Published in কালের কন্ঠ on Sunday 7 May 2017
নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানিতে ধস
প্রণোদনার পরও ১৫ দেশের মধ্যে ১০টিতেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি
নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য সরকার উদ্যোক্তাদের ৩ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু এ সুবিধা দেওয়ার পরও নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানিতে ধস নেমেছে। উদ্যোক্তারা এ সুবিধা কাজে লাগাতে পারছেন না। যে ১৫টির মতো দেশকে নতুন বাজার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে ১০টিতেই রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। কোনো দেশে প্রবৃদ্ধি কমেছে ২৭ শতাংশ, কোনোটিতে ১৭ শতাংশ আবার কোনোটিতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের বাজার বহুমুখীকরণের লক্ষ্য সামনে রেখেই নতুন বাজারগুলো চিহ্নিত করা হয়। আর এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি দেখা দেয় মূলত ২০১৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত হলে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক জিএসপি সুবিধা পায় না, তবুও দেশটি এ সুবিধা বাতিল করলে পোশাক রপ্তানিও কমতে থাকে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের আরেক প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই দুই বাজারের বাইরে পোশাক শিল্পের নতুন বাজার সৃষ্টিতেই ওই ১৫টি দেশকে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু নতুন বাজারগুলোতে প্রথম দিকে রপ্তানি ভালো হলেও ক্রমেই তা কমছে।
এর কারণ সম্পর্কে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, একেক বাজারে একেক রকম কারণ রয়েছে পোশাক রপ্তানি কমার। এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ব্রাজিলসহ নতুন বাজারের কয়েকটি দেশে মুদ্রার দরপতন ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ ছাড়া ব্রাজিলে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এ কারণেও দেশটিতে পোশাক রপ্তানি কমেছে।
এ ছাড়া দেশটিতে পোশাক রপ্তানিতে ২৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এটাও একটি বড় কারণ। ভারতে পোশাক রপ্তানিতে খুব একটা সুবিধা করা যাচ্ছে না, কারণ দেশটি নানা রকম ট্যারিফ-নন ট্যারিফ ব্যরিয়ার দিয়ে রেখেছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া সরকার বিমানে করে পোশাক রপ্তানিতে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে তার প্রভাব পড়ছে। এভাবে একেক দেশে একেক রকম সমস্যায় নতুন দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে ভালো সুবিধা করা যাচ্ছে না। তবে আশা করছি আগামীতে এসব সংকট কেটে গেলে নতুন দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি বাড়বে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিজিএমইএ ২০২১ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নতুন বাজার সন্ধানের বিকল্প নেই। রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকাভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে সরকার হয়তো সহযোগিতা দিচ্ছে, আরো সহযোগিতা দরকার। সেই সঙ্গে পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে কাজ করতে হবে। ওই সব দেশগুলোতে মেলাসহ আরো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবেই নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) নতুন দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে মন্দাভাব যাচ্ছে। এতে দেখা যায়, নতুন বাজারগুলোর মধ্যে ব্রাজিলে গত বছরের ৯ মাসের চেয়ে পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৬.৯৭ শতাংশ। গত বছর এই সময়ের মধ্যে দেশটিতে পোশাক রপ্তানি হয় ১০ কোটি ৩৬ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। অথচ চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে দেশটিতে পোশাক রপ্তানি হয় সাত কোটি ৫৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের। অর্থাৎ গত বছরের ৯ মাসের চেয়ে এ বছরের ৯ মাসে ব্রাজিলে পোশাক রপ্তানি কমেছে দুই কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের বা ২৬.৯৭ শতাংশ।
উত্তর আমেরিকার দেশ মেক্সিকোতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৬.৯৭ শতাংশ। গত বছর ৯ মাসে দেশটিতে রপ্তানি হয় ১০ কোটি ৭৩ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। এবার হয়েছে আট কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে কম হয়েছে এক কোটি ৮২ লাখ ১০ হাজার ডলারের।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গত বছরের ৯ মাসের তুলনায় এবার পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৬.৮৬ শতাংশ। গত বছর দেশটিতে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল পাঁচ কোটি ২৮ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। এবার হয়েছে চার কোটি ৩৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। গতবারের চেয়ে কম হয়েছে ৮৯ লাখ ১০ হাজার ডলার।
আরেক নতুন বাজার দক্ষিণ কোরিয়ায় পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৪.৮৭ শতাংশ। গত বছর দেশটিতে পোশাক রপ্তানি হয় ১৫ কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। এ বছরের ৯ মাসে হয়েছে ১২ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার দক্ষিণ কোরিয়ায় পোশাক রপ্তানি কমেছে দুই কোটি ২৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার।
নতুন বাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় অস্ট্রেলিয়াকে। দেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকেরই নজর এই দেশটির দিকে। কিন্তু এ দেশটিতেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন উদ্যোক্তারা। গত বছরের চেয়ে দেশটিতে এবার রপ্তানি কমেছে ৯.৪৭ শতাংশ। গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় পোশাক রপ্তানি হয় ৪৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের। এ বছরের ৯ মাসে হয় ৪৫ কোটি আট লাখ ৫০ হাজার ডলারের। অর্থাৎ এবার কম হয়েছে চার কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের।
নতুন বাজারগুলোর মধ্যে আরেকটি সম্ভাবনাময় দেশ প্রতিবেশী ভারত। এ দেশটিতেও গত বছরের চেয়ে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৭.৮৫ শতাংশ। ভারতে গত বছরের ৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ১০ কোটি ৫২ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। এ বছর হয়েছে ৯ কোটি ৬৯ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে কম হয়েছে ৮২ লাখ ৭০ হাজার ডলারের।
এ ছাড়া তুরস্ক, জাপানসহ অন্য কয়েকটি নতুন দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি না হলেও রপ্তানি আয় বেড়েছে খুবই সামান্য, ১ থেকে ২ শতাংশ। তবে নতুন বাজারগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু রাশিয়া, চিলি এবং চীন। এর মধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি বেড়েছে ৫৭.৬১ শতাংশ, চিলিতে ৩৬.৩৬ শতাংশ এবং চীনে বেড়েছে ২৭.১২ শতাংশ।