Published in বণিকবার্তা on 4 October 2020
বাংলাদেশের অর্থনীতি ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন
গত ৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২০ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সম্মানিত আলোচকদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে এ ক্রোড়পত্র
রেহমান সোবহান
চেয়ারপারসন, সিপিডি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
বাংলাদেশের উন্নয়নে আমাদের প্রায় অর্ধশত শতাব্দী যাত্রার জন্য আমরা সত্যিই গর্বিত। এটি আমাদের সার্বিক চমকপ্রদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দৃশ্যমান। কৃষি খাতে বৈচিত্র্য দৃশ্যমান। শিল্প খাতের অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক। অবকাঠামোতে ভালো রকমের উন্নতি হয়েছে। আরো তাত্পর্যপূর্ণভাবে উন্নয়ন ঘটেছে মানুষের জীবনমানে ও মানব উন্নয়ন সূচকে। প্রকৃতপক্ষে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন পর্যায়ক্রমিকভাবে বলেছেন যে নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রত্যাশিত গড় আয়ু প্রভৃতি সূচকে আমরা আসলে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নৈপুণ্যের দিক থেকে পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে গেছি আমরা। মূলত তত্কালীন পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির মধ্যে বিপুল বৈষম্য দ্বারা তাড়িত হয়ে আমাদের পুরো মুক্তি-স্বাধীনতা আন্দোলন আবর্তিত হয়েছিল এবং অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ৫০ বছর পর এখন আমরা প্রকৃতপক্ষে মাথাপিছু আয় ও সম্পদ সঞ্চয়ন, প্রজনন হারে নিয়ন্ত্রণসহ আরো অনেক সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছি। পাকিস্তান আমলে আমাদের বাস্তবতা ছিল জনমিতিক হিসাবে জনসংখ্যায় বেশি হলেও সার্বিক উন্নয়ন থেকে কম সুফল পেয়েছি। আজকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু মাথাপিছু আয়ে তারা আমাদের চেয়ে কম।
আমরা এ পর্যন্ত যা অর্জন করেছি তা স্বীকার করে আমাদের এখন এগিয়ে যেতে হবে। তবে এতে আত্মপ্রসাদে ভুগলে চলবে না। বরং আমরা ভবিষ্যতে যা অর্জন করতে পারব, তার জন্য প্রস্তুতি নেয়াই হবে অধিকতর ফলপ্রসূ। বৈশ্বিক সংকটে অর্থায়ন বিষয়ের ওপর একজন বিখ্যাত লেখক আছেন। তিনি হলেন রৌবিনি। তিনি ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ নামে একটি বই লিখেছেন। যেখানেই যান আপনারা বেশির ভাগ হোয়াইট সোয়ান দেখবেন। ব্ল্যাক সোয়ান দেখা খুবই বিরল ঘটনা। এ ধরনের ঘটনার কোনো সুনিশ্চিত অনুমানযোগ্যতা নেই। রৌবিনি দেখিয়েছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট পর্যালোচনার যৌক্তিক ব্যাখ্যা সবসময়ই খুব কার্যকর (প্রডাক্টিভ) না-ও হতে পারে। সংকট অনেক সময় ব্ল্যাক সোয়ানের (বিরল ঘটনা) কারণেও হতে পারে। বর্তমানে সম্ভবত আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখছি নভেল করোনাভাইরাসের মতো ব্ল্যাক সোয়ান। এটা এরই মধ্যে বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে। জানি না এটি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। তবে এ থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হলো, এমনকি অর্থনীতিতে সবকিছু ভালো চললেও র্যানডম শক আসতে পারে।
ভিয়েতনামের কথা বলাই যায়। দেশটি গত কয়েক বছরে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় অনেক এগিয়েছে। ভিয়েতনাম কীভাবে এগিয়েছে, সেটি হুবহু অনুকরণ করার আমাদের দরকার নেই। আমাদের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। আমরা একটি প্রথম প্রজন্মের ডাইনামিক উদ্যমী উদ্যোক্তাশ্রেণী পেয়েছি। তারা তাদের উদ্যোক্তা সক্ষমতায় কর্মজীবী নারী ও শ্রমজীবীদের কাজের সংস্থান করেছেন, যারা প্রকৃতপক্ষে গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তারা আরো উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা তৈরি করছেন; যারা অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে উঠে আসছেন। তাদের নিম্ন উত্পাদনশীলতাকে বৈশ্বিক প্রতিযোগীদের সমপর্যায়ে উন্নীত করেছেন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা বিপুল প্রতিযোগিতার সামর্থ্য দেখাচ্ছেন। একইভাবে আমরা আমাদের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের রেজিলিয়েন্স দেখাতে পেরেছি। কৃষকরা ফসল উত্পাদন আগের চেয়ে লক্ষণীয় মাত্রায় বাড়িয়েছেন। এ খাতে বহুমুখিতা এনেছেন। গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে এসএমইর সংযোগ বিদ্যমান। তারাও উল্লেখযোগ্য সৃজনশীলতা প্রদর্শন করেছে। ক্ষুদ্রঋণ খাতে আমাদের নারীরা গ্রেট রিসিভিয়ারের ভূমিকা পালন করেছেন। এসব কথা বলার মাধ্যমে আমি যাতে জোর দিতে চাইছি তা হলো, যেহেতু সুযোগ সীমিত, সেহেতু কোন কোন খাতে আমাদের শক্তি বাড়াতে হবে, সেটি চিহ্নিত করতে হবে; যাতে আমরা আমাদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি। আমি দ্রুত এর কয়েকটি উল্লেখ করতে চাই এবং শেষ করতে চাই যে আমরা কোথায় কোথায় বঙ্গবন্ধুর ভিশন থেকে বিচ্যুত হয়েছি। সেখানে আসলে আমরা কী করতে পারি। প্রথমটি হলো, আমাদের আর্থিক খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। এটি সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়েছে। এখন শুধু কাজ করা দরকার। এটিকে শৃঙ্খলায় আনা গেলে তা শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয়টি হলো, আইনের শাসন ও প্রশাসনিক কার্যকারিতা-আচরণ। আমাদের সবার জন্য বিশ্বাসযোগ্য সমান ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।