Originally posted in সমকাল on 5 March 2021
এ বছর পাট দিবস আমাদের সামনে এক নতুন প্রেক্ষাপট নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। একদিকে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে পাট উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো পাটের সংকট দেখা যাচ্ছে। এর ফলে পাটের স্বাভাবিক মূল্য যা বরাবরই দুই হাজার টাকার নিচে থাকে তা বেড়ে পাঁচ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে সরকার বন্ধ পাটকলগুলোর ব্যাপারে নতুন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছে।
এ বছর পাট সংকটের বিষয়টিকে কিছুটা ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। বরাবরই প্রশ্ন উঠেছে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে পাটশিল্প কতটা উজ্জীবিত থাকবে? রপ্তানি তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, কভিড-১৯ দুর্যোগে অন্য খাতগুলো রপ্তানির ক্ষেত্রে যতটা নেতিবাচকতার মধ্যে পড়েছিল, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি সেক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যতিক্রম ছিল। কভিড সময়কালেও পাট খাত তার প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে ধরে রাখতে পেরেছিল। সেটিই ইঙ্গিত দেয়- বেসরকারি খাতের মাধ্যমে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি এবং এর বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি খাতে যদি পাটের সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে তাদের পক্ষেও পাট খাতের সম্ভাবনা ধরে রাখা ও এই খাতকে উজ্জীবিত করার সুযোগ রয়েছে।
এ বছর বন্যার কারণে পাটের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রাক্কলিত হিসাবেও বলা হয়েছিল উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ থাকার কারণে কিছু কাঁচাপাট উদ্বৃত্ত থাকার কথা ছিল। সবকিছু মিলে আমাদের ধারণা ছিল দেশে পাটের সংকট খুব বেশি হবে না। তার পরও আমরা বাজারে পাটের সংকট দেখতে পাচ্ছি। দুই কারণে এই সংকট হয়ে থাকতে পারে। এক. বৈশ্বিক বাজারে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি; দুই. দেশে পাটের উৎপাদন কম হওয়া। এরকম প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। এক. সরকারি নির্দেশনা ছিল গুদামগুলোতে এক মাসের বেশি সময় ধরে কাঁচাপাট রাখা যাবে না। এর পরিপালন সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা মনিটর করা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাট অঞ্চলগুলোতে যেসব গুদাম রয়েছে, সেগুলো পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। সেখানে সরকারি অনুশাসনের বাইরে গিয়ে কেউ মজুদ করছে কিনা তাও দেখা দরকার। গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার কাঁচাপাট অতিরিক্ত সময় ধরে মজুদ করে অস্বাভাবিক মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে কিনা। কারণ অনেক বেসরকারি পাটকল এত বেশি মূল্যে পাট কিনতে না পেরে তাদের উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে।
মনে রাখা দরকার, পাট এমন এক ধরনের পণ্য, যে পণ্যকে পলিথিন জাতীয় পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হয়। এ ধরনের পণ্যে খুব বেশি লাভ থাকে না। এর ওপর যদি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, তাহলে উদ্যোক্তাদের জন্য পণ্য উৎপাদন করে তা রপ্তানির পর নূ্যনতম মুনাফা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেদিক থেকে কাঁচাপাটের সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সেক্ষেত্রে সরকার স্বল্প সময়ের জন্য পাট আমদানির প্রস্তাব বিবেচনা করতে পারে। কারণ এ মুহূর্তে কৃষকের হাতে পাট নেই, পাট রয়েছে মজুদদারদের গুদামে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে সীমিত সময়ের জন্য আমদানি হলে বাজারে স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তবে পাটের আমদানি বা সরবরাহ কার্যক্রম শেষ করতে হবে নতুন পাট আসার আগেই। নতুবা আমদানিকৃত পাট নতুন বছরের পাটের মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সাধারণত ধান-চালসহ অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়।
আশঙ্কা হচ্ছে, সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পাটের সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে এবং কেউ কেউ এখান থেকে সুবিধা নিচ্ছেন। যা বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিক বিবেচনায় সীমিত সময়ের জন্য কাঁচাপাট আমদানি করা, মজুদদারদের চিহ্নিত করা, সীমিত সময়ের জন্য কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ রাখা ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। এতে অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল হলে এবং সরবরাহও ঠিক থাকলে বেসরকারি পাটকলগুলো যথেষ্ট মাত্রায় পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করতে পারবে।
শুধু পাটকল করপোরেশনই নয়, এর সঙ্গে চিনিকল করপোরেশন, বন ও শিল্প করপোরেশন এবং ক্যাপিটাল শিল্প করপোরেশন সম্বন্ধে সরকার খোঁজ-খবর নিচ্ছে। তাতে অনেকেরই ধারণা- সরকার নীতিগতভাবে সরকারি তত্ত্বাবধানে করপোরেশন চালানোর নীতি থেকে সরে আসছে। আমি মনে করি সরকারের এই সিদ্ধান্ত খুবই যৌক্তিক। সাম্প্রতিককালের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ ধরনের করপোরেশনগুলো শুধু লোকসানই গুনছে না, বরং শ্রমিকদের পাওনা ও বিভিন্ন পক্ষের দায় মেটাতে পারছে না। অবস্থা এমন হয়েছে যে, সরকারের ঋণ সহায়তা ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা করার কোনো সক্ষমতা করপোরেশনগুলোর নেই। এভাবে কোনো শিল্প কর্তৃপক্ষ চলতে পারে না। তাদের নিজস্ব মূলধন ও ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা থাকার কথা। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই করপোরেশনগুলোর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ ফ্রিজ করে দিয়েছে। সেই সুবিধা নিয়ে তারা কেবল এক-দুই বছর লোকসান কিছুটা কমিয়ে এনেছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে আবার লোকসানের গণ্ডিতেই পড়ে গেছে।
সরকারি পাটকলগুলো শুধু নিজেদের অক্ষমতাই প্রকাশ করেনি, একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পাটপণ্যের ওপর ৯ ডলার থেকে ৩৫২ ডলার উচ্চ শুল্ক্ক আরোপ করা হয়েছে। এর কারণ সরকারি পাটকলগুলোতে পণ্য উৎপাদনে যে ব্যয় হয়, সেই তুলনায় তারা কম মূল্যে এগুলো রপ্তানি করে আসছিল। তাতে ভারতের অভ্যন্তরীণ উদ্যোক্তারা তাদের লোকসানের অভিযোগ করলে এই উচ্চ শুল্ক্ক আরোপ করে দেশটি। ইতোপূর্বে ব্রাজিলেও বাংলাদেশের পাটপণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক্ক আরোপ করা হয়েছিল। ফলে সেখানে রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ব্রাজিলের বাজার ছোট ছিল বলে সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু পাটপণ্য রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। এ ধরনের উচ্চ শুল্ক্কের সিদ্ধান্তের কারণে সেখানে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে।
বছর বছর লোকসান গুনে করপোরেশন পরিচালনা না করার সরকারি সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এসব প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে প্রথমেই পাটকলের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। সরকার পাটকলগুলোকে ২০ বছরের জন্য লিজ দিতে চায়। তবে লিজ গ্রহীতাদের ওপর কী কী দায় থাকবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। বলা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর সব দায়-দেনা মিটিয়েই সেগুলো লিজ দেওয়া হবে। কিন্তু উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাবেন কিনা অথবা তারা স্বাধীনভাবে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে পারবেন কিনা এবং উদ্যোক্তারা এত বড় বড় প্রতিষ্ঠান লিজ নিয়ে কতটুকু ইতিবাচক ফল আনতে পারবেন, এর পাশাপাশি এ ধরনের পাটকল লিজ নিয়ে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে কিনা- এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে বিকাশমান উদ্যোক্তারা রয়েছেন এবং বিদেশে যেহেতু বাজার রয়েছে, কাজেই বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ভালো শিল্পায়ন হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা তাদের উদ্যোগগুলো স্থাপনের মাধ্যমে পাটকলগুলোকে সুস্থ করতে পারবেন। একজন নতুন উদ্যোক্তার জন্য জমি প্রস্তুত না থাকা, গ্যাস সংযোগে ঘাটতি থাকা, শ্রমিক সংকট, ব্যাংক ঋণে ঘাটতিসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে। কিন্তু পাটকলগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে না উদ্যোক্তাদের। কাজেই বেসরকারি খাত এসব পাটকলে পাট ও অন্যান্য শিল্পে আগ্রহী হবে।
সমস্যা হলো, আমাদের দেশে এক মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সম্পদ আরেক মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সহজতর নয়। কোনো মন্ত্রণালয়ের সম্পদ অন্য মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এ রকম বিবেচনা থেকেই নিজস্ব মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব সম্পদ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যেই হয়তো লিজ পদ্ধতির বিষয়টি সামনে এসেছে। আমাদের পরামর্শ থাকবে- এ ধরনের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যারা বেশি অগ্রগামী, বিশেষ করে বেজা বা বেপজা অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিসিককে ব্যবহার করা হলে ভালো ফল আসতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সক্রিয় সমর্থন প্রয়োজন।
পাটশিল্পের ক্ষেত্রে সাধারণত তিনটি দাবি আনা হয়। এক. পাটের জন্য; দুই. কর্মসংস্থান; তিন. শিল্পায়নের আঙ্গিকে জমির ব্যবহার। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে দেশের পাটশিল্প দাঁড়িয়ে গেলে এ তিনটি দাবি পূরণ করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে পাটের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান হবে এবং কৃষিতেও পাটের অবদান বাড়বে। আশা করি, বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের পাওনা দ্রুতই মিটিয়ে ফেলা হবে। পাশাপাশি পাটকলগুলো চালু করার সময় ইতোপূর্বে সেখান থেকে কর্ম হারানো অভিজ্ঞ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে।
গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি