Originally posted in সমকাল on 16 January 2022
বাংলাদেশে কভিড সংক্রমণ, এর ব্যবস্থাপনা এবং অভিঘাতের ওপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা সংস্থা কাজ করেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বিআইজিডি, পিপিআরসি, সানেমসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান গত দুই বছরে বিভিন্ন সময়ে জরিপ পরিচালনা করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংলাপ বা আলোচনার আয়োজনও করেছে। নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও সিপিডি বেশ কয়েকটি ফোকাস গ্রুপ এবং এক্সপার্ট গ্রুপ আলোচনা করেছে। সব আলোচনা ও পর্যালোচনায় কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিভাত হয়।
বাংলাদেশে প্রথম কভিড সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় গত বছর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে। দুটি ঢেউয়ের পর গত বছরের শেষদিকে এসে বাংলাদেশে কভিড শনাক্ত ও মৃত্যুহার একেবারেই কমে গিয়েছিল। নতুন বছরের শুরুতে আবার সংক্রমণ বাড়ছে এবং কভিডের নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বব্যাপী নতুন করে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কভিডের অভিজ্ঞতার ওপর ঐকমত্যের বিষয়গুলো নীতি ব্যবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরা এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি।
আমার বিবেচনায় অন্তত সাতটি বিষয়ে সবার মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। প্রথমে কভিডের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বলতে চাই। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংক্রমণের হার বিবেচনায় বাংলাদেশ পরিমিত ধরনের কভিড আক্রান্ত দেশ, যেখানে তুলনামূলক মৃত্যুহার কম। তবে টিকাদানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনও প্রথম ডোজ টিকা নেয়নি। বাংলাদেশে কভিডের প্রভাবে আগে থেকে থাকা কিছু দুর্বলতা বা ভঙ্গুরতা আরও প্রকট হয়। অন্যদিকে, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের ওপর অভিঘাত ছিল তুলনামূলক বেশি। অনেক মানুষ কভিডের কারণে নানাভাবে ক্ষতির মুখে পড়ার কারণে ‘নব্য দারিদ্র্যের’ সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর অতিমারির প্রভাব নিয়ে। সব বিশ্নেষকই একমত, অতিমারির সময় সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ছিল। মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আর গত অর্থবছরে (২০২০-২১) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ ছাড়া সংক্রমণের সময় রেমিট্যান্স বেড়েছিল। খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল। তবে প্রথম ঢেউ শুরুর পর রপ্তানি কমে যায় এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ধীর হয়ে পড়ে। যদিও ২০২১ সালে রপ্তানি পরিস্থিতির উন্নতি হয় এবং সে ধারা বজায় রয়েছে।
তৃতীয় ছিল শ্রমবাজারের সমন্বয় নিয়ে। বড় সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হলেও দেশের শ্রমবাজারে মোটামুটি এক ধরনের সহিষ্ণু আচরণ করেছে। তবে শহর-গ্রাম অভিবাসন বেড়ে যায়। বিভিন্ন খাতে মজুরি কমে যায় এবং একই সঙ্গে কর্মসংস্থান কমে যাওয়াসহ অর্থনীতিতে অনানুষ্ঠানিকতার মাত্রা বেড়ে যায়। ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহযোগিতায় গত বছর জুন মাসে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে খানাভিত্তিক মুখোমুখি জরিপ করা হয়। গার্মেন্ট কারখানা অধ্যুষিত ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ জেলায় শ্রমিকদের ওপর জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, প্রথম ঢেউয়ের সময় ৫৮ শতাংশ কর্মী আংশিক বেতন বা বোনাস পেয়েছেন। একেবারেই পাননি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কভিডের আগের তুলনায় প্রথম ঢেউয়ের সময় প্রায় ৫৭ শতাংশ ওভারটাইম কমে যায় এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় এ হার দাঁড়ায় ৪০ শতাংশ। বেতন কমে যায় প্রথম ঢেউয়ের সময় ১৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ১২ দশমিক ৭ শতাংশ।
চতুর্থত, ব্যাপক ও গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সবার পর্যালোচনা, গবেষণা বা জরিপে এসেছে। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সংকটের চেয়ে প্রকট ছিল আয়, সঞ্চয় এবং ঋণগ্রস্ততার বিবেচনায় আর্থিক সংকট। সঞ্চয় ভেঙে ফেলার উচ্চপ্রবণতা, সম্পদ বিক্রি এবং ঋণ গ্রহণের কারণে অনেকে ঋণের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে যান। এর পাশাপাশি গৃহে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি এবং বয়োজ্যেষ্ঠ ও শিশুদের প্রতি নির্যাতনের তথ্যও পাওয়া যায়।
