Originally posted in বণিক বার্তা on 1 October 2024
দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর অনেক কিছুই নির্ভর করে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে পানির পরিসর অনেক বিস্তৃত। কিন্তু এ খাতের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার ফলে একদিকে ভুক্তভোগী হচ্ছে দেশের সব শ্রেণীর মানুষ, অন্যদিকে দখল-দূষণে মরে যাচ্ছে বেশির ভাগ নদ-নদী। এ অবস্থায় পানিসম্পদকে রক্ষা করতে হলে আমাদের অবশ্যই টেকসই ও হালনাগাদ পানি ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করতে হবে। আর প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে গিয়ে কী করলে অধিক মাত্রায় কার্যকর কিছু করা যায়, নজর দিতে হবে সেদিকেও।
গতকাল রাজধানীতে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য টেকসই পানিসম্পদ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও বণিক বার্তা যৌথভাবে এ বৈঠক আয়োজন করে। বৈঠকটি হয় কারওয়ান বাজারে বণিক বার্তার প্রধান কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
প্রধান অতিথি বলেন, ‘পানি নিয়ে এমন কোনো সমস্যা নেই, যেটা এ দেশে আপনি পাবেন না। আর্সেনিক, লবণাক্ততা, দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ—সবকিছুই এখানে আছে। পানি নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা শুধু বড় বড় প্রকল্পকে ঘিরে। যেকোনো একটি খাল পুনরুদ্ধার করতে গেলে তার বাজেট হয় ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু জনগণের টাকাটা এসব প্রকল্পে সর্বোত্তম ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা দেখাও একটা বড় কাজ।’
অন্তর্বর্তী সরকারের এ উপদেষ্টা মনে করেন, প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে গিয়ে কী করলে অধিক মাত্রায় কার্যকর কোনো কিছু করা যায়, সেটি দেখতে হবে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রকল্প নেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়।
তিস্তাপাড়ের মানুষের দুর্বিষহ জীবনযাত্রার কথা উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘তিস্তার মানুষ এখন সর্বস্বান্ত হচ্ছে। একবার সর্বস্বান্ত হয় বন্যার সময়, আরেকবার হয় নদীভাঙনে। আমি যখন কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চলে গেলাম, সেখানকার মানুষের একটাই বক্তব্য—বানের পানি নামছে না। তার একটাই কারণ, সব খাল দখল হয়ে গেছে আর নদীর মুখ মরে গেছে। পানি যে বঙ্গোপসাগরে নামবে, তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। কারণ সেখানে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।’
উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের আইনকানুন আছে আবার নেই। আইনকানুনগুলো অনেক মাথাভারী। এখানে ওয়াটার পলিসিকে কেন্দ্র করে ওয়াটার অ্যাক্ট হয়নি। ওয়াটার অ্যাক্টের সঙ্গে ওয়াটার পলিসির বেশ বড় ফারাক রয়ে গেছে। যখন কোনো প্রজেক্ট ডিজাইন করা হয়, তখন যে অঞ্চলে এসব প্রকল্প হবে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কাজ হয় না। স্থানীয় সরকার, জেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে এসব প্রকল্প নেয়া হলে অনেকটা ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়া যায়।’
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ‘পানির পরিসর বিস্তর। আমরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপটে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা উন্নয়ন নিয়ে কথা বলি, কিন্তু এর সামাজিক ও পরিবেশগত দিক নিয়ে আলোচনা করি না। পরিবেশগত বিপর্যয়ে ভুক্তভোগী সব মানুষই হয়। তবে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশই বেশি ভুক্তভোগী হয়, যার কারণে উন্নয়ন টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় না। বিগত সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরিবেশ ও সামাজিক খাতসহ অন্যান্য খাতের উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে অসাম্য ও পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে পানির ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশে সুপেয় পানি সরবরাহে অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু সবার জন্য তা হয়নি। অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ—তিনটি শাখাকে এগিয়ে নিতে হলে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনাকে হালনাগাদ করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। পানিসম্পদ রক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’
গোলটেবিল বৈঠকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে পানিসম্পদের ওপর ভিত্তি করে। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে পানি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে, ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। এটা কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগে হয়েছে। এখন পানি উন্নয়ন বোর্ড ভেঙে দিয়ে পানি ব্যবস্থাপনা বোর্ড বানানো দরকার।’
পানিসম্পদের জন্য নদীর গুরুত্ব উল্লেখ করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সাবেক পরিচালক আবু তাহের খান বলেন, ‘শুধু পানি সংরক্ষণের জন্য নদীকে গুরুত্ব দিলে হবে না,বরং গ্রামাঞ্চলে যেসব খাল-বিল, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় ভরাট হয়ে পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। এ কাজ স্থানীয় সরকার সুন্দরভাবে করতে পারবে।’
গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ, ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহার নঈম ওয়ারা, ওয়াটারএইড বাংলাদেশের হেড অব টেকনিক্যাল সার্ভিসেস মো. তাহমিদুল ইসলাম, ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী, ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়ার চেয়ারপারসন রাবেয়া বেগম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাসফিকুস সালেহীন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেসের (সিআইআরএস) পরিচালক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, বুয়েটের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা ও এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ রিসার্চ গ্রুপ আইসিডিডিআর,বির অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট মাহবুব উল আলম। অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তা ও সঞ্চালক ছিলেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।