Published in সারা বাংলা on 2 January 2020
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ফলে অনেক বড় বড় সাফল্য আসলেও এতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেশি বৈষম্য বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বুধবারের (৩০ ডিসেম্বর) সারাবাংলা.নেটের বিশেষ আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের এবারের পর্বের বিষয় ছিল ‘২০২০: বছরটা কেমন গেল’। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সারাবাংলাডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এম এ কে জিলানী।
উল্লেখ্য, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পর সম্প্রতিকালে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এ বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও বিনিয়োগ নেই। আবার বিনিয়োগ যেখানে আছে, সেখানে কর্মসংস্থান নেই। অন্যদিকে কর্মসংস্থান থাকলেও, কর নেই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই গোলকধাঁধাঁরই সমাধান করতে হবে। এছাড়া অর্থনীতিতে নতুন কোনো প্রবণতা দেখা গেলে সেটাকে সামনে এগিয়ে নিতে আসতে হবে।
২০২০ সালে পুরো পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনে করোনাভাইরাস। বিশ্বব্যাপী এই মহামারি আমাদের কী শিক্ষা দিল—এ প্রশ্নের উত্তরে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উপলব্ধি হলো, বাংলাদেশের উন্নয়ন আর অর্জন ধরে রাখার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা দরকার, তা আছে কি না তার পরীক্ষা হয়েছে এই মহামারির সময়ে।’
বাংলাদেশে মহামারির সময় প্রবৃদ্ধি হলেও, সকলের উন্নয়ন অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন হচ্ছে না। এগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দরকার, তাদের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি সারাবাংলা ফোকাসে বলেন, ‘করোনার আরেকটি উপলব্ধি হলো, যে জনসম্পৃক্ত প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা এতদিন আমরা তুলে ধরেছি, করোনা ঘরে এসে মৃত্যু দিয়ে আমাদের তা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। করোনায় আমাদের দেশে মৃত্যু হার কম হলেও মধ্যবিত্ত ও বিত্তশালীদের মৃত্যুহার বেশি। তাই করোনার আরেকটি উপলব্ধি হলো, দেশের ভিতরে সুশাসন দিতে না পারলে এর ফলাফল সবাই পাবে।’
করোনাভাইরাস আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেল—করোনার টিকা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এ শিক্ষাকে কাজে লাগানো যাবে কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ড. দেবপ্রিয়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘করোনার সময় মন্ত্রিপরিষদে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, এমনকি সংসদ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার সময়ে আমরা আবারও বুঝতে পেরেছি, মানুষের অধিকার এবং মানবিক উপলব্ধি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’
অন্যদিকে, এসব অধিকার রক্ষার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে, সেগুলো যদি ঠিকমতো কাজ করে তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এসব অধিকার রক্ষা করা সহজতর হয় এবং সরকারের কার্যক্রম আরও বেশি সাফল্যমণ্ডিত হয় বলেও মনে করেন তিনি।
নতুন বছরে শুধু নিজের দেশ নয়, বিশ্ব থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক ও বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশের টিকে থাকতে হবে।’
বৈদেশিক বিনিয়োগনির্ভর অর্থনীতি বাংলাদেশকে যেকোনো সময় দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করোনার সময় সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছে কৃষিখাত। তাই আগামী দিনের ধাক্কাকে সামলাতে হলে কৃষিখাত, গ্রামীণ অর্থনীতি, ছোট এবং মাঝারি আকারের শিল্প, সেবা এদের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
এছাড়া রফতানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়াতে গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষিকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং আমাদের তা কাজে লাগাতে হবে।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি আমরা। মধ্যবিত্তের আয় বাড়লেও তার শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি, সুরক্ষা হয়নি স্বাস্থ্যের। শিক্ষিত যুবকের বেকারত্বের হার বেড়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসব বিষয় মোকাবিলা করতে হবে।’
সর্বোপরি সার্বজনীন নাগরিক-সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখার ওপর জোর দেন তিনি। এটিই স্বাধীনতার ৫০ বছরের সবচেয়ে বড় অবদান হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।