পরিকল্পনা ‘আকাশে’ আছে, ‘মর্ত্যে’ আনতে হবে – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in প্রথম আলো on 5 March 2023

কাতারের রাজধানী দোহায় ৫-৯ মার্চ জাতিসংঘের এলডিসি-৫ সম্মেলন হচ্ছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসির তালিকা থেকে বের হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা, করণীয়—এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) সদস্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা চাপে পড়ল—সেসব বিষয়ও আলোচনায় উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর শাহ।

৫-৯ মার্চ কাতারের রাজধানী দোহায় জাতিসংঘের এলডিসি-৫ সম্মেলন হচ্ছে। বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় আছে। এই সম্মেলন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) জন্য এটি পঞ্চম সম্মেলন। প্রতি ১০ বছর অন্তর এই সম্মেলন হয়। এতে সাধারণত উন্নয়ন-সহযোগী ও এলডিসির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অংশ নেন। এই সম্মেলনে এলডিসির উন্নয়ন এবং উত্তরণে কী ধরনের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন, সেই বিষয়ে একটি সম্মতিপত্র গৃহীত হয়।

এই এলডিসি সম্মেলনের সূত্রপাত হয় ১৯৮১ সালে। প্রথম দুবার হয় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে, পরের বার ব্রাসেলসে এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবার কাতারের দোহায় হবে। সম্মেলনে এলডিসির অভিপ্রায় ও অঙ্গীকার নিয়েই বেশি আলোচনা হয়।

২০১১ সালের ব্রাসেলস সম্মেলনে বড় সাফল্য ছিল এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) সুবিধার আওতায় ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত বাজারসুবিধার প্রবর্তন। সম্মেলনের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য টেকনোলজি ব্যাংক গঠিত হয়। তাহলে এবার কী হবে, সেদিকে লক্ষ দিই।

গত বছরই এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। অতিমারির কারণে চলাচল সীমিত হওয়ায় তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কিন্তু ২০২২ সালের মার্চ মাসে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য দোহা কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে এপ্রিল ২০২২-এ এই দলিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদন লাভ করে। আগামী ১০ বছরের জন্য একটি অভিযোগ্য (অ্যাকশনেবল) কর্মপরিকল্পনা আগেই নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় এই সম্মেলন এখন অনেকটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তাই এবার সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দর-কষাকষি ও উত্তেজনা অনেক কম।

এ ছাড়া বিরাজমান বিভিন্নমুখী বৈশ্বিক পরিস্থিতির ও প্রবলতার কারণে প্রধান প্রধান উন্নয়ন-সহযোগীরও এবার আগ্রহ একটু স্তিমিত। উন্নত দেশগুলোর নিজেদের অর্থনীতিতে চাপ, ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে এলডিসি নিয়ে একধরনের অবসাদ সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই সম্মেলনে বড় বড় দেশের শীর্ষ নেতারা খুব বেশি যাচ্ছেন না।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো কতটা এগিয়ে গেল?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: জাতিসংঘের আওতায় ১৯৭১ সালে এলডিসির ধারণাটির যাত্রা শুরু হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যারা একটু পিছিয়ে আছে, তাদের একটি আলাদা তালিকা করা হয়, যা স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি হিসেবে পরিচিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৫৩টি স্বল্পোন্নত দেশ তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এখন এ রকম ৪৬টি দেশ আছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ এর সদস্য হয়। এলডিসি তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য শর্তের চেয়ে জনসংখ্যা বেশি থাকার পরও স্বাধীনতা-পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনা করে সহমর্মিতা দেখিয়ে বাংলাদেশকে এলডিসিতে তালিকাভুক্ত করা হয়।

এই পর্যন্ত মালদ্বীপসহ ছয়টি দেশ এলডিসি তালিকা থেকে বের হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে।

বিশ্বের ১৪ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বসবাস এই স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে। কিন্তু বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশের জোগান দেয় এসব দেশ। এসব দেশ থেকে বিশ্ব রপ্তানির ১ শতাংশের কম হয়। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ১ দশমিক ৪ শতাংশ পায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো।

এতে বোঝা যায়, বিশ্বে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রান্তিক অবস্থান ৫০ বছর ধরে অপরিবর্তিত আছে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলো কেন তাদের পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পারল না?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: মূলত তিনটি কারণে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অগ্রগতি কম। প্রথমত, এসব দেশের উৎপাদন সক্ষমতার শ্লথ বিকাশ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশ কম। তৃতীয়ত, বহির্জনিষ্ণু ধাক্কায় (এক্সটার্নাল শক) অনেক দেশ বিপন্ন হয়েছে। এ ছাড়া বৈরী ভৌগোলিক অবস্থান অনেক এলডিসির উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর মধ্যে আফ্রিকা ও দক্ষিণ প্যাসিফিকের অনেক স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে গেছে।

যে প্রশ্নটি উঠছে তা হলো, সার্বিকভাবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে নাকি অভ্যন্তরীণ দুর্বল শাসনব্যবস্থার কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এগোতে পারছে না। উন্নয়ন-সহযোগী দেশগুলোর কাছ থেকে তাদের জাতীয় আয়ের দশমিক ৭ শতাংশ উন্নয়ন-সহায়তা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এলডিসিরা পেয়েছে মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ। আবার উন্নয়ন-সহযোগী দেশগুলো বাজারসুবিধা দিয়েছে, মেধাস্বত্ব আইন শিথিল করেছে। উন্নত দেশ থেকে প্রযুক্তির হস্তান্তরও হয়েছে। একটি দেশের উত্তরণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু মুখ্য দায়িত্ব ওই দেশের নিজের। স্বল্পোন্নত দেশগুলো সে দায়িত্ব পূর্ণ করতে পেরেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

কোভিডের কারণে বাংলাদেশসহ উত্তরণ পর্যায়ে থাকা দেশগুলোর কী অবস্থা?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: গত দুই বছরে অতিমারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশসহ উত্তরণ পর্যায়ে থাকা স্বল্পোন্নত দেশগুলো আগের চেয়ে দুর্বল হয়েছে। স্মরণ করা যায় যে ইতিমধ্যে অ্যাঙ্গোলা তাদের উত্তরণপ্রক্রিয়া নিজেরা আবেদন করে স্থগিত করেছে। সলোমন আইল্যান্ডের ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা ঠিক করা ছিল। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই অনুরোধ করেছে, তিন বছর যেন পিছিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তাদের অনুরোধ গৃহীত হয়েছে। লাওসের বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। নেপাল ও ভুটানের অবস্থাও আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হলো তারকা দেশ। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গতি নিয়ে এলডিসি থেকে বের হওয়ার জন্য এগোচ্ছিল, তাতে টান পড়েছে। তবে শুধু অতিমারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ দিয়ে এই দুর্বল অবস্থান ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কিত ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা সমস্যাও এর জন্য দায়ী।

বাংলাদেশকেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের অর্থ নিতে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা সমস্যায় তো পড়েছে, তা না হলে দুই চিকিৎসক (আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক) ডাকতে হলো কেন? মূলত দুটি কারণে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। একটি হলো বাজেটীয় ঘাটতি এবং অপরটি বৈদেশিক খাতের ঘাটতি।

তবে এলডিসি থেকে উত্তরণ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই বাংলাদেশের। সময়মতো (২০২৬ সালে) বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু যে ধরনের শক্তিমত্তা নিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল, সেই সামর্থ্যের জায়গায় দেশ কিছুটা হীনবল হয়েছে।

এলডিসি উত্তরণে বাংলাদেশের শক্তির জায়গা কোথায়? দুর্বলতা কোথায়?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হলো গৌরবোজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এই তালিকা থেকে বের হতে অন্য দেশগুলো উৎসাহহীনভাবে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এই উত্তরণকে অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব উত্তরণের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং জলবায়ু সম্পর্কিত ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিনটি সূচকের নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে আছে বাংলাদেশ। এমন সাফল্য অন্য কোনো দেশের নেই।

তবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হতে বাংলাদেশের অন্তত চারটি দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, রাজস্ব আহরণের মাত্রা অত্যন্ত কম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সে তুলনায় রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না। বিনিময় হার কম রাখা হলো, সুদের হার কম করা হলো, কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ল না। তৃতীয়ত, শুল্ক-করসহ এত প্রণোদনা দেওয়া হলো। কিন্তু তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য কোনো খাত দৃশ্যমানভাবে শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়াতে পারল না এখনো। এর অনুষঙ্গ হচ্ছে চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়া। চতুর্থত, মানবসম্পদে ঘাটতি আছে। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাও অপ্রতুল। চাহিদা অনুযায়ী যুবসমাজের কর্মসংস্থান না হওয়ায় শিক্ষিত যুবসমাজের মধ্যে আজ বেকারত্ব জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি।

সংস্কারের প্রতি অনীহা কেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: শুধু বাংলাদেশে নয়; বহু দেশে তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যেও খুব কেন্দ্রায়িত শাসনব্যবস্থা বিরাজমান দেখা যায়। স্বচ্ছতার জায়গায় অনীহা থাকে। অংশগ্রহণের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হতে চান না ক্ষমতাসীনেরা। রাজনৈতিক বৈধতার ঘাটতিকে দৃশ্যমান উন্নয়ন দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা থাকে। সেই উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হোক, তা তাঁরা চান না। এলডিসি-উত্তর যাত্রাকে মসৃণ ও টেকসই করতে হলে এই দ্বন্দ্বের নিরসন করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে দোহা কর্মপরিকল্পনা কী বলে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: গত বছর দোহা আলোচনায় এলডিসি উত্তরণে ছয়টি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। প্রতিটি বিষয় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এক. কাউকে পেছনে ফেলে না রাখতে মানবসম্পদে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অথচ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যথাক্রমে ১ শতাংশ এবং ২ শতাংশ বিনিয়োগ করছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। দুই, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ব্যাপক ব্যবহার। বাংলাদেশ এসব খাতে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে, তবে সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তিন, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের মাধ্যমে অর্থনীতির রূপান্তর। বাংলাদেশে কৃষি থেকে ‘খালাস’ পাওয়া শ্রমকে নতুন ধারার শিল্পে নিয়োজন দিতে হবে। চার, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিকাশ। রপ্তানিযোগ্য পণ্য এবং রপ্তানির বাজার—দুটোরই বিস্তৃতি ঘটাতে হবে বাংলাদেশকে। পাঁচ, জলবায়ুর অভিঘাতের থেকে সুরক্ষায় ঝুঁকি সচেতন টেকসই উন্নয়ন। এ এলাকায় সচেতনতা বেড়েছে, কিন্তু এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অগ্রগতি নেই। ছয়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সংহতি বৃদ্ধি করা। পুরোনো প্রতিশ্রুতির বাইরে এলডিসি-উত্তর পরিস্থিতিতে সহযোগিতার নতুন অঙ্গীকার নিতে হবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কী করছে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য একটি উত্তরণকালীন কর্মসূচি প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্বে একটি উত্তরণকালীন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন উপকমিটি হয়েছে। সার্বিক দায়িত্ব পালন করছে বৈদেশিক সম্পদ বিভাগ (ইআরডি)। তবে এই পরিকল্পনা এখনো ‘আকাশে’ আছে, এটিকে ‘মর্ত্যে’ আনতে হবে। কারণ, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও নজরদারি কীভাবে হবে, তা পরিষ্কার নয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না। সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, ফলাফল কী, তা-ও জানা যাচ্ছে না। তথ্য-উপাত্তের বড় অভাব। তাই সরকারের উদ্যোগগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

উপরন্তু আছে সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও বিভিন্ন খাতভিত্তিক কর্মসূচি। এসব উদ্যোগকে সমন্বিত করে একটি উত্তরণকালীন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা যথেষ্ট নৈপুণ্যের দরকার। কিন্তু এ মুহূর্তে কথা ও কাজের মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক। গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব যেন তাকে পিছিয়ে না দেয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিপ্রায়ের সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবায়নের পার্থক্য দূর করতে হবে।

আমার মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এ জন্য শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়লে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়বে; প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে, শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়বে, সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

এ ছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়া এবং পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে এলডিসির পক্ষে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারে। সমসাময়িক সার্বিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় এনে এবং আসন্ন দোহা সম্মেলনের মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের পরবর্তী কোনো সাধারণ অধিবেশনে উত্তরণকালীন এলডিসিদের সমর্থনে একটি প্রস্তাব পাস করার চেষ্টা করা উচিত। ২০১১ সালের এ রকম একটি প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় তা হতে পারে। বাংলাদেশ এরূপ একটি উদ্যোগে নেতৃত্ব দেবে বলে আশা করি।