Originally posted in সমকাল on 29 August 2021
অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কার মধ্যে নতুন অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতির যে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তাতে অনেকটাই ছেদ পড়েছে। গত অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন ২০২১) অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কার কারণে অর্থনীতিতে তৈরি হওয়া সংকটের উপচে পড়া প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। জুলাই মাসে রপ্তানি কমেছে ১১ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমেছে ২৮ শতাংশ। অর্থনীতিতে এক ধরনের দুর্বলতার মধ্য দিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটা মিশ্র প্রবণতার মধ্য দিয়ে গত অর্থবছর (২০১৯-২০) শেষ হয়েছে। রাজস্ব আয়ে উন্নতি হয়েছে। বড় শিল্প তুলনামূলক উন্নতি করেছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ভালো ছিল। আমদানিও ভালো। চাল, সার ও পেট্রোলিয়াম আমদানি অনেক বেশি হারে বেড়েছে। সে তুলনায় পুঁজি পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি বাড়েনি। অন্যদিকে, বেসরকারি বিনিয়োগের হার কমে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন উচ্ছ্বাসের নিচে যে কালো ছায়া রয়েছে তা হলো, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কোনোভাবেই বাড়ছে না। ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এটি গত এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নেও উল্লেখযোগ্য ধীরগতি ছিল।
বিবিএস প্রকাশিত সামষ্টিক অর্থনীতির নতুন উপাত্ত আমাদের বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। সরকার তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনে। শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির হিসাব হচ্ছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। বিবিএসের এ হিসাব সিপিডিসহ দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমরা এর আগে দেখেছি, প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানকে একটি রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত করা হয়েছে। অর্থনীতির বাস্তবতার সঙ্গে প্রবৃদ্ধির হিসাবের অসামঞ্জস্য দেখেছি। বিবিএসের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখে মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কিছুটা সুস্থতা ফিরে এসেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। সতর্কভাবে সম্প্রসারণশীল পদক্ষেপে অব্যাহত রাখতে চাচ্ছে। এটা সঠিক। কারণ অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদা বাড়ানোর জন্য আরও বেশি তারল্য সঞ্চালন প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক মুদ্রানীতিগুলোর সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, ব্যক্তি খাতে ঋণ বৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছে নেই। গত অর্থবছরেও ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৮ দশমিক ৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।
পুনরুদ্ধার কোন পথে
গত অর্থবছরে আমরা কিছু পুনরুদ্ধার দেখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু অর্থবছরের শেষ তিন মাস অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কার মধ্যে পড়ে। যে মিশ্র প্রবণতার পুনরুদ্ধার প্রথম ৯ মাসে ছিল, তাকে ইংরেজি অক্ষর ‘কে’-এর মতো পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে। এর মানে আনুষ্ঠানিক খাত, বড় শিল্প ও আধুনিক সেবা খাতের উজ্জীবন ঘটলেও ছোট ও মাঝারি শিল্প এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের পুনরুদ্ধার হচ্ছে না।
আর্থিক ঘাটতি বা বাজেট ঘাটতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে যতটুকু ঘাটতি সরকার করতে চায়, তাও খরচ বাড়িয়ে সেখানে যেতে পারছে না। বাজেট ঘাটতি পূরণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের প্রতি সরকারের নির্ভরতা ছিল। পরের বছরে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা দেখা গেছে। এর ফলে সরকারের সুদ ব্যয় বাড়বে। সরকারের রাজস্ব থেকে সুদ দিতে হয় বলে প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও ভর্তুকি দেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সক্ষমতা কমবে, যা পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য ভালো খবর নয়। গত অর্থবছরে শেষের তিন মাসে আমাদের বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহ কমে গেছে। এটি প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জন্য যেমন দুঃসংবাদ, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যও দুঃসংবাদ।
গত অর্থবছরে পুঁজি গঠনের হার কমে গেছে। পুঁজি গঠন কম হলে কর্মসংস্থান কম হয়। এর ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষের কর্মহীনতা বাড়ে। মানুষের ভোগের জন্য খরচ বৃদ্ধির হারও কমে গেছে। আয় ও ভোগ কম হলে দারিদ্র্য বাড়বে। এর ফলে বৈষম্যও বাড়বে। বৈষম্য বৃদ্ধির আরেকটি লক্ষণ হলো, আমাদের মজুরি বৃদ্ধির হার কমেছে। বহু দিন পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মজুরি সূচকে আমরা পতন দেখছি। এর ফলে কর্মসংস্থান ও আয় উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রথাগত দরিদ্র যারা ছিল অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক খাত, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কর্মীদের সঙ্গে মাঝারি খাতের লোকজনও ঢুকে যাচ্ছে। এর মানে পিছিয়ে থাকাদের সঙ্গে ‘পেছনে ঠেলে দেওয়া’ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এটি একটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয়।
গত অর্থবছরে সার্বিকভাবে মূল্যস্ম্ফীতি মোটামুটি স্থিতিশীল থাকলেও খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে। সাধারণ মূল্যস্ম্ফীতি যেখানে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতি সেখানে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। আয়, কর্মসংস্থান ও মজুরি, কর্মীর বিপরীতে খাদ্যমূল্য বাড়ছে। খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রকৃত অবস্থা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি। এ পরিস্থিতি গরিব মানুষের জন্য বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক খাত সবল ছিল। কিন্তু অর্থবছরের শুরুতে বৈদেশিক খাতে এক ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। কারণ মানুষ গেছে কম, ফেরত এসেছে বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৯ হাজারের মতো লোক বিদেশে কাজের জন্য গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে গেছে ২৩ হাজারের মতো। অর্থাৎ যাওয়ার সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে। প্রণোদনার কারণে হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বেশি আসছে। রপ্তানির ক্ষেত্রেও আগের অবস্থায় ফেরা যাবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
প্রণোদনা ও পিছিয়ে পড়া মানুষ
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এক জরিপে দেখা গেছে, অতিমারির সময় ৮০ শতাংশ মানুষ খাদ্যের ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়েছে ৬০ শতাংশ। মানুষ পুঁজি ভেঙে খাচ্ছে, ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব মানুষকে প্রত্যক্ষ আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া না গেলে তারা যে শুধু বৈষম্যের শিকার হবে তা নয়, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আরও বেশি পুষ্টিহীনতা এবং শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বড় হবে।
প্রশ্ন হলো, সরকারের বর্তমান প্রণোদনা থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষ কতটুকু সুবিধা পাচ্ছে। গত বছরের মার্চ শেষে শুরু করে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত সরকার মোট ৩০টি প্রণোদনা তৎপরতা শুরু করেছে। এই ৩০টি প্রণোদনার ভেতরে আর্থিক এবং খাদ্য সহায়তা খুবই কম। বড় অংশই ‘হাইব্রিড’, যেখানে ব্যাংকনির্ভর ঋণে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। মাত্র ১৩টি কর্মসূচি আর্থিক সহায়তা-সম্পৃক্ত। চারটি রয়েছে প্রত্যক্ষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি। এই ১৭টি কর্মসূচি প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার, যা সরকার ঘোষিত প্রণোদনার মাত্র ২০ শতাংশ। ৮০ শতাংশই হাইব্রিড, অর্থাৎ ঋণ কর্মসূচি এবং সেখানে গ্রহীতাকে সুদ দিতে হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মানুষ ব্যাংকের সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না।
বস্তুত প্রণোদনার মধ্যে প্রত্যক্ষ সহায়তার পরিমাণ খুবই সামান্য। গরিব মানুষের জন্য সহায়তা সামগ্রিকভাবেও কম, আনুপাতিক হারেও কম। বরাদ্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা দেখছি অসম পরিস্থিতি। গত জুন মাস পর্যন্ত মোট প্রণোদনার ৬৩ থেকে ৬৪ শতাংশ অর্থ অবমুক্ত হয়েছে। কিন্তু আর্থিক সহায়তা অবমুক্ত হয়েছে ৪০ শতাংশেরও কম। আর হাইব্রিড প্যাকেজ অবমুক্ত হয়েছে ৭৫ শতাংশ। তাই গরিবদের জন্য শুধু বরাদ্দের বৈষম্য আছে তা নয়, ব্যবহারেরও বৈষম্য আছে। অবশ্য নতুন যে ৫টি কর্মসূচি এসেছে, তার মধ্যে প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা ও খাদ্য সহায়তা আগের চেয়ে বেশি। তা আরও বেশি বাড়াতে হবে; বিতরণের পদ্ধতি আরও উন্নত ও কার্যকর করতে হবে। সরকার ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে সাহায্য পাওয়ার যে ব্যবস্থা করেছে, তা অত্যন্ত সঠিক পদক্ষেপ এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে আরও বেশি সহায়তা দেওয়া উচিত।
যা করতে হবে
প্রথমত, পিছিয়ে পড়াদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ও খাদ্য সাহায্য অনেক বাড়াতে হবে। যে মানুষদের ক্ষেত্রে সহায়তা পৌঁছানোর সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য সরকারকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচিকে সফল করতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পিছিয়ে পড়া মানুষদের টিকা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনকে যুক্ত করতে হবে। সরকার এ দুটি কাজ এককভাবে করে উঠতে পারবে না।
তৃতীয়ত, সরকারকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে খাদ্য পরিস্থিতিকে মনোযোগের মধ্যে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এই মুহূর্তে পণ্যমূল্য বাড়ছে। খাদ্য, সার ইত্যাদির দাম বাড়ছে। এর প্রতিফলন বাংলাদেশের ওপর পড়বে। এ জন্য খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতিকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে চালের বাজার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ও সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো