তু তারা তো ভালো করছে।’