Originally posted in সমকাল on 21 December 2022
একনেক বৈঠক কম প্রকল্প ফেরত
বছর দেড়েক আগেও প্রকল্প অনুমোদনে প্রতি সপ্তাহেই হতো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক। এখন প্রতি মাসে হচ্ছে গড়ে একটি। অন্যদিকে একনেকে প্রকল্পও উঠছে খুব কম। ফেরত পাঠানো হচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো থেকে আসা অনেক প্রকল্প প্রস্তাব। মূলত সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতির কারণেই দেখা যাচ্ছে এমন চিত্র।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সমকালকে বলেন, ‘আগে নিয়মিত প্রতি মঙ্গলবার একনেক বৈঠক হতো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি এবং এর পরে বৈশ্বিক মন্দাবস্থার কারণে কৃচ্ছ্র নীতি নিতে হয়েছে সরকারকে। অনেক যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। জরুরি না হলে নেওয়া হচ্ছে না।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়. ব্যয় সাশ্রয় নীতি গ্রহণের পর থেকেই নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। পুরোনো প্রকল্প সংশোধনের ক্ষেত্রে বেশি টাকার বিষয় থাকলে তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। প্রকল্প প্রস্তাবের ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি বিষয় যুক্ত করতে বলা হচ্ছে। এসব কৌশলের কারণে একনেক পর্যায়ে নতুন কিংবা সংশোধনীর জন্য খুব বেশি প্রকল্প আসতে পারছে না। ফলে একনেক বৈঠকও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
যে কয়টি একনেক বৈঠক হচ্ছে, সেখানে প্রকল্প সংখ্যাও থাকছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। কম টাকার ছোট প্রকল্পগুলোই কেবল বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। মেনে চলা হচ্ছে গুরুত্ব অনুসারে প্রকল্পগুলোকে তিন শ্রেণিতে পুনর্বিন্যাসের বিষয়টি। এসবের মাধ্যমে সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে অনুমোদিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির প্রভাবে এডিপির বাস্তবায়নেও ধীরগতি নেমে এসেছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চার মাসে বাস্তবায়নের হার ছিল সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যমতে, অর্থবছরের চার মাসে এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছে ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও এর চেয়ে বেশি হারে এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছিল। বাস্তবায়ন এর চেয়ে কম ছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে। তা ছিল ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যয় সাশ্রয়ের দিকটি সরকারের জন্য বেশ স্বস্তির। তবে এতে প্রকল্পের এমন বাস্তবায়ন পরিস্থিতির কারণে কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, নতুন করে অনুমমোদন হওয়া প্রকল্পের সংখ্যা এবং সেখানে অর্থ বরাদ্দ কমে এসেছে। এতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কিছুটা ধীর হয়ে পড়েছে- এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আপাতত কিছু করার নেই। কারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশি মুদ্রার মজুত অর্থাৎ রিজার্ভ ভেঙে খেতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিগত বছরগুলোর উন্নয়নের ধারা এবং স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের এই প্রক্রিয়ায় ভৌত অবকাঠামো, শিল্পশক্তি ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এখন বড় ধরনের উন্নয়ন চাহিদা রয়েছে। তা পূরণ না হলে কিছু ক্ষতি হবে। তাই বলে আমরা নিজের পেশি তো আর নিজে কামড়ে খেতে পারি না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রকল্প গ্রহণ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে না হলে তা জাতীয় উন্নয়নকে পিছিয়ে দিতে পারে। স্থগিত প্রকল্পগুলো পরে আবার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হলে তখন খরচ বেড়ে যাবে। কারণ দিন দিন ব্যয় তো বাড়ছেই। এ ছাড়া প্রকল্পের সেবাটি সময়মাফিক না পাওয়া গেলে তা অর্থনীতিতে যে ধরনের মূল্য সংযোজন করার কথা, সেটাও হবে না। তাই এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ধারণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কোন প্রকল্পটি আপাতত বন্ধ রাখা যায়, কোনটি চলমান থাকবে তা নির্ধারণে বিচক্ষণতা প্রয়োজন। সেটি কতটুকু করা হয়েছে তা দেখার বিষয়।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্প বসিয়ে রাখা এক অর্থে খারাপ নয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প মানেই তো অপচয়। এই অর্থ সংকটকালে অপচয় রোধ হচ্ছে, সেটাই বড় কথা।
ছয় মাসে পাঁচটি একনেক :বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আসা প্রকল্প প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদনের জন্য একনেকে উত্থাপন করে পরিকল্পনা কমিশন। এই অনুমোদনের ভিত্তিতেই এডিপি বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার একনেকের বৈঠক হতো। কিন্তু এখন তা আর প্রতি সপ্তায় হচ্ছে না। সর্বশেষ একনেক বৈঠক হয়েছে গত ২২ নভেম্বর। এরপর আর হয়নি। চলতি অর্থবছরের গত ছয় মাসে মাত্র পাঁচটি একনেক বৈঠক হয়েছে। অনুমোদন হয়েছে ৩০টি প্রকল্প। যেগুলোতে অর্থ বরাদ্দ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ১৮টি একনেক বৈঠক হয়েছে। করোনার আগে প্রতি অর্থবছরে গড়ে ৫০টির মতো একনেক বৈঠক হয়েছে।
৬৩৬টি প্রকল্পের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত :বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই কৃচ্ছ্রসাধন নীতি গ্রহণ করে সরকার। চলতি অর্থবছরের শুরুতেই গুরুত্ব অনুসারে প্রকল্পগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ভিত্তিতে গত আগস্টে প্রকল্প পুনর্বিন্যাস করে পরিকল্পনা কমিশন।
নতুন বিন্যাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অব্যাহত আছে। এ রকম ৬৪৬টি প্রকল্প রয়েছে এই শ্রেণিতে। গুরুত্বের দিক থেকে মধ্যম শ্রেণির প্রকল্পগুলোকে ‘বি’ শ্রেণিতে ফেলা হয়েছে। এ রকম প্রকল্প আছে ৬৩৬টি। সরকারি অংশের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত রাখা হয়েছে এসব প্রকল্পে। আর ‘সি’ শ্রেণিতে থাকা প্রকল্পের পুরো টাকা ছাড়ই আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এই শ্রেণির প্রকল্পের সংখ্যা ৮৫টি। ১ হাজার ৪৯৬টি প্রকল্পের বিপরীতে চলতি অর্থবছর এডিপিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।