পঞ্চমত, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ে উদ্বেগের বিষয়ে ঐকমত্য ছিল। দেখা গেছে, পেশার ধরন ও আয় নির্বিশেষে পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। আয় কমে যাওয়ার কারণে অনেককে খাদ্য গ্রহণ কমাতে হয়, যা পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। গ্রাম ও শহর উভয় এলাকায় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং শিশুদের সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়েও একই ধরনের মতামত উঠে এসেছে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকা এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ার কারণে বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঘটনা বেড়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষেত্রে অনলাইনে শিক্ষা (ই-লার্নিং) কার্যক্রমে মারাত্মক বৈষম্য দেখা যায়, দরিদ্র ও প্রান্তিক শিশুরা তুলনামূলক বেশি শিখন ঘাটতিতে পড়ে এবং তার সঙ্গে স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষা শেষ করার হার কমে যাওয়ারও প্রবণতা তৈরি হয়েছে। লকডাউনের সময় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ দেশের ২১টি জেলায় একটি দ্রুত জরিপ করে। সেখানে দেখা যায়, বেসরকারি সংস্থাটির কর্মএলাকায় ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সের ১৩ হাজার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অনেক স্কুলে দেখা যাচ্ছে, নবম ও দশম শ্রেণিতে কোনো কন্যাশিশু নেই। অন্যদিকে, লকডাউনের কারণে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তখন আর্থিক অনটনের কারণে অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত করে।
সপ্তম ছিল নীতি হস্তক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে। যথাযথ নীতি উদ্যোগের মাধ্যমে কভিড সংক্রমণের প্রথম দিকেই সরকারি সহায়তা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, বাজারে তারল্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা সম্প্রসারণ। তবে সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর চারটি সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয়। প্রথমত, জিডিপির অংশ হিসেবে এখানে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ ছিল। সরকারি হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রণোদনার আকার জিডিপির ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে শুধু খাদ্য সহায়তা ও প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। দ্বিতীয়ত, নগদ হস্তান্তর এবং খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম পর্যাপ্ত ছিল না। গত বছর নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোট ৩০টি কর্মসূচির মধ্যে মাত্র ১৩টি কর্মসূচি আর্থিক সহায়তা নিয়ে কথা বলে। চারটি ছিল প্রত্যক্ষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি। এই ১৭টি কর্মসূচি প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার সরকার ঘোষিত প্রণোদনার মাত্র ২০ শতাংশ। ৮০ শতাংশই হাইব্রিড অর্থাৎ ঋণ কর্মসূচি। তৃতীয়ত, প্রকৃতপক্ষে সরকারের এ সহায়তা যাদের পাওয়ার কথা, তাদের অনেকেই পাননি। অর্থাৎ প্রকৃত সুবিধাভোগী কম ছিল। চতুর্থত, সহায়তা বিতরণের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, শুধু আর্থিক সহায়তা কম দেওয়া হয়েছে তা নয়, যা দিয়েছে তার সব খরচ করতে পারেনি। আড়াই হাজার কোটি টাকার বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের মাত্র ৪৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে আড়াই হাজার করে নগদ টাকা দেওয়ার কর্মসূচিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
সুবিধাবঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া এবং ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিক, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী এবং ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ নতুন করে পিছিয়ে পড়া এবং পেছনে ঠেলে দেওয়া জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ পর্যাপ্ত ছিল না। ভৌগোলিকভাবে প্রত্যন্ত এলাকার (যেমন- চর, হাওর ও উপকূলীয় এলাকা) মানুষ, বস্তিবাসী, আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং ভাসমান জনগোষ্ঠীর ওপর বৈরীভাবে কভিডের প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া বয়স্ক নাগরিক ও শিশুদের প্রতি প্রণোদনা প্যাকেজগুলো আলাদাভাবে নজর দেয়নি। পিছিয়ে পড়া এবং পেছনে ঠেলে দেওয়া মানুষ কোনো ‘নেটওয়ার্ক’-এর আওতায় ছিল না। এ কারণে সামাজিক এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন যোগাযোগ তাদের জন্য সরকারি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রথম লকডাউনের সময় ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা বেশ দৃশ্যমান ছিল। নিজেদের কর্মসূচির সঙ্গে জুতসই না হওয়া এবং তহবিলের অভাবে ওই সময় এনজিওর ভূমিকা ছিল সীমিত। তবে ক্ষুদ্রঋণ আদায় সাময়িকভাবে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ঋণগ্রহীতাদের জন্য সহায়ক ছিল।
কভিড কিংবা এ ধরনের অতিমারির জন্য আগামী দিনের নীতিনির্ধারণে এবং মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য এই সাত ঐকমত্যের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেষ করব এই বলে, কভিড সংক্রমণের অতি সাম্প্রতিক প্রবণতার কারণে সরকার নতুন করে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আবার যদি লকডাউনের মতো পরিস্থিতি হয়, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে। খাদ্য সাহায্য দিতে হবে। এটি না করা গেলে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষদের ভোগ ও জীবনের মানের গুরুতর অবনমন ঘটবে এবং দেশে আর্থসামাজিক বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতিবিদ ও সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি